E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

উপেক্ষিত বেগম রোকেয়া : পর্ব ২

আলোয় উদ্ভাসিত পায়রাবন্দ আবার অন্ধকারে নিমজ্জিত

২০১৯ ডিসেম্বর ১০ ১৬:২৯:০৬
আলোয় উদ্ভাসিত পায়রাবন্দ আবার অন্ধকারে নিমজ্জিত

মানিক সরকার মানিক, রংপুর : অন্ধকার থেকে আলোয় উদ্ভাসিত হওয়া মহীয়সী রোকেয়ার পায়রাবন্দ এখন আবার অন্ধকারে নিমজ্জিত। শুধুমাত্র সরকারী সদিচ্ছা আর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আন্তরিকতার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতির পাদপীঠ’ হিসেবে গড়ে তোলা ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র’টি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত এ কেন্দ্রটি বিগত জোট সরকারের সময় থেকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে আজ। ইতোমধ্যেই কেন্দ্রের অবকোঠামো আসবাবপত্র অত্যাধুনিক অডিটোরিয়ামসহ মূল্যবান মালামাল অযতœ অবহেলায় বিলীন হওয়ার পথে। পোকা খেয়ে শেষ করছে লাইব্রেরীর মূল্যবান বইপত্র। কর্মকর্তা-কর্মচারিরা প্রায় এক যুগ ধরে বিনা বেতনেই আগলে রেখেছেন এর যাবতীয় অবকাঠামো। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষেরও যেন নেই কোন মাথা ব্যথা। 

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, বাংলা সাহিত্যে দেশের গৌরবদীপ্ত এবং সবচে বড় প্রকাশনা সংস্থা বাংলা একাডেমি, সেই একাডেমির প্রকাশিত কোন বই-ই এখন এই পাঠাগারে নেই। এমনকি এই কেন্দ্রে নেই রোকেয়ার কোন রচনাবলী, এমনকি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে নিয়ে লেখা কোন বইও।

সমাজ পরিবর্তনে পুরুষের রক্তচক্ষু শাসিত শত বাঁধা বিঘ্ন পেরিয়ে যে মহীয়সী রংপুরের এই অজপাড়াগাঁ-পায়রাবন্দ থেকে জ্বালিয়েছিলেন নারী শিক্ষার আলো, যে পায়রাবন্দ থেকে সমাজের যত অনাচার কুসংস্কার দূর করে জগৎখ্যাত হয়েছিলেন তিনি, তাঁর সে স্বপ্ন-স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে যেখানে গড়ে উঠেছিল এ কেন্দ্রটি, তার এ বেহাল দশায় উদ্বিগ্ন পুরো দেশবাসী। অবিলম্বে তারা এ স্মৃতি কেন্দ্রকে রাহুমুক্ত করে এর কার্যক্রম চালুর দাবি তুলেছে।

রোকেয়ার স্মৃতিকে ধরে রাখতে পায়রাবন্দে স্মৃতি কেন্দ্র স্থাপন, তার নামে একটি মহিলা ক্যাডেট কলেজ স্থাপনসহ নানা দাবি ছিল এ অঞ্চলবাসীর দীর্ঘদিনের। ’৯৬ সালে তৎকালীণ সরকার রোকেয়ার জীবন ও সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে গবেষণা, তাঁর আদর্শে নারী সমাজকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই ‘রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র’ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। স্মৃতি কেন্দ্রে গড়ে তোলা হয় সেমিনার কক্ষ, ২৫০ আসনের মিলনায়তন, আর্কাইভ, গবেষণা কেন্দ্র, নামাজ ঘর, রোকেয়া ও তাঁর উত্তরসূরীদের ব্যবহৃত জিনিসপত্রের একটি জাদুঘর, সংগ্রহশালা, দেশি বিদেশী পর্যটকদের জন্য অতিথিশালা, কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য কোয়ার্টার, ভাষ্কর্য এবং আকর্ষণীয় একটি তোরণ। এখান থেকে রোকেয়ার উপর ফেলোশীপ প্রদানেরও ব্যবস্থা ছিল।

২০০১ সালের ১ জুলাই তৎকালীণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করেন এবং কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে তত্ত্ববধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা এ কেন্দ্রটিকে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করে। সে থেকেই এর কার্যক্রমে নেমে আসে স্থবিরতা। একে একে তুলে নেওয়া হয় কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ লোকবল।

কেন্দ্রটিকে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা প্রসঙ্গে তৎকালীণ বাংলা একাডেমির মহা-পরিচালক ড. সাহেদ জানিয়েছিলেন, যেহেতু বিষয়টি নারী সংশ্লিষ্ট এটি একটি কারণ, অন্যটি হলো, অর্থাভাবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অনেক কাজ করতে পারে না বলেই মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রকল্পটিকে ন্যস্ত করা হয়েছে। তবে এ প্রসঙ্গে রোকেয়ার তথ্য সংগ্রাহক ও স্মৃতি কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল জানান, শিক্ষা ও সংস্কৃতির পাদপীঠ কেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে নেওয়া হবে?

