E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

জঙ্গি হামলার ১৮ বছর 

সেই ভয়াল ২৮ সেপ্টেম্বর আজ

২০২০ সেপ্টেম্বর ২৮ ২১:১১:২৪
সেই ভয়াল ২৮ সেপ্টেম্বর আজ

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়  মাত্র ১১ মিনিটের ব্যবধানে শহরের দুটি জনাকীর্ন স্থানে পরপর দুটি শক্তিশালী  বোমা নিক্ষেপের ভয়ংকর ঘটনার দিন সেই ২৮ সেপ্টেম্বর আজ । হঠাৎ বিদ্যুৎ  চলে যাওয়ার পর  সান্ধ্যকালীন অন্ধকার পরিবেশে এই সন্ত্রাসী  তান্ডবে সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলেন তিন জন । আর গুরুতর আহত হয়ে এখনও  পঙ্গুত্বের  অভিশাপে ভুগছেন  শত মানুষ ।  এই জঙ্গি হামলার কোনো বিচার হয়নি আজ অবধি । এমনকি   কারা এর সাথে সরাসরি জড়িত তাও খুঁজে দেখা হয়নি ।  ২০০২ সালের সেই দিনে  সেই নিহতরা আজ ১৭  বছর পর আবারও স্মরিত হবেন তাদের স্বজনদের কাছে  ।

ঘটনার পরদিন পত্র পত্রিকায় খবর দেখে সাতক্ষীরা পৌঁছান তৎকালিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী , স্ব্রাষ্ট্র সচিব মো. মোদাব্বির , বানিজ্য উপদেষ্টা ও সাতক্ষীরা জেলা মন্ত্রী বরকতুল্লাহ বুলু , খুলনার মেয়র শেখ তৈয়েবুর রহমান প্রমুখ । রুদ্ধদ্বার কক্ষে বৈঠক করে তারা বললেন এতে কেউই মারা যায়নি । বরং কিছু পত্রিকা জোট সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে তিনজন নিহতের মিথ্যা প্রচার দিয়েছে । এর পরই খবর এলো বোমার আঘাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ঢাকার স্কুল ছাত্র মেবতাউল ইসলাম মুক্ত, দেবহাটার হাফিজুর রহমান পিনু এবং সাতক্ষীরার ডা. সেলিনা রহমান । আহত হন শতাধিক নারী, পুরুষ ও শিশু। এদের মধ্যে ৫০ জনেরও বেশি পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে আছেন। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০১১ সাল থেকে ফের নাম কা ওয়াস্তে মেলা শুরু হয়।

বহুল আলোচিত এই তান্ডবের পর পুলিশ বাদবিচার না করেই আওয়ামী লীগ দলীয় লোকজনকে ঢালাওভাবে গ্রেফতার করে । ঢাকায় জেআইসিতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছে কিছুই না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাদের ছেড়েও দেওয়া হয় ।
সাতক্ষীরার সাবেক পৌর কমিশনার ও মুক্তিযোদ্ধা হাসনে জাহিদ জজ জানান, বাঙ্গালী সংস্কৃতির এ মেলাটি বন্ধের জন্যে দীর্ঘদিন ধরে মৌলবাদি গোষ্ঠিরা চক্রান্ত করে আসছিলো। প্রায় প্রতিবছর মেলা শুরু হওয়ার আগেই মৌলবাদি গোষ্ঠিরা যাতে মেলা অনুষ্ঠিত না হয় এ জন্য সাতক্ষীরা শহরে মিছিল ও সভা-সমাবেশ করেছে। চক্রান্তের এই ধারাবাহিকতায় ওই গোষ্ঠিটি সফল হয় ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর।

মেলা চলাকালিন সময়ে ওই দিন সন্ধ্যায় মাত্র ১১ মিনিটের ব্যবধানে সাতক্ষীরা রকসি সিনেমা হলে এবং সাতক্ষীরা ষ্টেডিয়ামের দি লায়ন সার্কাস প্যান্ডেলে পর পর দু’টি শক্তিশালী বোমা হামলা চালানো হয়। ওই বোম হামলায় সাতক্ষীরা শহরের লাবসার মোকারম হোসেনের ছেলে স্কুল ছাত্র কাজী মেত্তাউল আলম মুক্তা (১৫), জেলার দেবহাটার আনিসুর রহমানের ছেলে হাফিজুল ইসলাম (২৫) ও শহরের ইটাগাছার ডা, আমিরুল ইসলামের স্ত্রী ডা, সেলিনা পারভীন (৩০)। নিহত হয়। এসময় আহত হয় শতাধীক নারী-পুরুষ ও শিশু। তাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। এই বোমা হামলার পরও আট বছর পর ২০০৯ সাল থেকে ঐতিহ্যবাহী এ মেলা শুরু হয়। কিন্তু মেলা সেই জৌলস আর ফিরে আসেনি। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাত্র ১৫ দিনের জন্যে মেলার অনুমতি মিলতো। অনেকটা গতানুগতিক ধারায় মেলা হয়ে আসছিল। কিন্তু ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার পর সাতক্ষীরাবাসির কাছ থেকে এ মেলা হারিয়ে যেতে বসে।

নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি ২৮ সেপ্টম্বর’০২ গুড়পুকুরের মেলা চলাকালে বোমা হামলা চালায় বলে খুলনায় গ্রেফতারকৃত জেএমবি’র জেলা আমির ডা, এস এম মাসুদ বিন ইসহাক ও বাগেরহাটে গ্রফতারকৃত আরেক জেএমবি স্বীকার করে। যদিও ওই বছর ১৫ দিনের জন্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মেলার আয়োজন করা হয়। সুষ্ঠুভাবে ওই বছর মেলা অনুষ্ঠিত হলেও এর পরের বছর থেকে নিরাপত্তার খোড়া অজুহাত দেখিয়ে স্থানীয় প্রশাসন আর মেলার কলবর বৃদ্ধি করার অনুমতি দেয়নি। গত বছর ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ দিনব্যাপি মেলার অনুমতি দেওয়া হলেও তা জমেনি। এবার করোনার কারণ দেখিয়ে মেলো বসেনি।

সাতক্ষীরার গণমানুষের নেতা অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, কয়েক শ‘ বছরের ঐতিহ্যবাহী সাতক্ষীরা গুড়পুকুরের মেলা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। এটি বাঙ্গালী সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। মৌলবাদি গোষ্ঠীর সুপরিকল্পিত যড়যন্ত্রের কারণে আজ এ মেলাটি সাতক্ষীরাবাসির মাঝ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।

সাতক্ষীরা জয় মহাপ্রভু সেবক সংঘের সভাপতি গোষ্ঠ বিহারী মণ্ডল বলেন, ঐতিহ্যবাহি গুড়পুকুরের মেলার গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে বলেন, বাঙ্গালী সংস্কৃতিকে ধ্বংসের পায়তারা করছে মৌলবাদি চক্র। যার অংশ হিসেবে ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মেলা চলাকালে রকসি সিনেমা হলে ও দি লায়ন সার্কাস প্যান্ডেলে বোমা হামলা চালায়। এতে অনেকেই হতাহত হয়। কিন্তু বোমা হামলাকারিদের বিচার আজো হয়নি। অথচ এই বোমা হামলার কারণেই এ মেলা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলেও এবার করোনার কারণে মেলার অনুমতি মেলেনি। তাছাড়া মামলাটির পূণঃতদন্ত হওয়ায় হামলাকারিরা শাস্তি পাবে বলে তিনি আশাবাদি।

সিআইডি’র সাতক্ষীরা শাখার পুলিশ পরিদর্শক আক্তারুজ্জামান জানান, ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গুড়পুকুরের মেলা চলাকালিন রক্সি সিনেমা হল ও সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামে বোমা হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত পৃথক দুটি মামলায় ( সদর থানার মামলা নং জিআর ৪৯৮/০২ ও জিআর ৮৯৯/০২ ) যথাক্রমে ২০০৪ সালের ৩১ জানুয়ারি তদন্তকারি কর্মকর্তা সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক মাওলা বক্স ও ২০০৪ সালের ২৯ মার্চ সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক সুখরঞ্জন সমাদ্দার চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। চুড়ান্ত প্রতিবেদন দু’টিতে বিষয়টি বিএনপি’র আভ্যন্তরীন কোন্দল বলে উল্লেখ করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৫ সালের ১২ ডিসেম্বর মামলা দু’টি সিআইডি’র সদর দপ্তরের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত ২০০৬ সালের ২৭ ফেব্র“য়ারি পূণঃতদন্তের জন্য আবারো সিআইডিতে ন্যস্ত করে।

রক্সি সিনেমা হলে বোমা হামলার ঘটনার পূণঃতদন্তে তদন্তকারি কর্মকর্তা সিআইডি’র পুলিশ পরিদর্শক খন্দকার মিরাজ বিশ্বাস ২০০৮ সালের ৩০ জুন জিআর ৪৯৮/০২ নং মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন। ওই মামলায় গেফতার দেখানো সাতক্ষীরা শহরের কামাননগরের আব্দুল কুদ্দুস, বাকাল বারুইপাড়ার প্রদীপ কুমার ঘোষ, সদর উপজেলার মামুদপুরের নজরুল ইসলাম, শহরের প্রাণসায়রের মোমিনউল্লাহ মোহনকে অব্যহতি দেওয়া হয়।

অভিযোগপত্রে জামালপুর জেলা সদরের শেখেরভিটা গ্রামের সুজা মিঞার ছেলে জাহিদুল ইসলাম (৩০) ওরফে বোমারু মিজান, একই জেলার মেলানদহ উপজেলার কুলছেন্না গ্রামের আব্দুস সোবহানের ছেলে রাকিব হাসানকে আসামি করা হয়। সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামে বোমা হামলার ঘটনার (জিআর ৪৯৯/০২) পূণঃতদন্তে জামালপুর জেলা সদরের শেখের ভিটা গ্রামের সুজা মিঞার ছেলে জাহিদুল ইসলাম (৩০) ওরফে বোমারু মিজান, একই জেলার মেলানদহ উপজেলার কুলছেন্না গ্রামের আব্দুস সোবহানের ছেলে রাকীব হাসান (২৭) ও সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামের হুজি নেতা নজরুল ঘরামীকে গ্রেফতার দেখিয়ে রিমাণ্ডে নিয়ে টিএফআই সেলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে জিজ্ঞাসাবাদে বোমারু মিজান ও রাকিব হাসান কয়েকজনের নাম উলে¬খ করলেও তাদের ঠিকানা সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য দিতে পারেনি। তবে জিআর ৪৯৯/০২ মামলাটি তিনি তদন্ত করছেন। যে কোন সময়ে আদালতে অভিযোগপত্রটি দাখিল করা হবে।

সাতক্ষীরার সাবেক পিপি অ্যাড. ওসমান গণি জানান, গুড়পুকুরের বোমা হামলা মামলা (জিআর -৪৯৮) বর্তমানে অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে বিচারাধীন।

(আরকে/এসপি/সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test