E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বঙ্গবন্ধুসেতুর পূর্বপাড়ে মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্বে ২৫০ কুলি মজদুর বেকার! 

২০২০ জুন ২৯ ১৩:৪০:৫৮
বঙ্গবন্ধুসেতুর পূর্বপাড়ে মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্বে ২৫০ কুলি মজদুর বেকার! 

রঞ্জন কৃষ্ণ পন্ডিত, টাঙ্গাইল : বঙ্গবন্ধুসেতুর পূর্বপাড়ে কুলি মজদুর ইউনিয়ন ও স্থানীয় ট্রাক মালিক সমিতির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে দীর্ঘ এক মাস ধরে ট্রাকে মালামাল লোড-আনলোড বন্ধ রয়েছে। ফলে প্রায় আড়াইশ’ শ্রমিক কাজ করতে না পেরে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। একই সাথে স্থানীয় অর্ধশত ট্রাক মালামাল পরিবহন করতে না পেরে অকেজো অবস্থায় রয়েছে। এতে আমদানী না পেয়ে ট্রাক মালিকরাও অসহায় হয়ে পড়েছে। 

জানা গেছে, বিগত ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধুসেতু চালু হওয়ার পর থেকে স্থানীয় কুলি মজদুররা বিচ্ছিন্নভাবে ট্রাকে মালামাল লোড-আনলোড করত। ১৯৯৮ সালে স্থানীয় পর্যায়ে কুলি মজদুর ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ সময় সেতুর পশ্চিম ও পূর্বপাড়ে বাসেক(বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ) এর পরিত্যক্ত জায়গায় কুলি মজদুর ইউনিয়নকে ট্রাক লোড-আনলোড করার মৌখিক অনুমতি দেয় বাসেক।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ওভারলোড ট্রাকগুলোর মালামাল সেতু পারাপারে নির্দিষ্ট ওজন ঠিক রাখতে ট্রাকের মালামাল লোড-আনলোডের প্রয়োজন হয়। ওভারলোডে আনা মালামাল আনলোড করে কমিয়ে সেতু পার হয়। পরে রেখে যাওয়া ওইসব মালামাল সেতু পারাপারের জন্য স্থানীয়ভাবে ট্রাকের প্রয়োজন হয়। সে লক্ষ্যে এলঅকার ধনাঢ্য ব্যক্তিরা ৫০টি ট্রাক কিনে স্থানীয় পর্যায়ে টাঙ্গাইল জেলা ট্রাক মালিক সমিতির শাখা প্রতিষ্ঠা করে। মালিক সমিতি প্রতিষ্ঠা করে ট্রাক মালিকরা একটি ‘কনসোর্টিয়াম’ গঠন করে এবং কুলি মজদুরদের কাছ থেকে প্রতিট্রাকে ২০০টাকা আদায় করেন।

সরেজমিনে জানা যায়, গত ২৬ মে ঈদুল ফিতরের দিন হওয়ায় ওভারলোড ট্রাকের মালামাল লোড-আনলোড করে কুলি মজদুররা ‘কনসোর্টিয়াম’ এর ২০০ টাকা না দিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। এতে ক্ষুব্দ হয়ে যমুনা শাখা ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি ও গোহালিয়াবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান ‘কনসোর্টিয়াম’ এর জন্য প্রতিট্রাক থেকে এক হাজার ২০০ টাকা করে দিতে হবে বলে ঘোষণা দেন। এ নিয়ে স্থানীয় ট্রাক মালিক সমিতি ও কুলি মজদুর ইউনিয়নের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। বিরোধ চরম আকার ধারণ করলে কুলি মজদুর ইউনিয়নের শ্রমিকরা ট্রাকের মালামাল লোড-আনলোড বন্ধ করে দেয়। ওই বিরোধের জের ধরে সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দেয়ায় বাসেক (বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ) তাদের জায়গায় ট্রাকের মালামাল লোড-আনলোড না করার জন্য এক নোটিশ জারি করে। লোড-আনলোড স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়ায় স্থানীয় কুলি মজদুররা বেকার হয়ে পড়েছে। একই সাথে স্থানীয় ট্রাকে মালামাল পরিবহন করতে না পারায় মালিকরা প্রতিদিনের আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ঊভয় পক্ষই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দুই সংগঠনের অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে। উভয় পক্ষই সংবাদ সম্মেলন করে পরস্পরের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ করে।

