E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

চার বছরেও সন্ধান মেলেনি থানা লকআপ থেকে নিখোঁজ ডাঃ মোখলেছুরের, ওসি-এসআই’র নামে মামলা 

২০২০ সেপ্টেম্বর ০৭ ২৩:৫০:৩০
চার বছরেও সন্ধান মেলেনি থানা লকআপ থেকে নিখোঁজ ডাঃ মোখলেছুরের, ওসি-এসআই’র নামে মামলা 

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : হোমিও চিকিৎসক সাতক্ষীরা শহরের পারকুকরালির ডাঃ মোখলেছুর রহমান জনি সদর থানা লকআপ থেকে নিখোঁজের চার বছরেও সন্ধান মেলেনি। তবে ইতিমধ্যে সদর থানার তৎকালিন থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমদাদ শেখ, ফিরোজ হোসেন মোল্লা ও উপপরিদর্শক হিমেলের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। ২০১৬ সালের ৪ আগষ্ট তাকে সাতক্ষীরা শহরের লাবণী সিমেনা হলের সামনে থেকে পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের আর্থিক অনটন ও বারবার তদন্ত বিড়ম্বনায় স্থবির হয়ে পড়েছে বিচার কার্যক্রম।
সোমবার সকালে সরেজমিনে সাতক্ষীরা শহরের পারকুকরালি গ্রামে গেলে নিজ বাড়িতে বসে আব্দুর রাশেদ জানান, তার ছোট ছেলে মোখলেছুর রহমান জনি (৩০) ২০১৬ সালের ৪ আগষ্ট সদর থানা লক আপ থেকে নিখোঁজ হয়েছেন। এরপর থেকে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা তাকে ফিরে পেতে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে একটি প্রশাসন যন্ত্রের কাছে তাদের লড়াই বারে বারে বিপর্যস্ত হচ্ছে। হাইকোর্টের আদেশে যথাযথ সাক্ষী দিলেও গ্রহণযোগ্য প্রতিবেদন দেননি পিবিআই এর খুলনা পুলিশ সুপার আনিছুর রহমান। এর উপর ভিত্তি করে হাইকোর্ট পুলিশ পরিদর্শক এমদাদ হোসেন, ফিরোজ হোসেন মোল্লা ও উপপরিদর্শক হিমেলের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করার নির্দেশ দিলেও এক ছেলেকে বাঁচাতে নিজের পরিবার ও স্বজনদের হারানোর আশঙ্কায় মামলা করতে পারেননি। স্বাক্ষী দেওয়ায় হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন ঘটনার সাক্ষীরা। এ ছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে মামলা চালাতে যেয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এরপরও পুলিশের বিরুদ্ধে লড়াই তাই আইনজীবীরা প্রথমে মামলা নিয়ে পরে থাকতে চান না।

আক্ষেপের সঙ্গে তিনি বলেন, জনির পোষা কবুতরগুলো তিনি দু’ বেলা খাবার ও পানি দেন। জনির পোষা একটি কুকুর, একটি ঘুঘু ও একটি শালিক ছিল। কুকুরটি মারা গেছে। উড়ে গেছে শালিক ও ঘুঘুটি। কয়েকটি হোমিও চিকিৎসকের বই ও হোমিওপ্যাথি ঔষধ ভর্তি আলমারিই এখন কেবলই স্মৃতি । করোনা পরিস্থিতির কারণে শহরের পার্ক হোটেলের ম্যানেজার হিসেবে প্রতি মাসে চার হাজার টাকা পাওয়া আব্দুর রাশেদ জানান, হোটেলটি আংশিক ভাঙা হয়েছে।

