E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

প্রায় চারশ বছরের প্রাচীনতম নিদর্শন লোহাগড়ার সিদ্বেশ্বরী কালিমাতা মন্দির

২০২০ ডিসেম্বর ০১ ১৪:২৬:২৮
প্রায় চারশ বছরের প্রাচীনতম নিদর্শন লোহাগড়ার সিদ্বেশ্বরী কালিমাতা মন্দির

রূপক মুখার্জি, নড়াইল : শিক্ষা, শিল্প সাহিত্য, সংস্কৃতির চারণ ক্ষেত্র নড়াইলের ঐতিহ্যবাহী লোহাগড়া উপজেলা। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক শতাব্দী প্রাচীন লোহাগড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র লক্ষ্মীপাশার শ্রী শ্রী সিদ্বেশ্বরী কালিমাতা মন্দির ‘প্রাচীন নিদর্শন’ তথা ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে স্বগৌরবে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। নবগঙ্গা নদীর দক্ষিণ পাড়ে প্রায় চারশ বছরের  পুরানো এই কালি মা শ্রী শ্রী সিদ্বেশ্বরী নামে পূজিত হয়ে আসছেন। প্রতিদিন এ পুণ্যস্থানে পূজা- অর্চণা, নিত্য ভোগরাগ, পাঠাবলি সহ অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালিত হয়ে আসছে। 

বাংলা ভাষাভাষি অধিকাংশ সনাতন ধর্মাবলম্বী নর-নারী লক্ষীপাশার এই শ্রী শ্রী সিদ্বেশ্বরী মা’কে নিজেদের ‘ত্রানকর্ত্রী’ হিসেবে মনে করেন। প্রতিদিন শত শত ভক্তবৃন্দের আগমন ঘটে এই পূণ্যস্থানে। প্রায় ১৮৩ শতক জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরটি আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। কালের স্বাক্ষী শ্রী শ্রী সিদ্বেশ্বরী কালিমাতা মন্দির অন্যতম প্রাচীনতম নিদর্শন।

মূল মন্দিরে স্থাপিত শ্বেত পাথরের ফলক, ইতিহাস, প্রতিষ্ঠানের সংবিধান থেকে সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ইংরেজী ১৬৪৩ সালে বাংলা আনুমানিক ১০২৫ বঙ্গাব্দে যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার ঝাঁপা মম্মিননগর গ্রামের রত্নেশ্বর চক্রবর্তীর ছেলে কামদেব চক্রবর্তী সংসার জীবন ছেড়ে তীর্থ ভ্রমণে বের হন এবং বিভিন্ন তীর্থ ভ্রমণ শেষে জয়পুর পরশমনি মহাশ্মশানে ‘কালি’ সাধনায় ব্রতী হন। কামদেব চক্রবর্তী ছিলেন সাধক প্রকৃতির মানুষ। তিনি স্বীয় সাধনা বলে সিদ্ধিলাভ করেন এবং শ্মশানের অপর প্রান্তে নবগঙ্গা নদীর দক্ষিণ পাড়ে লক্ষ্মীপাশা গ্রামে বর্তমান মন্দির প্রাঙ্গনে ছোট্ট একটি মন্দির নির্মাণ করে শ্রী শ্রী সিদ্বেশ্বরী কালিমাতার ‘বিগ্রহ’ বা ‘মূর্তি’তে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে কামদেব মাতৃ পূজায় মগ্ন হন। এখানে আজও হরিতকি, বহেরা, আমলকি, তমাল ও বট-পাঁকুড় গাছের সংমিশ্রনে একটি প্রাচীন বেদী রয়েছে যেটি ‘কামনাবৃক্ষ’ বলে সুবিদিত। সেখানে ধর্মপ্রাণ মানুষজন তাদের মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্য শিবমূর্তি অঙ্কিত ‘টালি’ (মাটির তৈরি) বেঁধে দেন এবং মনোবাসনা পূর্ণ হলে সেই টালিটি খুলে দেন।

