E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

রাজবাড়ী ২ আসনে পিতা-পুত্রের শাসন

২০২০ নভেম্বর ২৮ ১৭:১১:৩৪
রাজবাড়ী ২ আসনে পিতা-পুত্রের শাসন

স্টার্ রিপোর্টার : পাঁচ বছর আগে ইউসুফ মেম্বার ওরফে ইউসুফ মেম্বার ছিলেন কালুখালী উপজেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক। এখন তিনি ক্ষমতাশীল কালুখালী উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ- প্রচার সম্পাদক এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগে কমিটির সাধারণ সম্পাদক। আওয়ামীলীগের স্থানীয় সংসদ সদস্য জিল্লুল হাকিমের হাত ধরে আওয়ামীলীগে যোগদান করে হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে বা নিয়ন্ত্রণ নিতে বেছে বেছে আওয়ামীলীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের ওপর চলে হামলা ও অমানবিক নির্যাতন। মাত্র পাঁচ বছরে শতাধিক আওয়ামীলীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের ওপর চলে  ভয়াবহ  নির্যাতন।

আরো অভিযোগ রয়েছে তার নির্দেশে খুন করা হয় কালুখালীর উপজেলার মাঝবাড়ী ইউনিয়নের বেতবাড়ীয়া গ্রামের মুক্তিযুদ্ধা আছিরদ্দিনের ছেলে যুবলীগ নেতা রবিউল ইসলামকে। এই খুনের মামলাসহ তার বিরুদ্ধেই পাঁচটি মামলা রয়েছে। ইউসুফ মেম্বার ও তার দুই ছেলের বিরুদ্ধে। সংসদ সদস্য ও রাজবাড়ী জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি জিল্লুল হাকিমের ক্যাডার হিসাবে পরিচিত জেলার তালিকা ভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী মৃত জর্জ আলী বিশ্বাসের নির্দেশে খুন করা হয় একজন নিরীহ স্কুল শিক্ষক মোঃ আসাদুল ইসলামকে এই জর্জ আলী কিছুদিন আগে মারা যায়। সংসদ সদস্য জিল্লুল হাকিমের আশ্রীত ক্যাডার বাহিনীর হামলায় বাদ যায়নি পাংশার সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদ ও ঘটনায় রাজবাড়ী-২ (কালুখালী-পাংশা-বালিয়াকান্দি) আসনের সংসদ সদস্য মোঃ জিল্লুল হাকিম এমপি ও তার ছেলে আশিক মাহমুদ মিতুল হাকিমের মদদ থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। জিল্লুল হাকিম গত নির্বাচন তিনটি সংসদ নিবার্চনে ও আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। এমন কি পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও তার আশ্রিত ক্যাডার বাহিনীর ভয়ংকর নির্যাতনের ঘটনা উঠে এসেছে।

সস্প্রতি জিল্লুল হাকিম এমপির নির্বাচনী এলাকা ঘুরে ও অনুসন্ধানে এসব ঘটনার আলামত পাওয়া গেছে।গত ১৫ ই আগষ্ট ইউসুফ মেম্বারের নির্দেশে তার দুই ছেলে সোহেল মোল্লা ও রাসেল মোল্লাসহ স্থানীয় কাড্যাররা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান যুবলীগ নেতা মোঃ রবিউল ইসলামকে বাড়ী থেকে ধরে নেওয়ার পর শারীরিক নির্যাতনের পর মুনাই বিলের পানিতে চুবিয়ে খুন করেন। ওই ঘটনার পর গ্রামবাসী ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলে অভিযুক্ত ইউসুফ মেম্বারের দুই ছেলেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা যুবলীগ নেতা রবিউল ইসলাম হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা যায়। জানা গেছে মুক্তিযুদ্ধাপুত্র রবিউলের খুনিদের বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন এম পি জিল্লুল হাকিম ও তার পুত্র মিতুল হাকিম।

বাংলা ৭১, এর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কালুখালী উপজেলার ত্রাস ইউসুফ মেম্বার ১৯৯০ সালে ছাত্রদল কর্মী ছাত্রদলের কর্মী থাকা অবস্থায় অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয়ে কারাগারে ছিলেন অনেক দিন। জেল থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে বেপক বেপরোয়া হয়ে উঠেন তিনি। এক সময় বিএনপির দুর্ধষ ক্যাডার হিসেবে পরিচিত ছিল। ২০১৪ সাল পর্যন্ত কৃষকদলের আহ্বায়ক ও উপজেলা বিএন পির দপ্তর সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৫ সালে সংসদ সদস্য জিল্লুল হাকিমের হাত ধরে আওয়ামীলীগে যোগদান করেন।

