E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

উজিরপুরে কথিত চিকিৎসকের অপচিকিৎসা থামছেই না

২০২০ জানুয়ারি ২৯ ১৮:১১:৩৯
উজিরপুরে কথিত চিকিৎসকের অপচিকিৎসা থামছেই না

আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : এইচএসসি ও এমবিবিএস পাসের জাল সনদপত্র দিয়ে বছরের পর বছর ধরে ভুয়া এমবিবিএস চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে অসহায়, হতদরিদ্র রোগিদের সাথে প্রতারনার মাধ্যমে অপচিকিৎসা দিয়ে আসছেন রেজাউল করিম নামের এক কথিত চিকিৎসক। রেজাউল করিম বরিশালের উজিরপুর উপজেলার পশ্চিম সাতলা গ্রামের মৃত আদম আলী সরদারের পুত্র।

ভূক্তভোগীরা জানান, কখনো সে এমবিবিএস চিকিৎসক, কখনো সে সাংবাদিক, আবার টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক কিংবা ঢাকা এবং বরিশাল শহর থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকার মালিক ও প্রকাশক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করে নিচ্ছেন।

ভুয়া এমবিবিএস ডাক্তার রেজাউল করিমের অপচিকিৎসার স্বীকার ভূক্তভোগি ও বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, উজিরপুর উপজেলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী ও কোটালীপাড়া উপজেলার পুর্ব দক্ষিণ সীমান্তের পশ্চিম সাতলা গ্রামে গড়ে তোলা হয়েছে “মায়ের দোয়া ক্লিনিক এন্ড ডিজিটাল ডায়াগনষ্টিক সেন্টার”। ওই সেন্টারে বসে বছরের পর বছর ধরে চলছে গ্রামগঞ্জের সাধারণ রোগিদের অপচিকিৎসা। স্থানীয় কতিপয় দালালের মাধ্যমে সাধারণ রোগিদের ওই ক্লিনিকে এনে নানা কৌশলে অপচিকিৎসার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে মোটা অংকের টাকা। ওই ক্লিনিকে রেজাউল করিম রোগিদের ভর্তি করে একেকজন রোগির স্বজনদের কাছ থেকে চিকিৎসার ব্যয় বাবদ ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছেন। এভাবেই প্রতারক রেজাউল ইতোমধ্যে কয়েক কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন।

সূত্রমতে, ওই ক্লিনিকে রোগিদের ভর্তির পরে চিকিৎসা প্রদান বা জটিল অপারেশন করে ডায়েরীতে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়। ফলে তার কোন প্রমান থাকেনা। একইসাথে রোগিদেরকেও কোন প্রমানপত্র দেওয়া হয়না। পশ্চিম সাতলা গ্রামের পাশ্ববর্তী পিরোজপুরের নাজিরপুর, পদ্মডুবি, তরুর বাজার, স্বরূপকাঠী, ইলুহার, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া, টুঙ্গিপাড়া উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাম থেকে দালালের মাধ্যমে রোগি এনে ভর্তি করা হয় কথিত চিকিৎসক রেজাউলের মায়ের দোয়া ক্লিনিকে। তারপরেই শুরু হয় রোগিদেরকে তার অপচিকিৎসা দেওয়ার কাজ।

রেজাউল করিমের অপচিকিৎসার স্বীকার হয়ে বিভিন্ন সময় যাদের জীবনহানি ঘটেছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হলেও প্রভাবশালী রেজাউল সেসব মামলা থেকে অর্থের জোরে নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছেন।

বানারীপাড়া উপজেলার ইলুহার গ্রামের দিনমজুর ফোরকান মিয়া জানান, তার ছয় বছরের অসুস্থ্য শিশুপুত্র হাসানকে গত ২৩ জুন রেজাউল করিমের মায়ের দোয়া ক্লিনিকে নিয়ে আসা হয়। পরবর্তীতে ১৮ হাজার টাকার চুক্তিতে রেজাউল করিম হাসানকে চিকিৎসা করাতে রাজি হয় এবং তার ক্লিনিকে হাসানের পায়ুপথে ছুরি ও এসিড জাতীয় পদার্থ দিয়ে অপারেশনে করে। এতে শিশু হাসান চিরতরে তার পায়ুপথের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে এবং জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে চলে যায়।

এ অবস্থায় তিনি তার সহায় সম্বল খুঁইয়ে হাসানকে ঢাকার শিশু হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে হাসানের পেট কেটে বিকল্প উপায়ে পায়ুপথ তৈরী করতে হয়েছে। এ ঘটনার পর তিনি (ফোরকান মিয়া) ভুয়া চিকিৎসক রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে বরিশাল চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আমলী আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন।

মামলাটি তদন্তের জন্য আদালত উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশ পেয়ে উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ শওকত আলী ও ডাঃ মোঃ মাকসুদুর রহমান তদন্ত করে আদালতে রির্পোট দাখিল করেন।

ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় রেজাউল করিম পিচব্লেন্ড ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস (এস) ডিগ্রী অর্জন করেছেন বলে দাবী করেন। কিন্তু বাংলাদেশে মেডিকেল প্রাকটিসের লাইসেন্স প্রদানের একমাত্র আইনগত সংস্থা বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)’র প্রদত্ত কোন রেজিষ্ট্রেশন বা সনদপত্র দেখাতে পারেননি। অন্যদিকে “পিচব্লেন্ড ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি” নামক প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনেরও অনুমোদনকৃত নয়।

