E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বছরে চাঁদা আদায় ৫ কোটি টাকা

যমুনা সার কারখানায় বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ ডিলাররা 

২০২০ সেপ্টেম্বর ০১ ১৭:১৮:০৯
যমুনা সার কারখানায় বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ ডিলাররা 

রাজন্য রুহানি, জামালপুর : সার উত্তোলন ও পরিবহনে বেপরোয়া গতিতে চলছে চাঁদাবাজি। ডিলারদের কাছ থেকে বছরে প্রায় ৫ কোটি টাকা চাঁদা হাতিয়ে নেন ট্রাক মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। কোনো রাখঢাক নেই, যমুনা সার কারখানার কমান্ড এরিয়ায় ফ্রি স্টাইলে এ চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্যে ১৯ জেলার সার ডিলাররা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। চাঁদাবাজি বন্ধে ভুক্তভোগী ডিলাররা একাধিকবার প্রতিবাদসহ নানা পদক্ষেপ নিলেও চাঁদাবাজির সাথে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত প্রভাবশালী নেতাদের শক্তির কাছে ডিলাররা পেরে উঠছেন না। প্রশাসনের সহযোগিতা না পেয়ে নিয়মিত চাঁদা দিয়েই সার উত্তোলন ও পরিবহন করছেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ডিলাররা।

দেশের সর্ববৃহৎ দানাদার ইউরিয়া সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যমুনা সার কারখানা। এ কারখানা থেকে জামালপুর, শেরপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ছাড়াও উত্তরবঙ্গের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৯ জেলার বিসিআইসির তালিকাভুক্ত সার ডিলাররা সার উত্তোলন করে কৃষকদের মাঝে বিক্রি করেন। কারখানা থেকে প্রতিদিন এসব জেলায় শ শ মেট্রিক টন সার সরবরাহ হয়ে থাকে। সার কারখানা কেন্দ্রিক গড়ে ওঠে ট্রাক মালিক সমিতি, ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন ও ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি। আর এই সুযোগে বছরে প্রায় ৫ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে আসছে ট্রাক মালিক সমিতি, ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন ট্র্যান্সপোর্ট মালিক সমিতি। বোরো ও রোপা-আমন মৌসুমের ইউরিয়া সারের ব্যাপক চাহিদা থাকায় নানা অজুহাতে প্রভাবশালী এসব নেতারা মাসে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগি ডিলারদের।

সার ডিলার ও ট্যান্সপোর্ট এজেন্সির মালিকদের অভিযোগ, ট্রাক মালিক ও ট্রাক শ্রমিক নেতারা রাজনৈতিক ছত্রছঁায়ায় স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বেপরোয়া চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কোন ডিলার বা ব্যবসায়ী প্রতিবাদ করতে সাহস পান না। অনেক ডিলার তাদের চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানী স্বীকার এমন কি লাঞ্চিত হতে হয়েছে। এসব কারণে কারখানার কমান্ড এরিয়ার উত্তবঙ্গ ও জামালপুর জেলার বাইরে বিসিআইসির তালিকাভুক্ত ইউরিয়া সার ডিলাররা কারখানা থেকে সরাসরি সার উত্তোলন না করে ট্র্যান্সপোর্ট এজেন্সির মাধ্যমে যমুনার সার খারখানা থেকে সার উত্তোলন করে আসছে।

ডিলাররা জানিয়েছেন, এক ট্রাক অর্থাৎ ১২ মেট্রিক টন সার উত্তোলন করতে গেলে স্থানীয় ডিলারদের কাছ থেকে (জামালপুর জেলা) ট্রাক মালিক ও শ্রমিক সংগঠণ ৪শ’ টাকা চাঁদা নেয়া হলেও উত্তরবঙ্গ ও জামালপুর জেলার বাইরের ডিলাদের ট্রাকের ভাড়ার উপর শতকরা ১০ ভাগ হিসেবে চাঁদা দিতে হয়। এতে ১২ মেট্রিক টন সার উত্তোলন করতে উত্তরবঙ্গের ডিলারদের দেড় হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। এছাড়া প্রতি বস্তা সার উত্তোলনের সময় এই মালিক সমিতিকে চাঁদা দিতে হয় ১ টাকা ৫০ পয়সা। এতে ১২ মেট্রিক টন (এক ট্রাক) সারের জন্য ১৮০ টাকা চাঁদা গুনতে হয়। এছাড়া আমদানীকৃত নষ্ট হওয়া সার যাতে না দেয়া হয় এজন্য ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ট্রাক প্রতি দিতে হয় ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। ঘাটে ঘাটে এসব চঁাদা দিতে গিয়ে অতিষ্ট হয়ে পড়েছে যমুনা সার কারখানা কমান্ড এরিয়ার ১৯ জেলার ডিলাররা।

