E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মঞ্চ নাটকে মহানবীকে কটুক্তি মামলা

নয় বছর পর রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা পুনঃতদন্তে, বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে

২০২১ জানুয়ারি ০৭ ১৮:৪৩:১৮
নয় বছর পর রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা পুনঃতদন্তে, বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের ফতেপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে মঞ্চস্ত হুজুরে কেবালা নাটকে মহানবীকে কটুক্তি করা হয়েছে দৈনিক দৃষ্টিপাত পত্রিকার এক মিথ্যা খবরের ভিত্তিতে দায়েরকৃত মামলাটি গোয়েন্দা পুলিশে পুনঃতদন্ত দেওয়া হয়েছে। বৃহষ্পতিবার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম জিয়ারুল ইসলাম এ আদেশ দেন।

ঘটনার বিবরণে জানা যায়,সাধীনতা দিবস উদযাপন উপলক্ষে ২০১২ সালের ২৭ মার্চ কালীগঞ্জের ফতেপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে মঞ্চস্ত ‘হুজুরে কেবালা’ গল্পের নাট্যরুপে মহানবীকে কটুক্তি করা হয়েছে বন্দকাটি গ্রামের কুখ্যাত হরিণ শিকারী সাত্তার মোড়লের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যুবলীগ নেতা মামুনুর রশিদ মিণ্টুর মিথ্যাচারে ২৯ মার্চ দৈনিক দৃষ্টিপাত পত্রিকার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ৩০ মার্চ দুপুর একটার দিকে বিএনপি নেতা ও কয়েকটি নাশকতার মামলার আসামী নুরুজ্জামান পাড় শিক্ষক মিতা রানী বালাকে মোটর সাইকেলে করে বাড়ি থেকে তুলে এনে পুলিশে সোপর্দ করেন। পরে প্রধান শিক্ষক রেজোয়ান হারুন ও ছাত্র সাঈদুর রহমানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওইদিন বিকেলে দক্ষিণ শ্রীপুর ইউপি সদস্য জাফর সাঁফুইকে দিয়ে নাটক পরিচালনাকারি মীর শাহীনুর রহমানসহ সাত জনের নামে থানায় মামলা করান তৎকালিন কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ ফরিদউদ্দিন।

মহানবীকে কটুক্তি করার গুজবে কৃষ্ণনগর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ২০১৮ সালে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত মোশারফ হোসেন ও তৎকালিন কৃষ্ণনগর ইউপি চেয়ারম্যান আনছারউদ্দিন(প্রয়াত) ও চৌমুহুনী ফাজিল মাদ্রাসার তৎকালিন সুপার আব্দুল কাদের হেলালীর নেতৃত্বে দু’টি মিছিল ৩১ মার্চ সকালে ফতেপুর মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়, শাহীনুর মীর, বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সদস্য আব্দুল হাকিম, শিক্ষিকা মিতা রানী বালা ও লক্ষীপদ মণ্ডলের বাড়ি মিতা রানী বালাসহ কয়েকজনের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ফতেপুর সাংস্কৃতিক পরিষদ ভাঙচুর ও লুটপাটের পর আগুণ দেওয়া হয়।

লক্ষীপদ মণ্ডল ও মিতা রানী বালার বাড়িতে দ্বিতীয় দফা অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দেন জাপা নেতা জুলফিকার সাঁফুই, তার ভাই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার বাদি জাফর সাঁফুই, বিষ্ণুপুর হাইস্কুলের নৈশ প্রহরী সামছুর রহমানের ছেলে জামায়ত ক্যাডার রবিউল ইসলাম। জেলে থাকা মিতা রানী বালার ছোট ছেলে অনির্বানকে আগুনে ছুুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করলে তার বাড়িতে থাকা এনজিও কর্মী চায়না দাসের বাধার মুখে সেযাত্রায় অনির্বাণ রক্ষা পায়।

ফতেপুরের সহিংসতার জের ধরে ২০১২ সালের পহেলা এপ্রিল চাকদহ গ্রামের কাপালিপাড়ায় মহানবীকে কটুক্তি সংক্রান্ত আনোয়ারা খাতুনের মিথ্যাচারে ফতেপুরের লক্ষীপদ মণ্ডলের মেয়ে নমিতা সরদারের কথার সত্যতা যাঁচাই এর নামে গণপতি গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা ফিরোজ কবীর কাজল, বিএনপি নেতা গোলাম মাসুদ, যুবলীগ নেতা রিয়াজুল ইসলাম খোকা, কালীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক এমদাদ হোসেন, সহকারি উপপরিদর্শক বসির আহম্মেদসহ কয়েকজনের উস্কানিতে নমিতা সরদারসহ আটটি হিন্দু বাড়িতে লুটপাট ও ভাঙচুর করে তাদের সর্বস্ব প্রেট্রোল ঢেলে আগুণ ধরিয়ে দেওয়া হয়। বাড়িতে আগুণ লাগিয়ে দেওয়ার পর চাকদাহ গ্রামের এক হিন্দু গৃহবধু পালিয়ে বিচালী গাদার মধ্যে অবস্থান নিলে তাকে ধর্ষণ করা হয়। এর পর থেকে তার শ্বাশুড়ি পাগল প্রায়।

