E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বরিশালে নাজিরের হাতে আলাদিনের চেরাগ!

২০২০ সেপ্টেম্বর ১২ ১৯:১৬:২৮
বরিশালে নাজিরের হাতে আলাদিনের চেরাগ!

আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : ১৯৯১ সালে জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার সার্টিফিকেট সহকারী পদে চাকরিতে যোগদান করেন হাবিবুর রহমান। সেই থেকে একইপদে থাকলেও প্রেষণে তাকে বরিশাল ডিসি অফিসের নাজিরের দায়িত্বে আনা হয় তিনবছর পূর্বে। এরপরেই তিনি পেয়ে যান আলাদিনের চেরাগ। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় তিনি আলিশান বাড়ি করার পাশাপাশি গড়েছেন কয়েক কোটি টাকার সম্পদ।

হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ যায় দুর্নীতি দমন কমিশনে। তারই ধারাবাহিকতায় দুদক বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব দেয় সংস্থাটির বরিশাল সমন্বিত জেলা কার্যালয়কে। ইতোমধ্যে সম্পদের বর্ণনা চেয়ে হাবিবুর রহমানকে চিঠি দিয়েছেন সহকারী পরিচালক রণজিৎ কুমার কর্মকার। প্রায় পাঁচ মাস পর সম্পদের বর্ণনা দাখিল করেছেন সার্টিফিকেট সহকারী হয়েও অবৈধভাবে নাজিরের দায়িত্ব পালন করা হাবিবুর রহমান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরিশাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কর্মরত অধিকাংশ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অনতিবিলম্বে দুর্নীতিবাজ হাবিবুর রহমানকে নাজিরের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে নিয়মানুযায়ী সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে নাজিরের দায়িত্ব দেয়ার মাধ্যমে জেলা প্রশাসক কার্যালয়কে দুর্নীতি মুক্ত করার দাবি করেছেন।

অতিসম্প্রতি দুদকের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ আগস্ট হাবিবুর রহমান যে বর্ণনা দাখিল করেছেন, তাতেই বিপুল অবৈধ সম্পদের তথ্য এসেছে। যা বৈধ আয়ের সাথে সম্পদের বিশাল গড়মিল রয়েছে। কোন আলাদিনের চেরাগ পেয়ে হাবিবুর রহমান এতো কিছু করলেন তার অনুসন্ধানে নেমে ইতোমধ্যে দুদকের কর্মকর্তারা সব ব্যাংক ও ভূমি অফিসে চিঠি প্রেরণ করেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরিশাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, নিয়মানুযায়ী সার্টিফিকেট সহকারীদের মধ্যে সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিই নাজিরের দায়িত্ব পাবেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে গত তিনবছর পূর্বে হাবিবুর রহমানকে প্রেষণে বরিশাল ডিসি অফিসের নাজিরের দায়িত্বে আনা হয়।

সূত্রগুলো আরও জানিয়েছেন, চাকরিজীবনের শুরু থেকেই সার্টিফিকেট সহকারী হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিলো। ২০০৯ সালে কোর্ট ফি’র বিপুল অর্থ আত্মসাত, এক শিক্ষকের বেতন ছাড়ের জন্য মোটা অংকের টাকা ঘুষ গ্রহণসহ কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ এনে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন বাকেরগঞ্জের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ্ আব্দুল তারিক। বিষয়টি তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেলেও অজ্ঞাত কারণে তার (হাবিবুর) বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

ওই অভিযোগের নিস্পত্তি হওয়ার কথা স্বীকার করলেও, কীভাবে নিস্পত্তি হয়েছে তার কোন সদুত্তর দিতে পারেননি অভিযুক্ত হাবিবুর রহমান।

সূত্রমতে, হাবিবুরের একচ্ছত্র আধিপত্য বরিশালের ডিসি অফিসেও। যেকোনো নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রায় সবক্ষেত্রে হাবিবই শেষকথা। ডিসি অফিসের নানা কেনাকাটা ও সাধারণ মেরামতের ভুয়া ভাউচার দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

সূত্রে আরও জানা গেছে, ডিসি অফিসের নাজির হাবিবুর রহমানের সর্বসাকুল্যে বেতন বিশ হাজার টাকা। এরমধ্যে পাঁচ হাজার দুইশ’ টাকা জমা রাখেন ভবিষ্যত তহবিলে। চলমান দ্রব্যমূল্যের বাজারে বাকি ১৪ হাজার আটশ’ টাকায় যখন তার চার সদস্যের সংসার চালানোই দায়, তখন তিনি বরিশাল নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পাঁচতলার আলিশান বাড়ি করেছেন। এছাড়াও গড়েছেন কয়েক কোটি টাকার সম্পদ। ছেলেকে পড়াশুনা করাচ্ছেন ঢাকায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে হাবিবুর রহমান বলেন, বৈধ আয়েই আমি এসব সম্পদ গড়েছি।

দুদকের কাছে হাবিবুর রহমানের দাখিল করা সম্পদের বর্ণনায় বরিশাল নগরীর বগুড়া ও আলেকান্দা মৌজায় ছয় এবং সোয়া চার শতকের দুটি প্লটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ সোয়া ১০ শতক জমির দাম বলা হয়েছে ১৫ ও ৫০ হাজার টাকা। অথচ ভূমি অফিসের তথ্যানুযায়ী, ওই এলাকায় প্রতি শতক জমির সরকার নির্ধারিত মূল্যই ৫ লাখ ৬১ হাজার ৩০৭ টাকা।