সার ডিলার ও ট্যান্সপোর্ট এজেন্সির মালিকরা বলেন, প্রতি বছর সাড়ে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ মেট্রিক টন সার কারখানা ডিলারদের মাঝে সরবরাহ করা করা হয়। এই পরিমাণ সার পরিবহণ করতে প্রায় ৩৫ হাজার ট্রাকের প্রয়োজন হয়। সার পরিবহণ করতে প্রতি ট্রাকে গড়ে ১ হাজার ৫শ টাকা হিসেবে সাড়ে ৪ কোটি এবং প্রতি বস্তা ১টাকা ৫০ পয়সা হিসেবে এক কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে থাকেন পরিবহণ সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেটের কতিপয় প্রভাবশালী নেতা। এছাড়া আমাদানীকৃত সার নিয়ে মালিক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হাতিয়ে নেয় কোটি টাকা। এতে প্রতিবছর ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ট্রাক মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। যা ট্র্যান্সপোর্ট এজেন্সির মাধ্যমে সার ডিলারদের কাছে পাঠানো সারের খরচ বাবদ ট্র্যান্সপোর্ট এজেন্সির মারিকদের চালান বই যাচাই করলেই এই চাঁদাবাজির স্বাক্ষ্য বেরিয়া আসবে।

তারা আরো বলেন, ২০১৮ সালের শেষ দিকে যমুনা সার কারখানায় আগুন লেগে এক বছরেরও অধিক সময় কারখানা বন্ধ থাকে। এসময় বিসিআইসি বিদেশ থেকে আমদানী করা ইউরিয়া দিয়ে যমুনা কারখানা কমান্ড এরিয়ার ১৯ জেলার কৃষকদের সারের চাহিদা পুরণ করেন। কিন্তু যমুনার দানাদার ইউরিয়া সার উৎকৃষ্ট মানের হওয়ায় ফলন ভাল হয়। এতে এঅঞ্চলের কৃষকদের কাছে যমুনার উৎপাদিত সারে চাহিদা অনেক বেশী। বেশী মুল্যের তারা এই সার ক্রয় করে ফসল ফলান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সার ডিলার ও ট্র্যান্সপোর্ট এজেন্সির মালিকরা বলেন, বিদেশ থেকে আমদানী করা সার যমুনা সার কারখানা কর্তৃপক্ষ খোলা আকাশের নীচে রাখায় রোদে শুকিয়ে এবং বৃষ্টিতে বীজে জমাট বেঁধে গুনগত মান নষ্ট হয়ে যায়। এই সার কৃষকরা নিতে চায় না। কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষ প্রতি ট্রাকে বাধ্যতামুলক ২ মেট্রিক টন আমদানীকৃত নষ্ট হওয়া সার ডিলাদের চাপিয়ে দিচ্ছে। এতে ডিলাররা আর্থিকভাবে ক্ষতি শিকার হচ্ছে।

ডিলারদের অভিযোগ, তারকান্দি ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ মোজাম্মেলন হক মুকুল ও সাধারণ সম্পাদক মোঃ আশরাফুল ইসলাম মানিক করাখানা বিপণনের ম্যানেজার ওরেছুর রহমানের যোগসাজশে আমদানীকৃত সার কম দিয়ে ট্রাক প্রতি ২ থেকে ৩ হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। সব মিলিয়ে তারাকান্দি ট্রাক মালিক সমিতির নেতাদের চঁাদাবাজিতে তার অতিষ্ট হয়ে পড়েছে। ভুক্তভোগী ডিলাররা মালিক সমিতির নেতাদের বেপোরা চাঁদাবাজি বন্ধে সংশিষ্ঠ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

এবিয়য়ে তারাকান্দি ট্রাক মালিক সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বললে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদককে বলেন, ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ মোজাম্মেল হক মুকুল তিনি ট্র্যান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতিরও সভাপতি। তিনি এবং মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিলে তাদের নিজস্ব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এসব চঁাদাবাজি করে থাকেন। এসব চাঁদাবাজির ঘটনার সাথে অন্যান্য কর্মকর্তা জড়িত নয় বলে দাবি করেন তারা।

তবে ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক মুকুল এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তার বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। সমিতির নিয়ম অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

এদিকে জামালপুর জেলা সার ডিলার সমিতির সভাপতি ফারুক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ট্রাক মালিক সমিতির নেতারা ডিলারদের কাছ থেকে নানা ভাবে চঁাদা নেয়ার অভিযোগের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, এসব চাঁদা বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হবে।

(আরআর/এসপি/সেপ্টেম্বর ০১, ২০২০)

যমুনা সার কারখানায় বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ ডিলাররা

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test