সহিংসতার সকল ঘটনায় ৫ এপ্রিল দায়েরকৃত চারটি মামলায় ৯৪ জনের নামসহ অজ্ঞাতনামা দু’ হাজার ২০০ লোককে আসামী শ্রেণীভুক্ত করা হয়। কর্তব্যে অবহেলার দায়ে কালীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক ও বর্তমানে সাতক্ষীরার পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লস্কর জায়াদুল হককে বাগেরহাটে স্ট্যাণ্ড রিলিজ করা হয়।

আইন ও শালিস কেন্দ্রের তদন্তকারি সেলের সদস্য ও বামপন্থী নেতারা ফতেপুর ও চাকদাহের সহিংসতা কবলিত বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানগুলি পরিদর্শণ করে শিক্ষক ও ছাত্রদের গ্রেফতারের নিন্দা জানান। একইসাথে তারা ক্ষতিগ্রস্তদের পূর্ণবাসন, দোষীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানান।

৮ এপ্রিল তৎকালিন পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান খান ও কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ ফরিদউদ্দিনকে প্রত্যাহার করা হয়। ১০ এপ্রিল তৎকালিন জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের নির্দেশে দৃষ্টিপাত পত্রিকার প্রকাশনা বাতিল করা হয়। ১২ এপ্রিল অস্ত্রধারি শিবির ক্যাডার দৃষ্টিপাত পত্রিকার সাংবাদিক মিজানুর রহমানকে গাজীপুর সদরের একটি ব্যাচেলার ছাত্রবাস থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২৫ এপ্রিল তৎকালিন পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান খান ও কালীগঞ্জ থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ ফরিদউদ্দিনকে হাইকোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ভৎর্সনা করা হয়। ঘটনার তদন্তে হাইকোর্ট একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠণের নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই বছরের ১২ জুন অতিরিক্ত যুগ্ম সচীব একেএম জহরুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি সাতক্ষীরা সার্কিট হাউজে তদন্ত করেন। সহিংসতার মামলা থেকে অব্যহতি দেওয়া ও মামলায় অন্তর্ভুক্ত করার নামে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও পুলিশ বাণিজ্যের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা আদার করে বলে অভিযোগ ওঠে।

২০১৩ সালের ৩০ জুলাই কালীগঞ্জ থানার তদন্ত ওসি আক্তারুজ্জামান জাফর সাঁফুই এর দায়েরকৃত শিক্ষক, ছাত্র ও নাট্যকারের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় (জিআর-৭৯/১২ কালীগঞ্জ) আদালতে চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। বাদির নারাজির আবেদন খারিজ হলে তিনি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন করলেও সেটিও খারিজ হয়ে যায়।