বয়সের ভারের পাশাপাশি হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া আব্দুর রাশেদ(৬৮) বলেন, এরপর নতুন করে কোথাও কাজ না পেলে সংসার চালাবেন কি করে ? এরপরও শেষ সম্বল বাড়ি টুকু বিক্রি করে ছেলেকে খুঁজে পেতে মামলা চালাতে চান। কথা বলার একপর্যায়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, তার ছেলের লাশটুকু কি বাবা হিসেবে তার ফিরে পাওয়ার অধিকার নেই? যদি আদালতে বিচার না পাই তা হলে আল্লাহ’র উপর এ বিচার ছেড়ে দিলাম। লিবিয়ার গাদ্দাফি ও ইরাকের সাদ্দাম হিটলারি কায়দায় নিপীড়ন ও নির্যাতন চালিয়েও নিজেদের শেষ রক্ষা করতে পারেননি। একইভাবে এমদাদ, ফিরোজ ও হিমেল শেষ রক্ষা করতে পারবে না।

রাশেদ বলেন, ওসি এমদাদুল হক শেখ এবং ওসি ফিরোজ হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত বিভাগীয় মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য খুলনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ ওয়াছিম ফিরোজ গত রোববার সকাল ১০টায় সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁ, কল্যাণ ব্যাণার্জী, অ্যাড. আবুল কালাম আজাদ, অ্যাড. এসএম হায়দার আলীসহ ১৬জন সাক্ষীকে তার অফিসে ডাকা হয়। কিন্তু শারীরিক অবস্থা, নিরাপত্তা ও সকল গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের সময়ের কথা চিন্তা করে তিনি তদন্তকারি কর্মকর্তার কাছে সাতক্ষীরায় এসে সাক্ষ্য গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন।

সোমবার দুপুরে মোবাইল ফোনে জেসমিন নাহার রেশমা অভিযোগ করে বলেন, উপপরিদর্শক হিমেলের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের পহেলা অক্টোবর বিভাগীয় মামলা(৬/১৮) হয়েছে। চলতি বছর ওসি এমদাদুল হক শেখ ও ফিরোজ হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা(১৬/২০.১৭/২০) হয়েছে। বর্তমানে তারা চট্টগ্রামে রয়েছেন। পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা চালাতে যেয়ে তারা ঋণগ্রস্ত হয়ে গেছেন। অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া রেশমা বলেন, এক মাত্র সন্তান মাহমুনা আঞ্জুমকে মানুষ করার পাশাপাশি দীর্ঘদিন জীবিত দেখতে চাই বাবা ও মা সমতুল্য শ্বশুর ও শ্বাশুড়িকে। বাড়ি বিক্রি করে শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে নয়, নিজে আইনজীবী হয়ে জ্যেষ্ঠ সহকর্মীদের সহযোগিতা নিয়ে আগামিতে বিচার চুড়ান্ত স্তরে নিয়ে যেতে চাই।

খুলনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ওয়াসিম ফিরোজ বলেন, দু’ ওসির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণের বিষয়টি নিখোঁজ হওয়া ড্ঃা মোখলেছুরের বাবার অনুরোধের বিষয়টি তিনি ঢাকা পুলিশ হেডকোয়ার্টারে কথা বলে পরবর্তী করনীয় সম্পর্কে জানাবেন।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৪ আগষ্ট রাত সাড়ে ৯টার দিকে অসুস্থ বাবার জন্য বাইসাইকেলে ঔষধ কিনতে যেয়ে সাতক্ষীরা শহরের লাবনী সিনেমা হলের সামনে ফটোস্টাটের দোকান থেকে সদর থানার উপপরিদর্শক হিমেল হোমিও চিকিৎসক মোখলেছুর রহমান জনিকে থানায় ধরে নিয়ে যায়। ৫,৬ ও ৭ আগষ্ট স্ত্রী জেসমনি নাহার রেশমা শ্বশুর ও স্বজনদের নিয়ে থানা লক আপে তাকে খাবার দিয়েছেন, তার সঙ্গে কথা বলেছেন। থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমদাদুল হক শেখ ও উপপরিদর্শক হিমেলের সঙ্গে কথা বললে জনির জঙ্গি সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানানো হয়। স্বামীর মুক্তির বিনিময়ে তৎকালিন থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও উপপরিদর্শক হিমেল জনির স্ত্রী রেশমার কাছে দাবি করেন মোটা অংকের টাকা। ৮ আগষ্ট থানায় গেলে জনিকে পাওয়া যায়নি। পুলিশ জনির অবস্থান সম্পর্কে জানাতে পারেনি।

