E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

পদ্মার অকাল ভাঙনে গৃহহীন শতাধিক পরিবার 

২০২০ নভেম্বর ১৪ ১৫:২৫:০৩
পদ্মার অকাল ভাঙনে গৃহহীন শতাধিক পরিবার 

শরীয়তপুর প্রতিনিধি : নির্মাণাধীন পদ্মা বহুমূখি সেতু প্রকল্পের শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তের ধার ঘেষা পাইনপাড়া চরে অসময়ে দেখা দিয়েছে প্রবল নদী ভাঙ্গন। কয়েক দিনের ভাঙ্গনে গৃহহীন হয়েছে শতাধিক পরিবার। অধিকাংশ মানুষের আশ্রয় হয়েছে খোলা আকাশের নিচে। এখনও মেলেনি সরকারি কোন সহায়তা । স্থানীয় সাংসদ জানিয়েছেন, সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সকল প্রকার সহায়তা প্রদান করা হবে।

এলাকাবাসীর দাবী পদ্মা সেতুর ৩৩ এবং ৩৪ নং পিলারের মাঝামাঝি এলাকায় ক্রস বাধ নির্মানের ফলে পানিরস্রোত ও গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় সংশ্লিষ্ট এলাকায় অকাল ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। তারা বাধ অপসারণ করে বিলীনকৃত এলাকা ভরাট করে দিতে সেতু কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবী জানিয়ে সম্প্রতি মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন। ভাঙ্গনের তীব্রতার কারনে এলাাকাসী প্রতিদিনই তাদের ঘর বাড়ি ও স্থাপনা অন্যত্র সড়িয়ে নিচ্ছে। ২৪ ঘন্টা ভাঙ্গন আতংকে সময় কাটাচ্ছে এলাকাবাসী। পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নিবেন এমনটি জানিয়েছেন শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী।

বিগত শতাব্দীর শেষ সময় ১৯৯৮-৯৯ সন থেকে শুরু করে ২০০২ সন পর্যন্ত পদ্মা নদীর অব্যাহত ভাঙ্গনে পাইনপাড়া মৌজাটি তিনটি গ্রাম নিয়ে সম্পূর্ন নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তাতে মঙ্গল মাঝির ঘাট, ছাত্তার মাদবরের হাট সহ অন্তত দুই হাজার পরিবারের সবত ভিটা বিলীন হয়। ২০০৪ সালের পর থেকে আবার পদ্মা নদীর মাঝে বিলীন হওয়া পাইনপাড়া এলাকাটিতে চর জেগে ওঠে। ২০০৭ সাল থেকে এলাকাবাসী পাইনপাড়া মৌজার হাজী ওসিমদ্দিন মাদবর কান্দি, মুনসের মোল্যার কান্দি এবং আহমেদ মাঝির কান্দি গ্রামে বসবাস শুরু করে। ২০১২ সালের পর থেকে পাইনপাড়া লাগোয়া এলাকায় পদ্মা সেতু নির্মানের কাজ শুরু হলে জেগে ওঠা চরের গুরুত্ব বহুগুন বেড়ে যায়। ওই চরে বসবাসকারী লোকেরা স্থায়ী আবাসস্থল গড়ে তুলতে শুরু করেন। বর্তমানে এলাকাটি নজর কাড়া পরিবেশে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই গত অক্টোবর মাসের ৩০ তারিখ থেকে পদ্মা সেতুর দক্ষিনে ৩৭ নং খুঁটি থেকে উত্তরে ৩২ নং খুঁটি পর্যন্ত সেতুর পূর্ব পাশে নদী ভাঙ্গন শুরু হয়। ক্রমশই ভাঙ্গনের তীব্রতা প্রবল হতে থাকলে মানুষের বসত বাড়ি, ফসলী জমি, গাছের বাগান, পাকা মসজিদ, মাদ্রাসা, দোকানপাট বিলীন হয়ে যায়। গত ১০ দিনে অন্তত ৩ শত বিঘা ফসলী জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে।

ইতিমধ্যে হাজী ওসিমদ্দিন মাদবর কান্দি, মুনসের মোল্যার কান্দি এবং আহমেদ মাঝির কান্দি গ্রামের মজিবর রহমান মাদবর, ঠান্ডু মিয়া মাদবর, জুলহাস পোদ্দার, হাবিব পোদ্দার, রফিক চৌকিদার, আবু ফকির, ধলু মাদবর, কাশেম শেখ, ছোহরাব মাদবর, নুরু মাদবর, নাসির মোল্য, আওলাদ শেখ, বারেক হাওলাদার, আল আমিন তালুকদার, কাশেম মোল্যা, জলিল মোল্যা, শাহজাহান শেখ, হাফিজ চৌকিদার, মোক্তার শিকদার, আব্দুল হক মেল্যা, মোস্তফা চৌকিদার, নুরুল হক চৌকিদার, আ. রব শিকদার, বকুল মুছুল্লী, জাহাঙ্গীর তালুকদার, জজ মিয়া শিকদার, মীনা মোলঙ্গী, ইয়াকুব বেপারী, আলমগীর তালুকদার, কাদের বেপারী, ইসহাক মোল্যা, ইদ্রিস মোল্যা, আলীম দেওয়ান, ধলু জমাদ্দার, হাজেরা বেগম, ছালাম মোল্যা, ইউছুব মোল্যা, কুদ্দুস মোল্যা, সেলিম ফকির, তারু বেপারী, খালেক বেপারী, আমির শেখ, আবুল বেপারী, মাসুদ বেপারী, সুমা বেগম, শাহনাজ বেগম, কালাই বেপারী, সোবহান ফকির, জিন্নাত আরা বেগম সহ শতাধিক লোক পদ্মার এই অকাল ভাঙ্গনে তাদের সহায় সম্পত্তি নদী গর্ভে হারিয়েছেন।