স্থানীয় কুলি মজদুর ইউনিয়নের সদস্য আব্দুল আজিজ, মো. মাজেদ মিয়া, মো. মোশারফ হোসেন সহ অনেকেই জানান, স্থানীয় ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি ও গোহালিয়াবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান হযরত আলী তালুকদার, ৭ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম তালুকদার, তার সহযোগী আল মামুন তালুকদার ও ইউপি চেয়ারম্যানের ম্যানেজার মো. লেবু সিকদার ‘কনসোর্টিয়াম’ প্রতিষ্ঠা করে তহবিল গঠনের নামে প্রতি ট্রাক লোড-আনলোড করতে ২০০ টাকা করে নিতেন। তারা খুশি মনে দিয়েও আসছিলেন। কিন্তু গত ঈদুল ফিতরের দিন কনসোর্টিয়ামের ২০০ টাকা কুলি মজদুররা না দেওয়ায় তারা প্রতি ট্রাক থেকে এক হাজার ২০০ টাকা করে দাবি করেন এবং কুলি মজদুরদের দিন হাজিরা হিসেবে ৩০০ টাকা করে নেওয়ার জন্য বলেন। এতে কুলি মজদুররা রাজি হয়নি। ফলে তারা ঈদুল ফিতরের পরদিন থেকে ট্রাক লোড-আনলোড বন্ধ করে দেয়।

কুলি মজদুররা আরো জানায়, তারা দীর্ঘদিন ধরে ট্রাকের মালামাল লোড-আনলোড করে সংসার চালান। পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালান। ইউপি চেয়ারম্যান একচেটিয়া ‘রাজত্ব’ করার জন্য কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। ঈদুল ফিতরের পরদিন থেকে লোড-আনলোড বন্ধ থাকায় তারা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।

যমুনা শাখা ট্রাক মালিক সমিতির উপদেষ্টা ও ইউপি সদস্য মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার, কোষাধ্যক্ষ হাজী আব্দুল বাছেদ আকন্দ, হাজী আ. রাজ্জাক প্রামাণিক, ট্রাক শ্রমিক লেবু সিকদার জানান, ওভারলোড ট্রাকের আনলোড করা মালামাল স্থানীয় ট্রাক দিয়ে সেতু পারাপারের জন্যই তারা জমি-জমা বিক্রি করে কিস্তিতে ট্রাক কিনেছেন। তারা লোড-আনলোড বন্ধ করেন নাই। লোড-আনলোড বন্ধ থাকায় তারা অনেকেই ট্রাকের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না।

স্থানীয় কুলি মজদুর ইউনিয়নের কুলি সর্দার আলী আকবর আকন্দ জানান, ট্রাকের পাথর, সিমেন্ট ও বালু লোড-আনলোড করা অনেক কঠিন কাজ। গোহালিয়াবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান ‘কনসোর্টিয়াম’ এর নামে সেখান থেকে টাকা নিয়ে থাকেন। ঈদুল ফিতরের পর তিনি প্রতিট্রাক থেকে এক হাজার ২০০টাকা দাবি করায় তারা দিতে রাজি হন নি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি ট্রাকের মালামাল লোড-আনলোড বন্ধ করে দিয়েছেন। স্থানীয় আড়াইশ’ কুলি মজদুরের কথা মানবিকভাবে বিবেচনা করে পুনরায় লোড-আনলোড চালু করার জন্য তিনি প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

স্থানীয় ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি ও ইউপি চেয়ারম্যান হযরত আলী তালুকদার বলেন, আমাদের ৫০টি ট্রাক রয়েছে। লোড-আনলোড না হওয়ায় ৫০টি ট্রাকই অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বঙ্গবন্ধুসেতু পূর্ব থানার পশ্চিমের মাঠে ট্রাকের মালামাল লোড ও আনলোডের কাজ আমি বন্ধ করি নাই। লোড ও আনলোডের কাজ চালু করার জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। তিনি আরো বলেন, কনসোর্টিয়ামের নামে কুলি মজদুরদের টাকা নেওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়।

বঙ্গবন্ধুসেতু পূর্ব থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কাজী আয়বুর রহমান জানান, কুলি মজদুর ইউনিয়ন ও ট্রাক মালিক সমিতির মধ্যে ওভারলোড ট্রাকের মালামাল লোড-আনলোডের টাকা নিয়ে বিরোধ চলছে। তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় উভয় পক্ষকে ধৈর্য্য ধরার অনুরোধ করেছেন। তাছাড়া ওই মাঠে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে বাসেক বঙ্গবন্ধুসেতু পূর্ব থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে।

বাসেক’র বঙ্গবন্ধুসেতু সাইট অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসানুল কবির বাপ্পী জানান, বাসেক’র জায়গায় লোড-আনলোড আইনত নিষিদ্ধ। পরিত্যক্ত থাকায় বঙ্গবন্ধুসেতু পূর্ব থানার পাশে কুলি মজদুররা ট্রাকের লোড-আনলোড করে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু বিরোধের জের ধরে সংঘর্ষের আশঙ্কায় সেখানে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে থানায় একটি জিডি করা হয়েছে।

(আরকেপি/এসপি/জুন ২৯, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

১৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test