E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সাতক্ষীরা পৌরসভা নির্বাচনে আ. লীগের বিপর্যয়ের দায় কার?

২০২১ ফেব্রুয়ারি ১৫ ১৭:৫৮:১১
সাতক্ষীরা পৌরসভা নির্বাচনে আ. লীগের বিপর্যয়ের দায় কার?

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরা পৌরসভায় মেয়র প্রার্থী হিসেবে জেলা বিএনপি’র সাবেক সাংগঠণিক সম্পাদক তাসকিন আহমেদ চিশতি ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ২৫ হাজার ৮৮ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেছেন। অপরদিকে ১৩ হাজার ৫০ ভোট পেয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী শেখ নাসিরুল হক। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সাবেক যুবদল নেতা নাসিম ফারুক খাঁন মিঠু পেয়েছেন ১৩ হাজার ২২১ ভোট। জেলা জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারী নুরুল হুদা পেয়েছেন ২৮৮৮ ভোট ও ইসলামিক শাসনতন্ত্র আন্দোলনের আব্দুর রউফ পেয়েছেন ১৬৭৯ ভোট। মোট ভোটার ছিল ৮৯ হাজার ২২৪। ভোট পড়েছে ৫৫ হাজার ৯২৬ টি।

সাধারণ কর্মীরা মনে করেন দ্বিতীয় ধাপে অনিয়মের অভিযোগের মধ্যে কলারোয়া পৌরসভা নির্বাচনে নৌকার বিজয় লাভে সাতক্ষীরার নেতা কর্মীদের আত্মসন্তুষ্টিতে ভোগা, দলীয় নেতা কর্মীদের সমন্বয়হীনতা, চারদলীয় ভোট ব্যাংকে আঘাত হানতে ব্যর্থ হওয়া, জামায়াত ও বিএনপি উভয়দলের প্রার্থী থাকার পরও দু’দিন আগে সমঝোতা হওয়া, পৌর নির্বাচনে গঠিত কমিটির কয়েকজন সদস্যের ভোটারদের কাছে যথেষ্ঠ পরিচিতি না থাকা, নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব, পুলিশ প্রশাসনের বৈরী মনোভাব ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুনসুর আহমেদ এর মৃত্যুই সাতক্ষীরা পৌরসভায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রাথী শেখ নাসেরুল হকের পরাজয়ের অন্যতম কারণ।

রোববার সকাল ৮টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত সাতক্ষীরা পৌরসভার বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে যেয়ে দেখা গেছে সকাল থেকে নারী ও পুরুষ ভোটারদের নাতিদীর্ঘ লাইন লক্ষ্য করা যায়। অনেককে বলতে শোনা গেছে দুপুর ১২টার পর আর ব্যালট পাওয়া যাবে না। শুধুমাত্র আঙুলে কালি লাগিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। তাই সকাল সকাল ভোট দিতে এসেছি। তারা ভোট দেওয়ার পর শতভাগ সুন্দর ভোট হচ্ছে এমন প্রচার হয়ে যাওয়ায় ধানের শীষ ও সাবেক যুবদল নেতার নারিকেল গাছ প্রতীকের নেতা কর্মীরা বাড়ি বাড়ি লোক পাঠিয়ে ব্যাটারিচালিত ভ্যানে বা ইজিবাইকে ভোটার আনার ব্যবস্থা নেন। সাবেক জামায়াত নেতার পক্ষে নীরবতার কারণে ধানের শীষে ভোট বাড়তে থাকে। অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে নৌকার ব্যাজ বুকে লাগিয়ে ধানের শীষে ভোট দিয়েছেন নির্বিঘ্নে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নৌকা মার্কার পক্ষের কর্মীরা বুথ এলাকায় অবস্থান নিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছেন।

আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী মাঠপাড়ার আসাদুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের অধিকাংশই নৌকার সঙ্গে তাকে ভোট দেওয়ার কথা না বলে মেয়রের ভোট যাকে পারবেন তাকে দেবেন, অন্ততঃ কাউন্সিলর প্রাথী হিসেবে তাকে ভোটটি দেওয়ার জন্য ভোটারদের কাছে অনুরোধ করেছেন। নৌকা প্রতীকের পক্ষে যে নির্বাচন কমিটি গঠণ করা হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্ততঃ তিনজনের শহরে পরিচিতি যথেষ্ট কম ছিল। ফলে তারা নিজের দলের নেতা কর্মীদের উপর প্রভাব ফেলতে পারেননি। পারেননি প্রতিপক্ষের ভোটারদের কাছে টানতে। এ ছাড়া দলীয় নেতা কর্মীদের মধ্যে ছিল সমন্বয়ের অভাব। এ সুযোগে বিরোধী দলীয় সমর্থকরা লাইনে দাড়িয়ে বুকে নৌকার ব্যাচ পরে নির্বিঘেœ ধানের শীষে বা নারিকেল গাছ প্রতীকে ভোট দিয়েছেন।

নৌকার পক্ষে সক্রিয় কর্মী হিসেবে লস্করপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাজ করা রবিউল ইসলাম বলেন, কোন বাধা ছাড়াই ভোট হচ্ছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে বিএনপি জামায়াত কর্মীরা বাড়ি বাড়ি যেয়ে ভ্যানে ও ইজিবাইকে ভোটার নিয়ে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। অনেকেই নৌকার ব্যাচ পরে বুথে ঢুকে ধানের শীষের বোতাম টিপেছেন।

সুলতানপুরের আওয়ামী লীগ কর্মী কাজী সাঈদুজ্জামান বলেন, পরাজয়ের দোষ অন্য কারো নয়, অতিরিক্ত আত্ম বিশ্বাস ও একলা চলো নীতিই আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয়ের মূল কারণ।

বিশিষ্ঠ মানবাধিকার কর্মী মাধব চন্দ্র দত্ত মনে করেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সঙ্কট, নৌকা প্রার্থীর তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে জনসম্পর্ক গড়ে না ওঠা, সর্বোপরি মৌলবাদি চেতনা মুক্তিযুদ্ধের ও প্রগতিশীল চেতনার বিরুদ্ধে এক জোট হয়ে কাজ করায় সাতক্ষীরা পৌরসভায় নৌকার পরাজয় হয়েছে।

জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠণিক সম্পাদক ও বর্তমানে জেলা কমিটির সদস্য ফিরোজ হোসেন বলেন, রোববারের নির্বাচনে পুলিশ জামায়াত বিএনপি’র প্রার্থীদের পক্ষে থেকে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের উপর হামলা চালিয়েছে। প্রতিবাদ করতে যেয়ে মাঠপাড়া নবনূর মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে তিনি, ছাত্রলীগ নেতা মিন্টু ও সালামসহ ৫জন আহত হয়েছেন। আগরদাঁড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শহরের রসুলপুর বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রে পুলিশের উপস্থিতিতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। সেক্ষেত্রে দলীয় নেতারা যথাযথ ভূমিকা রাখতে না পারায় দলীয় কর্মীদের মনোবল ভেঙে যায়।

জানতে চাইলে সাতক্ষীরা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দলীয় প্রতীক নিয়ে মেয়র পদে পরাজিত শেখ নাসিরুল হক বলেন, সাতক্ষীরা আওয়ামী লীগের জামায়াত বিএনপি’র ভোট ব্যাংক ভাঙার শক্তি নেই। ধানের শীষ ও নারিকেল গাছ প্রার্থীর অর্থনৈতিক অবস্থার কাছে তিনি প্রায় জিরো। তাছাড়া শেষ রাতেই জগ প্রতীকের প্রার্থী সাবেক জামায়ত নেতা নুরুল হুদার সঙ্গে ধানের শীষের সমঝোতা হয়ে যায়। ফলে জামায়াতের ভোটের অধিকাংশই পড়ে ধানের শীষে। এ ছাড়া বাবার মত অভিভাবকের দায়িত্ব পালনকারি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মুনসুর আহমেদ এর আকষ্মিক মৃত্যু ভোট বাক্সে প্রভাব ফেলেছে। তবে তিনি কোনভাবেই নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে চাননি। নেতা কর্মীদের উপর সন্তুষ্ট হওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, পুলিশ রাষ্ট্রীয় কর্মচারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। তবে নৌকা প্রতীকে ভোট না করে ব্যক্তি হিসেবে ভোট করলে তিনি হয়তো বা বেশি ভোট পেতেন।

জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা ফিরোজ কামাল শুভ্র বলেন, তিনটি চোরাচালানি সিণ্ডিগেট আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করেছে। আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশের ভোট নারিকেল গাছ প্রতীকে পড়েছে। তা ছাড়া ভোটে অর্থনৈতিক প্রভাব পড়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের আত্মসন্তষ্টিতে ভোগা, প্রশাসন নিরপেক্ষতা হারানো ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে বসাবসি না হলেও বাস্তবায়ন না হওয়াটাই সাতক্ষীরা পৌরসভায় নৌকার পরাজয় হয়েছে।

জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবু মনে করেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুনসুর আহমেদ এর মৃত্যু পৌরভোটে প্রভাব না ফেললেও প্রশাসনের বৈরি আচরণ, দলীয় নেতা কর্মীদের সমন্বয়হীনতা ও আন্তরিকতার ঘাটতি নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে। পৌরভোটের জন্য গঠিত নির্বাচন কমিটির তিনজনের পরিচিতি কম থাকায় ভোটে তার প্রভাব ফেলেছে।

বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সাতক্ষীরা জেলা শাখার সম্পাদক অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, সমন্বয়হীনতা, আন্তরিকতা ও দূরদর্শিতার অভাবের কারণে নৌকার পরাজয় হয়েছে। সারা দেশে পৌর নির্বাচনে প্রশাসন যেভাবে কাজ করেছে সাতক্ষীরা পৌরসভায় তার ভিন্নতা লক্ষ্য করা গেছে। পৌরভোটকে কেন্দ্র করে জানুয়ারি মাসের শেষের দিক মহাজোটের নেতৃত্ব পর্যায়ে সভায় জাতীয় পার্টি তিনটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী মনোনয়নে আওয়ামী লীগের সমর্থন চেয়েছিল। সব মিলিয়ে ৪ ফেব্র“য়ারি জাপা, আওয়ামী লীগ ও ওয়ার্কার্স পার্টির জেলার উচ্চ পর্যায়ের সমন্বয় সভা হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। এরপরও নতো কর্মীদের আত্মসন্তুষ্টিতে ভোগার কারণে ও ভোটে কালো টাকার প্রভাব পড়ায় নৌকা প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে।

জাতীয় পার্টির সাতক্ষীরা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আশরাফুজ্জামান আশু বলেন, সাতক্ষীরায় অধিকাংশ সময় এন্টি আওয়ামী লীগাররা ক্ষমতায় থেকেছে। আগে তারা ১৪ দলে থাকলেও এখন তারা বিরোধী দল। এরপরও সমন্বয়ের অভাবে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীরা সংগঠিত হতে পারেনি। পুলিশের ভূমিকা নিরপেক্ষ ছিল দাবি করে তিনি বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির মৃত্যু একটা শূণ্যতা সৃষ্টি করেছে।

সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ নজরুল ইসলাম বলেন, সাতক্ষীরা সদরে চার বার জামায়ত ও বিএনপি’র সাংসদ ছিল। এখারকার জনগনের একটি বড় অংশ ভারত থেকে মাইগ্রেটেড। ফলে তারা আওয়ামী বিরোধী। তারা জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য পার্টিতে ভোট দেয়। আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা যথেষ্ট ভালো প্রার্থী শেখ নাসিরুল হকের পক্ষে কাজ করলেও অনেক নেতা কর্মী পৌর আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী হওয়ায় তারা নিজেদের ভোট করতে যেয়ে মেয়র প্রার্থীর জন্য কাজ করতে পারেননি। ফলে নৌকার পরাজয় হয়েছে।

প্রসঙ্গত,২০১৫ সালে সাতক্ষীরা পৌরসভা নির্বাচনে ভোটার ছিল ৭৯ হাজার ৬৩৪টি। ভোট পড়ে ৫১ হাজার ৬২০টি। বিএনপি মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থী তাসকিন আহম্মেদ চিশতি ১৬ হাজার ৪৭০ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী শেখ আজাহার হোসেন পেয়েছিলেন ১২ হাজার ৮৮৩ ভোট। যুবদল নেতা নাসিম ফারুক খান মিঠু পেয়েছিলেন ১২ হাজার ৫৩২ ভোট। সাতক্ষীরা পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেন নৌকা প্রতীকে পেয়েছিলেন নয় হাজার ৭২ ভোট।

(আরকে/এসপি/ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test