E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

করোনা আতঙ্কে গোটা বরিশাল হোম কোয়ারেন্টিনে

২০২০ মার্চ ৩১ ১৮:০৪:৪২
করোনা আতঙ্কে গোটা বরিশাল হোম কোয়ারেন্টিনে

আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : রাস্তাঘাট জনমানব শুন্য। যানবাহন ও পথচারীদের কোলাহল নেই। এ যেন ‘ভূতুড়ে শহর’ এ পরিণত হয়েছে একসময়ের ব্যস্ততম ও কোলাহলের বরিশাল শহর। করোনাভাইরাসের আতঙ্কে নিশ্চুপ হয়ে গেছে শহরসহ গোটা বরিশাল জেলা। অনেকেই শহর ছেড়েছেন। যারা আছেন তারা শহরে ঘরবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। বিশেষ কোন প্রয়োজন ছাড়া তারা কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।

তবে জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন কাউকে কাউকে বাসা থেকে বের হতে হচ্ছে। তবে অলিগলিতে কোথাও কোথাও কিশোর-তরুণদের আড্ডা দেখা গেছে। করোনাভাইরাস বিস্তার ঠেকাতে নগরীর স্কুল-কলেজ, দোকানপাট, শপিংমলের অধিকাংশই বন্ধ রয়েছে। বিভাগীয় শহর বরিশাল থেকে প্রকাশিত প্রায় ৩৬টি দৈনিক পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ রাখা হয়েছে। মূল সড়কগুলোতে র‌্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর টহল চলছে। এদিকে নগরীর ৩০টি ওয়ার্ড ও ২২৫টি মহল্লার ৫৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা ও বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের তিনটি থানা নিয়ে সিটি কর্পোরেশন গঠিত। ২০১১ সালের আদমশুমারি বলছে প্রশাসনিক এই এলাকায় ৩ লাখ ২৮ হাজার ২৭৮ জন মানুষ বসবাস করেন। আর কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, বিগত ৯ বছরে জনসংখ্যা বেড়ে পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে।

এতো মানুষের এ শহরে আজ আতঙ্কের নাম করোনা ভাইরাস। কোভিড-১৯ এর বিস্তার ঠেকাতে কার্যত অবরুদ্ধ নগরীর বাসিন্দাদের জীবন-যাপন বদলে যাচ্ছে। পরিবর্তন এসেছে প্রাত্যহিক কাজেও। অনেকেই ঘরে বসে কাজ করার পদ্ধতিতে খুশিও হতে পারছেন না। নিত্যপণ্যের বাজারের জন্য অনেকে ঝুঁকেছেন অনলাইন শপের দিকে। পাড়ায়-পাড়ায় মাইকে চলছে করোনা সতর্কতার বার্তা প্রচার।

করোনাভাইরাসের ছোবলে সারাবিশ্ব যখন কাঁপছিল, তখনও বাংলাদেশের জনজীবন ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু মাত্র কয়েকদিনেই পাল্টে গেছে চিত্র। স্তব্ধ জীবনে এখন নানা শঙ্কা আর অস্বস্তির উঁকিঝুঁকি। বিশ্বের অন্যতম ঘণবসতিপূর্ণ এই দেশে অতি সংক্রামক এই ব্যাধি বাংলাদেশে ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পরলে কী পরিণতি ঘটবে-তা নিয়ে সবার মধ্যে রয়েছে উদ্বেগ-আতঙ্ক।

বরিশাল লঞ্চ টার্মিনালের কুলি মহসিন বলেন, নগরী এখন একটা ভূতুড়ে শহর। করোনাভাইরাস আমাদের জন্য ভয়ঙ্কর এক অবস্থা তৈরি করেছে। মানুষজন তাদের ঘরে ঘরে বন্দি, কোনো মানুষ রাস্তায় নেই। লঞ্চঘাট বন্ধ রয়েছে। আমার মতো কোনো কুলিও এখন আর যাত্রীর অপেক্ষায় লঞ্চঘাটে বসে নেই।