অভিযোগ রয়েছে, জিল্লুর হাকিমের পৃষ্ঠপোষকতা, অবৈধ বালুর ব্যবসা, মাদক চোরাচালান, জমি দখলসহ নানা অবৈধ কাজের সাথে জড়িত এই ইউসুফ মেম্বার। পাংশা উপজেলার শুবর্ণখোলা গ্রামের মৃত খোর্শেদ আলীর ছেলে খলিলুর রহমান খাঁনকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। সেই সমায়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী মৃত জর্জ আলী বিশ্বাসের নির্দেশে তার ছোট ভাই আসাদুল ইসলাম খান কুষ্টিয়ার খোকসার একটি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। গত ১৩ ই মার্চ সকালে তার আহত বড় ভাইকে দেখে কর্মস্থলে যাওয়া পথে জর্জ আলী বিশ্বাসের নির্দেশে মতিন, বদিয়ার, জাকির,তুহিন সহ, সন্ত্রাসীরা শিক্ষক আসাদুল ইসলাম খানকে গুলি করে হত্যা করে।

আসাদুলের স্ত্রী রতনা খাতুন বলেন, এমপির ক্যাডার ও জর্জ আলী বিশ্বাস ও তার দুই ছেলে এবং ভাতিজাসহ সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে ও কুপিত হত্যা করে আমার স্বামীকে। আমার স্বামীর মত নিরীহ মানুষকে যারা খুন করছে আর যারা খুনিদের রক্ষা করতে চায় আমি তাদের ফাঁসি চাই ও প্রাধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাই।

জিল্লুল হাকিমের নির্বাচনী এলাকা ঘুরে জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর দলেরনেতাকর্মীসহ অর্ধশত মানুষকে নির্মমভাবে খুনসহ পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে। জিল্লুল হাকিম ও তার ছেলের আশ্রীত ক্যাডার বাহিনীর ভয়ে শতাধিক নেতাকর্মী এলাকা ছাড়া। পাংশা উপজেলার সাংবাদিক মোঃ আবুল কালাম আজাদ, দৈনিক স্বদেশ প্রতিদিন, পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেন। ২০১৮ সালে জিল্লুল হাকিমের ক্যাডার বাহিনীর অন্যতম কালুখালীর মিজানুর রহমান মজনু ও আতিউর রহমান নবাব, পাংশা উপজেলার মনোয়ার হোসেন জনির সন্ত্রাস ও দূনীতি নিয়ে সংবাদ করেন তিনি। ওই সংবাদের পর মজনু, জনি, নবাবরা, ওই বছরের ২১ শে সেপ্টেম্বর ২০১৮ ইং হাতুড়ি ও রড দিয়ে পিটিয়ে আজাদের দুই হাত পা ভেঙে দেয়। প্রকাশ্য সন্ধ্যার পর মানুষের সামনে নির্মমভাবে পিটিয়ে মৃত ভেবে ফেলে রেখে চলে যায়।এই ঘটনার পর ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি । তিনি এখনো সারাশরীরে ক্ষত নিয়ে কোনমত বেঁচে আছেন।

সাংবাদিক মোঃ আবুল কালাম আজাদ কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, সত্য ঘটনা পত্রিকায় লেখায় আমান জীবনটাই শেষ করে দিয়েছিল এমপির ক্যাডারা। বাম হাতের আট স্থানে ভাঙ্গা, ডান হাতে দুই স্থানে ভাঙ্গা, দুই পাও ভেঙে দিয়েছে তারা। আজাদ আরো বলেন পাংশা পৌরসভার ৭ নং ওয়াডের কমিশনার মোঃ আবুল শেখ আমার বাসায় আমাকে দেখতে এসে বলে তোর তো মেরে ফেলে দিয়ার নির্দেশ ছিলো তুইতো তাও বেঁচে আছিস।

আজাদ বলেন, থানায় সেই সময় মামলাও করতে দেয়নাই এমপির ক্যাডার বাহিনী। শুধু আবুল কালাম আজাদ ই নন প্রতিকায় সংবাদ হলেই হামলার পাশাপাশি মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করা হয়। এসব করা হয় এমপি জিল্লুল হাকিম ও তার ছেলে মিতুল হাকিমের নির্দেশে। গত বছর ১৭ ই জুন কালুখালী উপজেলার মোহনপুর গ্রামের কেছমত শেখের ছেলে, ভ্যান চালক আব্দুর রহিমকে ও খুনের পিছনেও সংসদ সদস্য ও তার ছেলের মদদ থাকার অভিযোগ রয়েছে। ক্যাডার ইউসুফ মেম্বার ও আনোয়ার ডাক্তারের মাধ্যমে পরিকল্পনা করে ভ্যানচালককে খুন করানো হয়। ভ্যানচালোকের অপরাধ, তিনি উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামীলীগের মনোনীত প্রার্থী সাইফুল ইসলামের পক্ষে কাজ করেন।

কালুখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি কাজী সাইফুল ইসলাম বলেন, গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নেত্রী আমাকে নৌকা প্রতিক দিয়েছিলেন। কিন্তু জিল্লুল হাকিম নৌকার বিরুদ্ধে পাল্টা প্রার্থী দাড় করিম দেন। জোর করেই তার ক্যাডার দিয়ে কেন্দ্র দখল করেই আমাকে পরাজিত করেন। শুধু - ই তাই নয়।নৌকার পক্ষে কাজ করায় আমার কর্মীকে নির্মম ভাবে খুন করে জিল্লুল হাকিমের লোকজন। এই ভাবে জিল্লুল হাকিম ও তার ছেলের আশ্রীত ক্যাডাদের হামলায় খুন হন কালুখালী উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের কৃষকলীগের সহ-সভাপতি মোঃ আমজাদ, পাংশা উপজেলার যুবলীগের সদস্য আবু হাসান হাপু, একই উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও জেলা কৃষকলীগের সভাপতি মুন্সী নাদের হোসেন, মৌরাট ইউনিয়নের ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাধারণ শওকত হোসেন মেম্বার, কালুখালী উপজেলার সাওরাইল ইউনিয়নের ফিরোজ মিয়াসহ অনেকেই।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কালুখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম খান দলের কঠিন সমায়ে ১৯৮৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য ও ছিলেন তিনি। তার গোটা পরিবারই আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাঙ্গে জড়িত। বিএনপি জামায়াত সরকারের আমলে হামলা-মামলার শিকার হয়েছিলেন। মিথ্যা মামলায় কয়েকবার জেলও খেটেছেন। সংসদ সদস্য জিল্লুল হাকিম ও তার ছেলে মিতুল হাকিমের অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় গত বছরের ২রা অক্টোবর ইউসুফ মেম্বারের ছেলে সোহেল ও রাসেলের নেতৃত্বে নজরুল ইসলাম খানকে প্রকাশ্য পিটিয়ে তান দুই পা ভেঙে দেয় সন্ত্রাসীরা।

নজরুল ইসলাম খান বলেন, বিএনপির আমলে হামলা-নির্যাতনের শিকার হয়েছি। একাধিকবার জেলও খেটেছি। কিন্তু আওয়ামীলীগের আমলে মেরেই ফেলতে চেয়েছিল হাইব্রীড আওয়ামীলীগ নেতা ইউসুফ মেম্বার ও তার দুই ছেলেরা। কালুখালীর মানুষ এখন জিম্মা হয়ে আছে। কালুখালীর আবুল কালাম মৃধা ২৭ বছর ধরে আওয়ামীলীগের রাজনীতি করেন। ১৫ বছর ধরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। বিএনপি জামায়াত সরকারের আমলে ৯ টি মিথ্যা মামলায় আড়াই বছর বছর ছিলেন এলাকা ছাড়া। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর দুই মদাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হয়েছেন। গত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় তাকে পাঁচ মাস এলাকায় ঢুকতে দেয়নি সংসদ সদস্য জিল্লুল হাকিমের বাড়ীর কেয়ার টেকার মিজানুর রহমান মজনু ও তার ক্যাডার বাহিনী। দুইবার কুপিয়ে ও হাতুড়ি পেটা করে প্রায় মেড়েই ফেলেছিল তারা। কালুখালী উপজেলার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মজনু এমপির আর্শিবাদে এখন জেলা পরিষদের সদস্য।

আবুল কালাম মৃধা বলেন, বিএনপি জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগে আসা এমপির মদদে এখন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। পাংশা উপজেলা সাওরাইল ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা নাদের হোসেন খানের ছেলে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম আকমলের উপর হামলা হয় গত বছর। মে মাসে তারাবির নামাজ পড়ে বাড়ী ফেরার পথে উপজেলার কুড়াপাড়া বিদ্যুৎ অফিসের সামনে আকমল খান ও তার শিশু পুত্র আহাত খানকে ইউসুফ মেম্বার এবং ক্যাডাররা করে কুপিয়ে হামলা করেন।

এসপি মিজানুর রহমান বলেন, রাজবাড়ীতে মুক্তিযুদ্ধার ছেলে ও শিক্ষক খুনের আসামিসহ কয়েকজন গ্রেফতার এর পর জেলকর একটি প্রভাবশালী মহল পুলিশের উপর ক্ষুদ্ধ হয়।তবে পুলিশ তাদের কাজ করে যাচ্ছে। অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য সংসদ সদস্য জিল্লুল হাকিমের মুঠোফোন যোগাযোগ করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

(একেএ/এসপি/নভেম্বর ২৮, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test