ফতেপুর ও চাকদাহের ঘটনায় দায়েরকৃত তিনটি মামলায় ২০১৩ সালের শেষের দিকে আদালতে পুলিশ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের তৎকালিন পিপি ও বর্তমানে সাংসদ অ্যাড. মুস্তফা লুৎফুল্লাহ আদালতে না রাজির আবেদন দাখিল করেন। এ সহিংসতার উস্কানিদাতা হিসেবে দৃষ্টিপাত পত্রিকা কর্তৃপক্ষসহ মূল হোতাদের বিরুদ্ধে যুবলীগ নেতা খলিলুর রহমানের দায়েরকৃত মামলায় (জিআর - ৮৪/১২ কালীগঞ্জ) ও সমাজ সেবক মৌতলার মীর আক্তার হোসেনের দায়েরকৃত সাধারণ ডায়েরীটি আমলে নিয়ে ২০১৪ সালের ৩০ জুলাই উপপরিদর্শক নকীব অয়জুল হক আদালতে ( ধারা-১৫৩/২৯৫-ক/১২০-৮/৩৪ পিসি) দৃষ্টিপাত সম্পাদক জিএম নূর ইসলাম, নির্বাহী সম্পাদক আবু তালেব মোল্লা, তৎকালিন বার্তা সম্পাদক ডিএম কামরুল ইসলাম, দক্ষিণ শ্রীপুর প্রতিনিধি অস্ত্রধারি শিবির ক্যাডার মিজানুর রহমান, ফতেপুরের আল আমিন তরফদার ও যুবলীগ নেতা নীলকণ্ঠপুর গ্রামের মামুনর রশীদ মিন্টুর নাম উল্লেখ করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়েই অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে এ তথ্য গোপন করে আসামী মিজানুর রহমানের এক আবেদনের (মিস- ২৯৪৬৫/১৪) প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের বিচারক শওকত হোসেন ও বিচারক ফরিদ আহম্মেদ ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর এ মামলার াবচার কার্যক্রম ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেন। পরবর্তীতে কয়েক দফায় স্থগিতাদেশ বাড়ানোর পর ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি স্থগিতাদেশ বাতিল হয়ে যায়। আসামী মিজানুর রহমান হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ২১ আগষ্ট সুপ্রিম কোর্টে ১১৫৬/১৭ নং ক্রিমিনাল মিস আপিল দায়ের করলে ২০১৯ সালের ১০ জুলাই তা খারিজ হয়ে যায়। এর ১৬ মাস পর গত ৪ জানুয়ারি বাদির নারাজী আবেদন শুনানী শেষে বৃহষ্পতিবার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম এ রায় দেন।

ফতেপুর ও চাকদাহের ক্ষতিগ্রস্ত ১২টি হিন্দু পরিবারের সদস্যরা জানান, পাঁচটির মধ্যে একটি মামলার বাদি বিষ্ণুপুর ইউপি সদস্য খলিলুর রহমান রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার চার্জশীটভুক্ত দৃষ্টিপাত পত্রিকা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা নিয়ে আদালতে নারাজি দেন। এ ছাড়া সহিংসতার অপর তিনটি মামলা চলছে কচ্ছপ গতিতে। জিআর-৮৪/১২ মামলার বিচার বিলম্বিত করতে নেপথ্যে সর্বনাশা দৃষ্টিপাত কর্তৃপক্ষের হয়ে দু’জন সাংসদ ,একজন সাবেক পিপি, কয়েকজন দাপুটে সাংবাদিকসহ কয়েকজন রাজনীতিবিদ অংশ নেয়। এসব সহিংসতার মামলার আদৌ কোন দিনও বিচার হবে বলে তারা মনে করেন না।

সাতক্ষীরা জজ কোর্টের অতিরিক্ত পিপি অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, তথ্য গোপন করে হাইকোর্টে ও সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে মামলার বিচার দীর্ঘায়িত করা হয়েছে। এরপরও মামলার বাদি ক্ষতিগ্রস্তদের কোন আত্মীয় না হওয়া, ক্ষতিগ্রস্তদের গ্রামের বা ইউনিয়নের বাসিন্দা না হয়েও বিষ্ণুপুর ইউপি সদস্য যুবলীগ নেতা খলিলুর রহমান অভিযোগপত্র দাখিলের আড়াই বছর পর আদালতে নারাজি দাযেরের বিষয়টি রাষ্ট্রপক্ষ আদালতকে যথাযথভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়নি। ফলে মামলাটি পূণঃতদন্তে গেছে বলে তিনি মনে করেন।

তাছাড়া এতবড় ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশে একজন যুগ্মসচিবের নেতৃত্বে তদন্ত প্রতিবেদনটি দাখিল করা হলেও হাইকোর্টের ওই বেঞ্চ ভেঙে যাওয়ায় নতুন করে অন্য আদালতে উপস্থাপন করা যেতো। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থতায় ওই তদন্ত প্রতিবেদন আর আলোর মুখ দেখেনি। এ ছাড়া রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামী নীলকণ্ঠপুরের যুবলীগ নেতা মামুনুর রহমান মিন্টুর মোটর সাইকেলে চড়ে আওয়ামী লীগ নেতা ও বিষ্ণুপুর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ রিয়াজউদ্দিন জেলা ও জেলার বাইরে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ালে ক্ষতিগ্রস্তরা ন্যয় বিচার পাওয়ার আশা হারিয়ে ফেলা ছাড়া আর কি থাকতে পারে?

সাতক্ষীরা আদালতের পুলিশ পরিদর্শক অমল কুমার রায় দৃষ্টিপাত সম্পাদক জিএম নূর ইসলামসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিলের মামলাটি গোয়েন্দা পুলিশের কাছে পূণঃতদন্তে পাঠানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন।

(আরকে/এসপি/জানুয়ারি ০৭, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

১৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test