১৮১৮ সালে পাইকপাড়া এষ্টেটের ফৌজদার বোলাকি সিংহ দাস নীলকর সাহেবদের পত্তনী হতে মুক্ত করার কাজে লোহাগড়ায় আগমন করেন এবং এই শ্রী শ্রী সিদ্বেশ্বরী কালিমাতা মন্দিরে অবস্থান করেন। ১৮৪৪ সালে বোলাকি সিংহ দাস নিজে উদ্যোগী হয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের সহযোগিতায় বর্তমান পাকা মন্দিরটি নির্মান করেন। ইংরেজী ১৯০১ বাংলা ১৩০৮ বঙ্গাব্দে শ্রী সিদ্বেশ্বরী কালিমাতা মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা কামদেবের বংশধর শীতল চন্দ্র চক্রবর্তী মূল মন্দিরের পূর্ব পাশে শিব মন্দির নির্মাণ করেন। এরপর তিনি ১৯১৯ সালে মূলমন্দিরের প্রবেশদ্বারের পশ্চিম পাশে যাত্রী নিবাস ও নবগঙ্গা নদীতে পাঁকা ঘাট নির্মাণ করেন। প্রায় ৪৬ বছর পর ১৯৩৫ সালে মন্দিরটির পুনঃসংস্কার করা হয় এবং তৎকালীন লক্ষ্মীপাশা গ্রামের কর্মকার বংশধরগণ মন্দিরের দক্ষিণ প্রান্তে জমি দান করেন। এরপর দানকৃত জমিতে একটি বড় পুকুর খনন করে পার্শর্¦বর্তী কাশিপুর গ্রামের নলিনী মুখার্জি ও রমনী মোহন মুখার্জি ভ্রাতৃদ্বয়ের অর্থায়নে পুকুরের ঘাট পাঁকা করা হয়।

৯০ এর দশকে মন্দিরটির পরিচালনা কার্যক্রম পারিবারিক বলয় থেকে বের হয়ে সার্বজনীন রূপ নেয় এবং স্থানীয় ধর্মানুরাগীদের সহযোগিতায় মন্দির পরিচালনার জন্য একটি সংবিধান ও একটি পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হয়। সংবিধান মোতাবেক উক্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি হিসেবে পদাধিকার বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বর্তমান পরিচালনা পরিষদের অধীনে নাট মন্দির, শিব মন্দির, বলিঘর সংস্কার ও সরকারী অর্থায়নে মায়ের ভোগরাগের জন্য একটি ভোগ মন্দির পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে কথা হয় শ্রী শ্রী সিদ্বেশ্বরী কালি মাতা মন্দির পরিচালনা পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও লোহাগড়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা অজয় কান্তি মজুমদারের সাথে। তিনি বলেন, সিদ্বেশ্বরী মায়ের মন্দিরটি একটি প্রাচীনতম নিদর্শন। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক বাহিনী ও স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় মাতৃমন্দিরের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। স্বাধীনতার পর স্থানীয় ধর্মানুরাগীদের সার্বিক সহযোগিতায় মায়ের মূর্তি পুণঃস্থাপন করে সুধীর চক্রবর্তীর পৌরহিত্যে পূজা অর্চণা শুরু হয়।

মন্দিরের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য সাবেক অধ্যাপক কুন্ডু বিমল কুমার বলেন, দেশের মধ্যে মন্দিরটি অন্যতম জাতীয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। ভক্তবৃন্দের অনেকেরই মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে শ্রী সিদ্বেশ্বরী মায়ের পূজা অর্চণা পালন করে।

মন্দির পরিচালনা পরিষদের বর্তমান সভাপতি ও লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রোসলিনা পারভীন বলেন, অত্র অঞ্চলে অনেক প্রাচীন নিদর্শন সমূহের মধ্যে শ্রী শ্রী সিদ্বেশ্বরী কালিমাতা মন্দির অন্যতম একটি নিদর্শন। মন্দিরের সংরক্ষন ও পবিত্রতা রক্ষা করার দায়িত্ব সকলের।

মন্দির পরিচালনা পরিষদের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ও বিশিষ্ট শিল্পপতি বাসুদেব ব্যনার্জি জানান, সিদ্বেশ্বরী মায়ের ভক্তবৃন্দের সার্বিক সাহায্য ও সহযোগিতায় মূল মন্দিরসহ অন্যান্য মন্দিরের সংস্কার ও সংরক্ষন করে এ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটিকে একটি অন্যতম উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই। তিনি এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সহ সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন।

(আরএম/এসপি/ডিসেম্বর ০১, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test