বিষয়টি সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা, মানবাধিকার কর্মী জেলা প্রশাসক ও পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাকে অবহিত করেন। ২৪ আগষ্ট জানানো হয় সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারকে। ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর থানায় সাধারণ ডায়েরী করতে গেলে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফিরোজ হোসেন মোল্লা তা গ্রহণ করেননি। কোন উপায় না দেখে ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন রেশমা। ২১ জানুয়ারি আইন ও শালিস কেন্দ্রের তদন্তকারি টিমের সদস্য অনির্বান সাহা, মানবাধিকার কর্মী রঘুনাথ খাঁ, মাধব চন্দ্র দত্তসহ কয়েকজন তাদের বাড়িতে আসেন থানায় যান। অবশেষে ২০১৭ সালের ২ মার্চ হাইকোর্টে রিট পিটিশন (২৮৩৩/১৭) দাখিল করেন রেশমা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আটজনকে বিবাদী করা হয়।

আদালতের নির্দেশে ১৯ মার্চ আদালতে উপস্থাপন করা পুলিশ সুপারের ব্যাখ্যায় বলা হয়, নিখোঁজ মোখলেছুর রহমান নিষিদ্ধ সংগঠন ‘আল্লাহ’র দল’ এর সঙ্গে যুক্ত এবং তাকে গ্রেফতার করা হয় নাই। ১৯ মার্চ শুনানী শেষে আদালত ডাঃ জনিকে ১২ এপ্রিলের মধ্যে বিচারিক আদালতে হাজির করানোর নির্দেশ দেন। একই সাথে ৯ মে এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ঢাকা লিগ্যাল সেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এএসএম জাভিদ হাসানকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ি একরামুল হাবিব সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন পিপিএমসহ ১০জন পুলিশ সদস্য ও পাঁচজন সাধারণ মানুষের জবানবন্দি নিয়ে মোখলেছুর রহমান জনিকে ২০১৬ সালের ৪ আগষ্ট পুলিশ আটক করেনি বা তাকে কেউ থানার মধ্যে দেখেনি মর্মে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন।

পরে আদালতের নির্দেশে ২০১৭ সালের বছরের ৩ জুলাই সাতক্ষীরার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম হাবিবুল্লাহ মাহমুদ হাইকোর্টে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে থানা লক আপ থেকে ডাঃ জনির নিখোঁজ হওয়ার সত্যতা পাওয়া গেছে মর্মে প্রতীয়মান হয়। পরবর্তীতে এক আদেশে ওই বছরের ৩ অক্টোবরের মধ্যে এ সম্পর্কিত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পিবিআইকে (পুলিশ ব্যুরো ইনভেসটিগেশন) নির্দেশ দেওয়া হয়। পিবিআই তদন্ত প্রতিবেদনে ডাঃ জনিকে থানায় এনে আটক রাখার সত্যতা মেলেনি বলে উল্লেখ করে থানায় জিডি নিয়ে তার তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমদাদুল হক শেখ, ফিরোজ হোসেন মোল্লা ও উপপরিদর্শক হিমেল হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা গ্রহণ করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়। একইসাথে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

২০১৮ সালের পহেলা অক্টোবর উপপরিদর্শক হিমেল হোসেনের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় বিভাগীয় মামলা(০৬/১৮) দায়ের করা হয়। এ ঘটনায় ২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইলতুৎ মিশের কাছে ও ২২ নভেম্বর খুলনার সহকারি পুলিশ সুপার আব্দুল কাদের বেগ এর কাছে জেসমনি নাহার রেশমা, তার শ্বশুর আব্দুর রাশেদ, শ্বাশুড়ি আনোয়ারা খাতুন সাক্ষী দেন। একইভাবে ২৮ নভেম্বর মঙ্গলবার মানবাধিকার কর্মী রঘুনাথ খাঁ ও তিন পুলিশ সদস্যের সাক্ষী গ্রহণ করা হয়।

(আরকে/এসপি/সেপ্টেম্বর ০৭, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test