E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

‘আমগরে নোক নাই, আমরা সায্যও পাইনে’

ঘরে ঘরে খাবার নেই, ত্রাণ সংকটে দিশেহারা বন্যাদুর্গতরা 

২০২০ জুলাই ১৮ ১৮:১৬:৫৪
ঘরে ঘরে খাবার নেই, ত্রাণ সংকটে দিশেহারা বন্যাদুর্গতরা 

রাজন্য রুহানি, জামালপুর : বন্যায় ভাসছে জামালপুর। দু’দফা বন্যায় ২৩ দিন ধরে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে জেলার ৬লাখ মানুষ। পানিবন্দীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র ত্রাণ সংকট। ত্রাণ না পেয়ে দিশেহারা বানভাসীরা ছুটছে দিগ্বিদিক। জেলা প্রশাসনের অপ্রতুল ত্রাণব্যবস্থা ও ধীর গতিতে এর কার্যক্রম চলায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সুধীজনরা।

যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে জামালপুর জেলার ৭টি উপজেলার ৫১টি ইউনিয়ন ও ৮টি পৌরসভার ৬২৫টি গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা এখন বন্যা কবলিত। এসব গ্রামের ২ লাখ ১৬ হাজার ৬’শ ৫৫টি পরিবার বন্যায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব পরিবার দু’দফা বন্যায় ২৩ দিন ধরে পানিবন্দী।

কথা হয় বানভাসী ৫০ বছর বয়সী সুফিয়া বেগমের সাথে। ইসলামপুর সদর উপজেলার শংকরপুরে তার বাড়িতে কোমর পানি। ডুবে গেছে উঠান, টিউবয়েল, রান্নাঘর এমনকি রান্না করার চুলাও। স্বামী আব্দুল করিম (৬৫) রিকশা চালিয়ে পরিবারের ৬ জনের মুখে আহার যুগাতো। বার্ধক্যের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ে এখন তিনি কর্মক্ষম। চেয়েচিন্তে মানুষের সহযোগিতায় দিন চলছিল। এখন সকলের একই অবস্থা। সুফিয়া বেগমের পরিবারকে সাহায্য করার কেউ নেই। দ্বিতীয় দফা বন্যায় সপ্তাহ ধরে বন্যার পানিতে ভাসলেও জুটেনি সরকারি-বেসরকারি সাহায্য-সহযোগিতা। কোমর পানিতে টিকে থাকার চেষ্টা করলেও পেট তো মানছে না সুফিয়া বেগমের পরিবারের লোকজনের। একবেলা আধপেটা খেয়ে কোনোমতে বেঁচে আছে তারা।

শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে সুফিয়া বেগম বলেন, বাবা পানিতে পইরা আছি ৭দিন ধইরা। মেম্বর চেয়ারম্যান কেউ আমগো খোঁজও নেই নাই। স্লিপ ছাড়া সাহায্য দেয় না। স্লিপের নিষ্টিতে নাম তুলতে নোক নাগে। আমগরে নোক নাই, আমরা সায্যও পাইনা। এর-উনু থাইক্যা চাইয়া নিয়্যা একবেলা আধাপেট খাই, কোনো সময় না খাইয়া দিন পার করতাছি। আমগরে সায্যর ব্যবস্থা কইরা দিয়ে জীবনডা বাছান।
কথা হয় একই ইউনিয়নের কাঁচিহারা মৃত আব্দুল করিমের ছেলে ৬০ বছর বয়সী মাঝি টল্লু মিয়ার সাথে। কথা বলতে

গেলেই ক্ষেপে উঠেন এই বৃদ্ধ। রাগান্নিত কন্ঠে বলেন, আফনেগরে সঙ্গে কতা কইয়া নাভ কি? আফনেরা আইছেন, ফটো তুলবেন, নিউজ করবেন, সরকার সায্য পাঠাবো, হেই সায্য চেরাম্যান-মেম্বাররা মাইরা খাবো। উচ্চস্বর নামিয়ে তিনি পরক্ষণেই বলেন, কী হুনবেন, ৫দিন ধইরা আমার বাড়িত পানি। ঘরে ৪ জন খাওইয়ে। ঘরে কোমর পর্যন্ত পানি। চকির পায়ার নিছে ইটের উপর ইট দিয়ে বউ পুলাপান নিয়া আছি। মাঝেমধ্যে পানির ধাক্কায় চহি নড়বড় করে। বাড়ি চারপাশেও পানি। খাইয়া না খাইয়া পইরা আছিলাম। আইজ বাইর ওইছি বউ পুলাপানের মুহে খাওন জুঠাতে। আরেক জনের নৌকা নিয়া মানুষ পারাপার করতাছি। মেম্বর চেরম্যান কি দেখবু গরিবেরে আল্লাও দেহেনা আক্ষেপের সুরে শংকরপুর অস্থায়ী নৌকা ঘাটে এসব কথা বললেন মাঝি টুল্লু মিয়া।

পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল একই গ্রামের আরেক বানভাসী মাসুদ রানা (২৬)। তিনি ঝালমুড়ি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে পরিবারের চারজনের ভরণপোষন যোগাতেন। চারপাশে পানি উঠায় ঝালমুড়ি বেচাবিক্রিও কমে গেছে। এক দেড়শ টাকা কামাই করাও কঠিন। চাল কিনলে সবজি কেনার টাকা থাকেনা হাতে। ঘরে পানির উপর মাচা করে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছে। সরকারি ত্রাণ রানা মিয়ার কপালেও জুটেনি।

সুফিয়া, টুল্লু মিয়া, মাসুদ রানার মতো ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলি, বেলগাছা, সাপধরী ও নেয়ারপাড়া ই্উনিয়নের বিভিন্ন বন্যা দুর্গত এলাকা ঘুরে বানভাসী মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেল ত্রাণ না পেয়ে পানিবন্দী মানুষের মানবেতর জীবনচিত্র।

বন্যা দুর্গত অধিকাংশ এলাকায় এখনও ত্রাণ পৌঁছেনি। পানিবন্দি বিশাল জনগোষ্ঠির সিংহভাগ মানুষ ত্রাণ না পেয়ে অনাহারে অর্ধহারে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ত্রাণের জন্য পানিবন্দীদের মাঝে শুরু হয়েছে হাহাকার। কিছু কিছু এলাকায় সরকারি ত্রাণ বিতরণের খবর পাওয়া গেলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল। প্রতিবারের বন্যার মতো এবার কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ত্রাণ কার্যক্রম এখনো চোখে পড়েনি। ফলে ত্রাণ সংকট দিন দিন বাড়ছেই। শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, পানিবাহিত রোগের ওষুধ ও গো-খাদ্যের অভাবে বন্যাদুর্গতরা চরম বিপাকে পড়েছেন।

বন্যাদুর্গত এলাকায় তীব্র ত্রাণ সংকট থাকলেও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ত্রাণের কোন সংকট নেই। পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদ রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সকল বন্যা দুর্গত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছে যাবে।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. নায়েব আলী জানিয়েছেন, জেলায় এ পর্যন্ত ৩১০ মেট্রিকটন চাল, নগদ ১২ লাখ টাকা ৫০ হাজার টাকা, ৪ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার এবং শিশু খাদ্যের জন্য ২ লাখ ও গো-খাদ্যের জন্য ২ লাখ টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে।

বন্যাকবলিত ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা বলছেন, বন্যাকবলিত মানুষের তুলনায় বরাদ্ধ খুবই কম পেয়েছি। যা প্রয়োজনের তুলায় খুবই অপ্রতুল। বরাদ্ধ বাড়লে ত্রাণ সংকট অনেকটাই কমে যাবে।

বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ইসলামপুরের চিনাডুলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আ. ছালাম ত্রাণ সংকট বিষয়ে বলেন, দুই দফায় বন্যা চলছে। আমার ইউনিয়নের পুরোটাই বন্যা কবলিত। এবার দ্বিতীয় দফায় ৩টন চাল বরাদ্ধ পেয়েছি। চল্লিশ হাজার শুধু ভোটারই। শিশু ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারীপুরুষ মিলে লোকসংখ্যা আরো তিনগুণ হবে। বন্যাকবলিত বিশাল জনগোষ্ঠির মাঝে বরাদ্ধের অল্প ত্রাণ দিয়ে কী হয়? কয়জনকে দিবো?

বরাদ্ধ বাড়ানোর দাবি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, বন্যা কবলিত লোকসংখ্যা হারে বরাদ্ধ বাড়লে ত্রাণ সংকট কমে যাবে।

সাপধরী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: জয়নাল আবেদিনও বলেছেন একই কথা। তিনি বলেন, আমার ইউনিয়নে ২০টি গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দী। প্রথম দফা বন্যায় ৬টন ও দ্বিতীয়দফা বন্যায় ২টন চাল পেয়েছি। এই অল্প ত্রাণ বন্যাদুর্গত সব এলাকায় দেয়া সম্ভব হয়নি।

(আরআর/এসপি/জুলাই ১৮, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test