ভূক্তভোগীদের মধ্যে সাতলা গ্রামের বেনজির বালী অভিযোগ করে বলেন, তার বাবা লতিফ বালীকে রেজাউল ডাক্তার অপচিকিৎসা দিয়ে প্রায় মেরেই ফেলেছিলো। পরবর্তীতে ঢাকায় ল্যাব এইড হাসপাতালে নিয়ে তার বাবার জীবন ফিরে পেতে হয়েছে। তাছাড়া নয়াকান্দি গ্রামের মতলেব হাওলাদার, ফরাজী বাড়ির শাহজাহান সরদার, রাজাপুরের নুরু হাওলাদারসহ অনেক রোগি ভুয়া চিকিৎসক রেজাউল করিমের অপচিকিৎসায় মৃত্যুবরন করেছেন। এসব মৃত্যুবরনকারী রোগিদের পরিবারের লোকজন অসচ্ছল হওয়ার কারনে রেজাউলের বিরুদ্ধে কোন আইনী পদক্ষেপে গ্রহণ করতে পারেননি।

তথ্যমতে, ভুয়া ডাক্তার রেজাউল করিম ২০০৩ সালে আগৈলঝাড়া উপজেলার বাগধা দাখিল মাদ্রাসা থেকে জিপিএ-৩ পয়েন্ট পেয়ে দাখিল পাশ করেন। দাখিল পাশ পর্যন্তই তার শিক্ষা জীবন। এরপর সে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৭ সালে একটি এইচএসসি পাসের জাল সনদপত্র তৈরি করেন। রেজাউল করিম উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এইচএসসি পাসের যে সনদপত্রটি বিভিন্ন দপ্তরে দাখিল করেছেন তাতে দেখা যায় স্টুডেন্ট আইডি নম্বর ০৪-০-১১-১৬৫-০২৩।

অন্যদিকে বাংলাদেশে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৭ সালে ০৪-০-১১-১৬৫-০২৩ আইডি নম্বরে মানিকগঞ্জের মতিলাল ডিগ্রী কলেজ থেকে জিপিএ ১.৮৫ পেয়ে বৈধভাবে এইচএসসি পাশ করেছেন মোহাম্মদ মোশারেফ হোসাইন নামের এক ব্যক্তি। তার পিতার নাম এমডি মনির উদ্দিন এবং মাতার নাম শাহেরা বেগম। উল্লেখিত সনদপত্রে রেজাউল করিমের মায়ের নাম কোথাও লেখা নেই।

এছাড়া তার এমবিবিএস সনদপত্রসহ অন্যান্য সনদপত্রে চার্টার অফ অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল অফ ইন্ডো এ্যালোপ্যাথি এন্ড কমপ্লিমেন্টারি মেডিসিন, ৯৭/৬বি, হাজরা রোড কোলকাতা ২৬, ঠিকানা থেকে এসব সনদপত্রগুলো সে সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু ভারতের পশ্চিমবঙ্গে উল্লেখিত ঠিকানায় একাধিকবার তল্লাশী করেও এ নামের সনদপত্র প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ একেএম সামসুদ্দিন বলেন, রেজাউলের বিরুদ্ধে অসহায় সাধারণ মানুষকে অপচিকিৎসা দেওয়ার একাধিক অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিতে গেলেই তার বড় ভাই মাওলানা রুহুল আমিন রাজনৈতিক প্রভাববিস্তার করে বিভিন্নভাবে হয়রানী করে আসছে। তবে র‌্যাব-৮ এর চৌকস সদস্য ও দুর্নিতী দমন কমিশন চাইলেই তদন্ত সাপেক্ষে রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।

এ ব্যাপারে বরিশালের সিভিল সার্জন মোঃ মনোয়ার হোসাইনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, গত এক বছরে পশ্চিম সাতলা গ্রামের মায়ের দোয়া ক্লিনিকের মালিক রেজাউল করিমের নামে একাধিক অভিযোগ পেয়ে দুইবার আমি নিজে সেখানে তদন্তে গিয়েছি। তার সকল সনদপত্র পরীক্ষা নিরিক্ষা করে তা ভুয়া বা জাল বলেই প্রাথমিকভাবে প্রমানিত হয়েছে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করলেই বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখিন হতে হচ্ছে। তবে সে কোনমতেই এমবিবিএস তো দুরের কথা, কোন হাতুরে ডাক্তার হবারও যোগ্য নয় বলেও সির্ভিল সার্জন উল্লেখ করেন।

অভিযুক্ত রেজাউল করিমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের হুমকি দিয়ে বলেন, দেশে এমন কোন সংস্থা নেই যে, রেজাউল ডাক্তারের কিছু করবে। রেজাউল ডাক্তার সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অনুমতি নিয়েই এখানে ক্লিনিক তৈরী করে ডাক্তারী করছে, ফলে তার বিরুদ্ধে এক মাস সংবাদ প্রকাশ করেও কোন লাভ হবেনা।

(টিবি/এসপি/জানুয়ারি ২৯, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test