E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

টাঙ্গাইলে করোনায় লক্ষাধিক তাঁত শ্রমিক কর্মহীন, ত্রাণের জন্য হাহাকার

২০২০ এপ্রিল ০৭ ১৭:৩৬:০৫
টাঙ্গাইলে করোনায় লক্ষাধিক তাঁত শ্রমিক কর্মহীন, ত্রাণের জন্য হাহাকার

রঞ্জন কৃষ্ণ পন্ডিত, টাঙ্গাইল : করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারি লক ডাউনের ঘোষণায় টাঙ্গাইল শাড়ির গৌরবে ধন্য জেলার এক লাখ তিন হাজার ২০৬জন তাঁত শ্রমিক কর্মহীন হয়ে ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে। এছাড়া চার হাজার ১৫১জন ক্ষুদ্র তাঁত মালিকও করোনা ভাইরাসের কারণে লক ডাউনে থাকায় খাদ্য সঙ্কটে ভুগছে। এর মধ্যে মাত্র আড়াইশ’ শ্রমিককে সরকারি ত্রাণের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তাঁত বোর্ড নিয়ন্ত্রিত জেলার দুটি বেসিক সেন্টার সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।

জানা গেছে, টাঙ্গাইল জেলায় তাঁত শিল্প ও তাঁতীদের উন্নয়নের জন্য দুটি বেসিক সেন্টার রয়েছে। এরমধ্যে কালিহাতী, ভূঞাপুর, ঘাটাইল, গোপালপুর, মধুপুর ও ধনবাড়ী উপজেলার জন্য কালিহাতীর বল্লায় একটি এবং সদর, দেলদুয়ার, নাগরপুর, বাসাইল, সখীপুর, মির্জাপুর উপজেলার জন্য টাঙ্গাইল শহরের বাজিতপুরে একটি বেসিক সেন্টার রয়েছে। দুটি বেসিক সেন্টার থেকে তাঁতীদের মাঝে বিতরণকৃত ৮ কোটি ৬৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকার ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত রাখা হয়েছে। এছাড়া তাঁত বোর্ডের চলতি মূলধন সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় এক কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণ হিসেবে ৬৪জন তাঁতীকে গেল মার্চ মাসে দেওয়া হয়েছে।

তাঁত বোর্ডের বেসিক সেন্টারের কর্মকর্তা, তাঁত মালিক, তাঁত শ্রমিক ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, একটি তাঁতে ন্যূনতম তিনজন নারী-পুরুষ প্রত্যক্ষভাবে শ্রম দিয়ে থাকেন। একজন তাঁতে কাপড় বুনে, একজন কাপড় বুননের সুতা(নলি বা ছিটা) প্রস্তুত করেন, একজন কাপড়ের নকশার সুতা কটেন(ড্রপ কাটা)। এছাড়া সুতা রঙ করা, শুকানো, পাটিকরা, তানার সুতা কাটা, ড্রাম থেকে ভিমে সুতা পেঁচানো, তানা সাজানো, মালা বা নকশার ডিজাইন তোলা, কাপড় ভাঁজ করা, পেটি করা এবং বাজারজাত ও আনা-নেওয়ার জন্যও শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। অধিকাংশ ক্ষুদ্র তাঁত মালিক নিজেরা প্রয়োজন অনুযায়ী শ্রম দিয়ে থাকেন। কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শ্রম দেন। তাঁত শিল্পের শ্রমিকদের প্রতি সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে মজুরি দেওয়া হয়।

তাদের সাথে কথা বলে আরো জানাগেছে, টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পে শ্রম দেওয়া তাঁতীদের মধ্যে প্রায় ৫০শতাংশ সিরাজগঞ্জ, পাবনা, কুড়িগ্রাম ইত্যাদি জেলার বাসিন্দা। গত ২৬ মার্চ থেকে সরকারিভাবে লক ডাউন ঘোষণার পর থেকে জেলার সকল তাঁত ফ্যাক্টরী বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে এক লাখ তিন হাজার ২০৬জন তাঁত শ্রমিক এবং চার হাজার ১৫১জন ক্ষুদ্র তাঁত মালিক বেকার হয়ে পড়েন। বেকার হওয়া তাঁত শ্রমিকদের প্রায় অর্ধাংশ যার যার বাড়িতে চলে গেছেন। রয়ে যাওয়া শ্রমিকরা বাড়িতে অবস্থান করে সরকারি নির্দেশনা পালন করছেন। তাদের ঘরে এক সপ্তাহের খাবার থাকলেও তা শেষ হয়েছে। বর্তমানে অধিকাংশ তাঁত শ্রমিক একবেলা-দু’বেলা আধপেটা খেয়ে জীবন ধারণ করছেন। পরিবারের শিশুদের কোন আবদারই অভিভাবকরা রাখতে না পেরে চোখের পানি ফেলছেন।

তাঁত বোর্ডের কালিহাতী বেসিক সেন্টারে ১৭টি প্রাথমিক তাঁতী সমিতির এক হাজার ৮৮৪জন ক্ষুদ্র তাঁত মালিকের ২১ হাজার ৯৭৩টি তাঁত রয়েছে। প্রতি তাঁতে তিনজন শ্রমিকের হিসেবে ৬৫ লাখ ৯১৯জন শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। টাঙ্গাইল সদর (বাজিতপুর) বেসিক সেন্টারে ৩২টি প্রাথমিক তাঁতী সমিতির দুই হাজার ২৬৭ জন ক্ষুদ্র তাঁত মালিকের ১২ হাজার ৪২৯টি তাঁত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ৩৭ হাজার ২৮৭জন শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন।