সে হিসেবে এসব জমির মূল্য কমপক্ষে ৫৭ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। এর বাহিরে বরিশাল সদর উপজেলার চরআইচা এলাকায় ৩৩ শতক জমি থাকার কথা উল্লেখ করে দাম বলা হয়েছে মাত্র ৩৩ হাজার টাকা। ভূমি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এখানে জমির দামের সরকার নির্ধারিত মূল্য প্রতি শতক ৫০ হাজার টাকা। সেই হিসেবে মূল্য দাঁড়ায় ১৬ লাখ টাকারও বেশি। আলেকান্দা ও চরআইচা এলাকার বাসিন্দারা জানান, সরকার নির্ধারিত ওই মূল্যের চেয়ে গত ১০/১২ বছর আগে থেকে আরও ৪/৫ গুণ বেশি দামে এখানে জমি বিক্রি হচ্ছে।

এসব জমি কেনার উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে হাবিবুর রহমান বলেন, ২০/২২ বছর আগে আমি চরআইচার (৩৩ শতক) জমি ক্রয় করেছি। তখন রেট কম ছিল। আলেকান্দার জমি ক্রয় করেছি ২০০৩ সালে। তিনি আরও বলেন, নগরীর আর্শেদ আলী কন্ট্রাক্টর গলিতে আমার কিছু জমি ছিলো। ১৯৯৯ সালে ওই জমি বিক্রি এবং তার সাথে আরও কিছু টাকা জমিয়ে ওই ছয় শতক জমি ক্রয় করেছি। বাকি জমি সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে ক্রয় করা।

মাত্র ১৫ হাজার টাকায় সংসার চালিয়ে ছেলেকে ঢাকায় রেখে পড়াশুনা করানো আর মেয়ের লেখাপড়ার খরচের পরেও কিভাবে এতো টাকা সঞ্চয় করলেন, এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারেননি হাবিবুর রহমান।

হাবিবুর রহমানের দেয়া বর্ণনায় আরও জানা গেছে, আলেকান্দা কাজীপাড়ায় ছয় শতক জমির ওপর তিনি একটি পাঁচতলা আলিশান ভবন নির্মাণ করেছেন। সরেজমিন পরিদর্শন করে এক প্রকৌশলী জানান, ওই বাড়িটি নির্মাণ করতে প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ভবনটি থেকে প্রতিমাসে ভাড়া বাবদ ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা আয় হয়। তা আয়কর রিটার্নে দেখাননি হাবিবুর রহমান।

এ ব্যাপারে তিনি (হাবিবুর রহমান) বলেন, ২০০৭ সালে নির্মাণকাজ শুরু করে ২০১২ সালে এ ভবনের কাজ শেষ করা হয়েছে। এ বছরই ভবন নির্মাণের ব্যয় নিরূপণ করে আয়কর ফাইলে সংযুক্ত করা হবে। ভবনটি নির্মাণে ৪০ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়নি দাবি করে হাবিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ভবন নির্মাণে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স থেকে ২৫ লাখ টাকা ও সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণসহ আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার করা হয়েছে। আমার মোট ঋণ ৩৯ লাখ ৯২ হাজার টাকা। এছাড়া আমার স্ত্রীও সরকারি চাকরি (অফিস সহকারী) করে। এখানে তার আয়েরও অংশ রয়েছে।

দুদকের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত যে তথ্য রয়েছে তাতে ডিসি অফিসের নাজির হাবিবুর রহমান ও তার স্ত্রীর সমন্বিত বৈধ আয়ের তুলনায় সম্পদের পরিমাণ কয়েকগুণ বেশি। তা কয়েক কোটি টাকা। ২০১২ সালে যদি বাড়ির নির্মাণকাজ শেষ হয় তাহলে টানা আট বছর এটি এবং বাড়ি ভাড়া বাবদ আয় হওয়া টাকার তথ্য গোপন রাখাও একটি অপরাধ।

সূত্রটি আরও বলেন, নাজির হাবিবুর রহমানের উল্লেখ করা সম্পদের বাহিরেও জমি ও ফ্ল্যাটের তথ্য আসছে আমাদের কাছে। আমরা সেগুলো যাচাই-বাছাই করছি। পাশাপাশি জেলার সব ভূমি কর্মকর্তা এবং তফসিলি ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়েছি। সব তথ্য প্রমাণ পাওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ ব্যাপারে তদন্তের দায়িত্বে থাকা দুদকের বরিশাল সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রণজিৎ কুমার কর্মকারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পুরো বিষয়টির তদন্ত চলছে, তাই তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কথা বলা ঠিক হবেনা।

বরিশালের জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান সাংবাদিকদের বলেন, হাবিবুর রহমানের বিষয়ে দুদকের একটি চিঠি আমরা পেয়েছি। তারা যেসব তথ্য জানতে চেয়েছে, তা লিখিতভাবে তাদের জানানো হয়েছে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

(টিবি/এসপি/সেপ্টেম্বর ১২, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test