নগরীর নতুনবাজার এলাকার বাসিন্দা আসাদ রহমান বলেন, করোনার খবর শুনে শহরজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সবাই সাবধানে থাকছি। ঘরে কোনো খাবার নেই। নিরূপায় হয়ে বের হয়েছি। কিন্তু আমি নিশ্চিত নই যে, আদৌ বাজারগুলোতে সব পন্য পাবো কিনা। সবকিছু বন্ধ থাকলেও ফার্মেসিগুলো খোলা রেখেছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। জেলখানার মোড় এলাকার এক ফার্মেসি মালিক বলেন, করোনার প্রচন্ড ভয় নিয়ে আমরা কাজ করছি। সরকারের নির্দেশ না থাকলে ফার্মেসি বন্ধই রাখতাম। আমাদের এখন ভাগ্যের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। তিনি বলেন, এখন সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে মাস্ক। এছাড়া অনেকেই ব্যাকটেরিয়া রোধক, অ্যালকোহল এবং ব্লিচিং পাউডার কিনে মজুদ করে রাখছেন। চৌমাথা এলাকায় দাঁড়ানো দুটি রিকশার ওপর পা ছড়িয়ে বসেছিলেন দুইজন চালক।

আবুল হোসেন নামের এক চালক বলেন, ভোর ছয়টার সময় বের হয়েছি। এখন বাজে একটা। ভাড়া নিছি মাত্র দুইটা। ৭০ টাকা। সারাদিনে ১০০ টাকা ভাড়া মারতে পারবো বলে মনে হচ্ছেনা। এতে গ্যারেজের ভাড়াও উঠবে না। অপর রিকশাচালক খায়রুল আলম বলেন ভিন্ন সমস্যার কথা। সে বলেন, রাস্তার পাশের চায়ের দোকানগুলো পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছে। সেখানে লোকজন জড়ো হয় বেশি। একটা ভাড়া মারলে এককাপ চা খাইতে হয়। পানি খাইতে হয়। গরম পড়তেছে। রিকশা চালামু ক্যামনে? শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে হঠাৎ আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তাটাই বেশি।

নগরীর পলিটেকনিক কলেজ এলাকার বাসিন্দা শ্রমিক নাজমা বেগম বলেন, দেশে যা শুরু হইছে এতে ছোট বেলায় মুরব্বিগো মুখে একটা কথা শুনতাম “চাচা আপন প্রান বাঁচা”। সেই কথার বাস্তব রূপ দেখছি এখন। যে যার জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত। কোন কাজ নেই। কি করে সংসার চলবে জানিনা। ঘর থেকে বের না হতে ঘোষণা দিয়ে চলছে মাইকিং। এরমধ্যে শহরে ভিক্ষা করতে বের হয়েছেন বৃদ্ধ আব্দুল লতিফ। ফাঁকে কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, বাড়িতে স্ত্রী ও এক প্রতিবন্ধী ছেলে রয়েছে। তাদের জন্য তিনি ভিক্ষা করতে বের হয়েছেন। এটাই তার পেশা। ঘরে বসে থাকলে একবেলার খাবারও জুটবে না। রোগে মরার চেয়ে পেটের ক্ষুধার জ্বালায় মরা অনেক বেশি কষ্টের। তাই তিনি ঘর থেকে বের হয়েছেন।

ফাঁকা শহরে টহল দিচ্ছে র‌্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা। কেউ কেউ সুরক্ষার পোশাকে, কেউ আবার সাধারণ ইউনিফর্মে। জেলা প্রশাসনের ম্যাজিষ্টেটরা সেনাবাহিনীকে নিয়ে নগরীর বিভিন্নস্থানে বিদেশ ফেরত ব্যক্তিদের হোম কোয়ারেনটাইনের বিষয়টি তদারকি করছেন। র‌্যাব, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও ম্যাজিষ্ট্রেটের পাশাপাশি নগরীতে সক্রিয় ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সংস্থা।

বরিশাল মেট্রোপলিটন প্রেসক্লাবের সভাপতি আলহাজ মোঃ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ২০২০ সালের এই মার্চ ও ১৯৭১ সালের সেই মার্চ এ যেন একাত্তরের বাংলাদেশ, সকলের সচেতনতার মাঝে একযোগে লড়তে গিয়ে এমন মৃত্যুপুরীর নগরী খুব অচিরেই চিরচেনা রূপে ফিরে আসবে এমন প্রার্থনাই করছি সৃষ্টিকর্তার কাছে।

জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান বলেন, সকলের সচেতনতার মাঝে করোনা প্রতিরোধে ঘরে বন্দি দিনমজুর, দুঃস্থ ও অসহায় পরিবারের কেউ না খেয়ে থাকবেন না। এ জন্য জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার খাদ্যসামগ্রী ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। দেশের স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে না আসা পর্যন্ত এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।

(টিবি/এসপি/মার্চ ৩১, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test