তিনি বলেন, বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে রাজবাড়িতে ‘মীর মোশাররফ স্মৃতি কেন্দ্র’ নামে আরও একটি প্রকল্প রযেছে, সেটিকে তো অন্য কোন মন্ত্রণালয়ে নেয়া হয়নি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনেই তার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

দুলাল আরও বলেন, একজন লেখক কিংবা মনীষির কোন জেন্ডার নেই। নারী পুরুষের ভেদাভেদ ও বৈষম্য ভুলে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় যে রোকেয়া সমাজ থেকে দূর করেছেন অনাচার আর কুসংস্কার তিনি নিজেই আজ সেই বৈষম্যের শিকার। আক্ষেপ করে তিনি আরও জানান, মহিলা বলে এবং মহিলাদের নিয়ে কাজ করেছেন বলেই যদি এই স্মৃতি কেন্দ্রটি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে হয়, তবেতো ররীন্দ্রনাথ, নজরুল, মীর মোশাররফ, লালন সাঁই এঁদের জন্যও পুরুষ বিষয়ক মন্ত্রণালয় খোলা দরকার।

২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারিং ইর্ম্পোটার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) আয়োজনে এ কেন্দ্রে চালু করা হয় গার্মেন্টেস প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের। তখন প্রশ্ন ওঠে, শুধুমাত্র গার্মেন্টস প্রশিক্ষণ দিয়েই কী রোকেয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন আর স্মৃতি কেন্দ্র স্থাপনের উদ্দেশ্য সফল হবে ? যে কারণে কেউই শিক্ষা সংস্কৃতির পাদপীঠ রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রে গার্মেন্টেস প্রশিক্ষণের বিষয়টিকে তারা ভালভাবে মেনে নেয়নি।

বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল জানান, ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্থানীয় বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের প্রচেষ্টায় এবং বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ এই গার্মেন্টস প্রশিক্ষণের বৈধতা নিয়ে এবং কেন তা স্থগিত করা হবে না জানতে চেয়ে হাইকোর্টে রীট করলে হাইকোট ২০১২ সালের মে মাসে ওই গার্মেন্টেস ফ্যাক্টরি উচ্ছেদের আদেশ দেন। তিনি জানান, রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাই হয়েছে শুধুমাত্র শিক্ষা সংস্কৃতি ও নারী তীর্থ কেন্দ্র হিসেবে।

রোকেয়ার উত্তরসূরী বৈমাত্রেয় ভাইয়ের মেয়ে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা রঞ্জিনা সাবের চৌধুরী জানালেন, যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে স্মৃতি কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা তার কী বাস্তবায়ন হবে না? কেন স্মৃতি কেন্দ্রের কার্যক্রম চালু হচ্ছে না এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল ফারুক জানান, এটি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বিষয়। তিনি জানান, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা এই কেন্দ্রকে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করার প্রক্রিয়া নেওয়া হলে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে তিনিসহ ২ কর্মকর্তা হাইকোর্টে একটি রীট করেছিলেন। তাতে তারা স্মৃতি কেন্দ্রটিকে যেন অন্য কোন মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তর না করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনেই চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন জানান। পরে এই রীটের প্রেক্ষিতে হাইকোট ২০১৫ সালে বাদীদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তর ও কেন্দ্রটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে নেয়া এবং এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পক্ষে রায় দেন। পরবতীতে সরকার পক্ষ মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে আপীল করলে আপীল বিভাগও সরকারের আবেদন খারিজ করে দেন।

পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে স্মৃতি কেন্দ্রটিকে আবারও বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবাধানে সংস্কৃতি বিয়য়ক মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করার নির্দেশ দেন। এরপর ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমির কাছে পুনরায় ন্যন্ত করার পরও বাংলা একাডেমি আজও কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেননি।

জানা গেছে, বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র পাঠাগারে ২০১৭ সালের মামলার ওই বাদী ২ কমকর্তার চাকরি বাংলা একাডেমিতে আত্মীকরণ করা হলেও অন্যান্যদের করা হয়নি। ফলে ২০১৭ সাল থেকে ২ কর্মকর্তা বেতন পাচ্ছেন। তবে হাইকোট এবং আপীল বিভাগের রায় অনুসারে তারা এখনো বকেয়া বেতন ভাতাদি পাননি। বাকী ২ কমচারিকে মাসিক ৯ হাজার টাকার চুক্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আর অন্যদের কোন সুরাহ হয়নি। তারা না পারছেন চাকরি ছেড়ে চলে যেতে না পারছেন ধরে রাখতে।

(এমএস/এসপি/ডিসেম্বর ১০, ২০১৯)

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test