পাইনপাড়া চরে বসবাসকৃত অন্তত ১ হাজার পরিবারের প্রায় ৬ হাজার সদস্য এ বছর বন্যা মোকাবেলা করেছেন চার বার। সেই বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবার তারা অকাল ভাঙ্গনের শিকার হয়েছেন। ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এখন নদীর তীরে, অন্যের জমিতে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। ভয়াবহ এই ভাঙ্গনে মানুষের বিপুল পরিমানের ক্ষতি সাধন হলেও এখন পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি কোন সহায়তা নিয়ে কেউ তাদের কাছে যাননি। তবে জানা গেছে, জাজিরা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের একটি তালিকা প্রেরণ করেছে স্থানীয় পূর্ব নাওডুবা ইউনিয়ন পরিষদ।

ক্ষতিগ্রস্ত মজিবুর রহমান মাদবর বলেন, আমার পরিবারের ১১টি ঘর, ২০ বিঘা ফসলী জমি, পাকা মসজিদ এবং একটি মাদ্রাসা এক রাতের মধ্যে পদ্মা গিলে খেয়েছে। আমি সব কিছু হারিয়ে এখন নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমরা রিলিফ চাই না, সেতু কর্তৃপক্ষ আমাদের জমি ভরাট করে দিলেই আমরা বাঁচতে পারব। ইছহাক মোল্য জানান, তার ৮ বিঘা ফসলী জমি, ৪টি বসত ঘর, বাগানের প্রায় দুই কোটি টাকা মুল্যের দুই হাজারেরও বেশী ফলজ ও বনজ গাছ নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়েছে। তিনিও সরকারের কাছে তাদের জমি ভরাটের দাবি জানিয়েছেন। হাজেরা বেগম ও জিন্নাত আরা বেগমের ৭টি ঘর ও ৪ বিঘা জমি নদী গর্ভে চলে গেছে। তারা সেতু কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষতি পূরণ দাবী করেছেন।

পাইনপাড়া চরের সমাজ প্রধান আব্দুল ওহাব মাঝি বলেন, সেতু কর্তৃপক্ষ ৩৩ নং পিলারের পাশে অপরিকল্পিভাবে বাধ দেয়ার কারনে নদীরস্রোত উল্টো দিকে গতি নেয়ায় আমাদের এলাকায় ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। নদী ভাঙতে ভাঙতে আমার বাড়ির পেছনে চলে এসছে। সব সময় আতংকের মধ্যে রয়েছি। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি, ক্রস বাধটি তুলে দিয়ে শত শত পরিাবারকে তিনি যেন রক্ষা করেন।

শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডে নির্বাহী প্রকৌশলী এইচ এম আহসান হাবিব বলেন, পাইনপাড়া এলাকায় ভাঙ্গনের বিষয়ে আমারা অবগত আছি। ভাঙ্গন কবলিত এলাকা পরিদর্শণ করেছি। সেতু কর্তপক্ষের সাথে আমাদের কথা হয়েছে, সৃষ্ট সমস্যার সমাধানে তারা কাজ করবেন।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আব্দুল কাদের বলেন, নদীর মাঝখানে চর পরলে সে চর প্রাকৃতিক নিয়মেই আবার ভেঙ্গে যায়। আমরা সেতু নির্মানের সুবিধার্থেই বাধ নির্মান করেছি। এ বাধের কারনে চরে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়নি।

শরীয়তপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন অপু বলেন, পদ্মা সেতুর মত একটি মেগা প্রকল্পের কাজ নিরাপদে সম্পন্ন করতেই কর্তৃপক্ষ একটি ক্রসবাধ নির্মাণ করেছেন। এ বাধের কারনে পাইনপাড়া চরাঞ্চলে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়েছে কি না তা বলতে পারবনা। তবে, আমি ভাঙ্গন কবলিত এলাকা পরিদর্শণ করেছি। মানুষের অবর্নণীয় কষ্ট দেখে ব্যথিত হয়েছি। ইতমধ্যেই আমি পানি সম্পদ উপমন্ত্রী, সেতু বিভাগের সচিব এবং জেলা প্রশাসকরে সাথে কথা বলেছি। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার সকল প্রকার সহায়তা প্রদান করবে ইনশা আল্লাহ।

(কেএন/এসপি/নভেম্বর ১৪, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test