কালিহাতী উপজেলার বল্লা, রামপুর, মমিননগর, কোকডহড়া, দত্তগ্রাম, বেহেলা বাড়ী, ঘোণাবাড়ী, ছাতিহাটি, তেজপুর, কাজীবাড়ী; দেলদুয়ার উপজেলার চন্ডি, পাথরাইল, পুটিয়াজানী, রূপসী, সদর উপজেলার চরকাকুয়া, চরপৌলী, হুগড়া ইত্যাদি এলাকার তাঁত শ্রমিকরা জানান, করোনা ভাইরাসের কারণে সরকারি নির্দেশনা মেনে গত দুই সপ্তাহ যাবত তারা বাড়িতে অবস্থান করছেন। তাদের অধিকাংশের ঘরে এক সপ্তাহের খাবার ছিল। এখন তারা কৃচ্ছতা সাধন করে কোন রকমে খেয়ে- না খেয়ে বেঁচে আছেন। শ্রমিকরা আরো জানায়, প্রশাসনের কর্মকর্তারা ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাদের লোকদেরকেই সরকারি ত্রাণ সাহায্য দিয়ে থাকেন। জনপ্রতিনিধিদের সাথে সম্পর্ক ভালো থাকলে কেউ কেউ সুবিধা পেলেও অধিকাংশই পাচ্ছেনা। তাঁতীরা সংখ্যালঘু হওয়ায় তারা সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে দাবি করেন।

কালিহাতী উপজেলার বল্লা ১নং প্রাথমিক তাঁতী সমিতির সভাপতি দুলাল হোসেন জানান, তার সমিতির সদস্য তিন হাজার ১০জন। দুই সপ্তাহ ধরে সকল তাঁত বন্ধ। তাঁতীদের প্রতি তাঁতে সপ্তাহে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় চার হাজার টাকা। এ অবস্থা বেশিদিন ছললে তাঁতীদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। তাঁত শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে থাকলেও তাঁত বোর্ডের বেসিক সেন্টার থেকে সরকারি ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছেনা। তাঁত শ্রমিকরা ত্রাণ সহায়তার জন্য হাহাকার করছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে যৎসামান্য ত্রাণ এনে তিনি শ্রমিকদের মাঝে বণ্টন করে দিয়েছেন। আরো কয়েক হাজার শ্রমিক চরম অভাব-অনটনে দিন কাটাচ্ছে।

বল্লা ইউপি চেয়ারম্যান হাজী চান মাহমুদ পাকির জানান, করোনা ভাইরাসের কারণে সব তাঁত ফ্যাক্টরী বন্ধ থাকায় হাজার হাজার তাঁত শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তাদের অনেকের ঘরে খাবার নেই, উপজেলা থেকে কোটা অনুযায়ী সরকারি ত্রাণ সহায়তা ইউনিয়ন পরিষদে আসে। সেখান থেকেও তিনি কিছু তাঁত শ্রমিকের মাঝে বণ্টন করে দিয়েছেন। তাঁত বোর্ডের বেসিক সেন্টার মাত্র ১৯জন তাঁত শ্রমিককে ত্রাণ সহায়তা দেওয়ায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
দেলদুয়ারের আটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার সিরাজুল ইসলাম মল্লিক জানান, সরকারি বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ইউনিয়নের ভাতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি ব্যতিত কর্মহীন শ্রমিকদের মাঝে ত্রাণ পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাঁত শ্রমিকরাও যথারীতি সরকারি ত্রাণ পাচ্ছে।

টাঙ্গাইল শাড়ির রাজধানী পাথরাইল শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক জানান, ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে তারা তাঁত শ্রমিকদের কিছু কিছু ত্রাণ সহায়তা দিয়ে বঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। প্রত্যেক শাড়ি ব্যবসায়ী ও ফ্যাক্টরী মালিককে তার শ্রমিকদের ব্যক্তিগতভাবে সহায়তা করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

তিনি আরো জানান, ক্ষুদ্র ও মাঝারী তাঁত শিল্পের মালিকরা সাধারণত ব্যাংকঋণ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে থাকেন। এ সঙ্কট কাটাতে সরকারের প্রণোদনায় তাঁত শিল্পকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান তিনি।

তাঁত বোর্ডের কালিহাতী বেসিক সেন্টারের ভারপ্রাপ্ত লিয়াজোঁ অফিসার ইমরানুল হক জানান, করোনার প্রভাবে তাঁত শিল্পে ধস নেমে আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বিপুল সংখ্যক তাঁত শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তাদের ঘরে খাবার নেই। ক্ষুদ্র তাঁত মালিকরা প্রতি সপ্তায় প্রতি তাঁতে চার হাজার টাকার ক্ষতির স্বীকার হচ্ছেন। তাদের ঋণের কিস্তি স্থগিত করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ১০০ জন তাঁত শ্রমিকের মাঝে কালিহাতী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় থেকে সরকারি ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তিনি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পরিস্থিতি অবহিত করেছেন। নির্দেশনা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

টাঙ্গাইল সদর (বাজিতপুর) বেসিক সেন্টারের লিয়াজোঁ অফিসার রবিউল ইসলাম জানান, কর্মহীন হয়ে পড়া তাঁত শ্রমিকদের জন্য আলাদা ভাবে কোন সরকারি ত্রাণ সহায়তা আসেনি। দেলদুয়ার ও সদর উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে স্থানীয় দেড়শ’ তাঁত শ্রমিককে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ইউপি চেয়ারম্যান ও জনপ্রতিনিধিরা তাঁত শ্রমিকদের মাঝে ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছেন। সরকারি প্রণোদনা না পেলে তাঁতীরা এ সঙ্কট মোকাবেলা করতে পারবে না বলে তিনি মনে করেন।

(আরকেপি/এসপি/এপ্রিল ০৭, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test