E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

রাজারহাটের ‘সেনপাড়া শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ শুধুই স্মৃতি

২০২১ মার্চ ০৬ ১৫:০২:৩৭
রাজারহাটের ‘সেনপাড়া শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ শুধুই স্মৃতি

প্রহলাদ মন্ডল সৈকত, রাজারহাট (কুড়িগ্রাম) : কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের সেনপাড়ায় ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী ও তার দোসররা গ্রামের মানুষকে জড়ো করে নৃসংশভাবে হত্যা করে। হত্যা যজ্ঞ ও লুটপাটের পর আগুন দিয়ে ভস্মিভূত করে পুরো গ্রাম। সেই গ্রামের গ্রামবাসীরা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই শহীদদের স্বরণে নিজ উদ্যোগে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করে “সেনপাড়া গণহত্যা দিবস” পালন করে আসছে। কিন্তু সরকারিভাবে দু’এক বার পালন করা হলেও এখন পড়ে আছে অবহেলা আর অযত্নে। কেউ খোঁজ রাখেনি নিভৃত পল্লীতে গড়ে উঠা শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ ও শহীদ পরিবারদের।

’৭১এর সেই ভয়াল দিনের মৃত্যু পুরি থেকে বেঁচে উঠা সপুর(৭৫), সুরোদ (৬৬)সহ বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে পাওয়া গেছে সেনপাড়া গণহত্যার বিচিত্র তথ্য। তারা জানায়, রাজারহাট উপজেলা থেকে ৭কিলোমিটার পশ্চিমে ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের একটি নিভৃত পল্লী সেনপাড়া গ্রাম। সেদিন ছিল ১৯৭১ সালের (৩ আষাঢ়) শুক্রবার। সূর্য্য তখনো হেলে পড়েনি।

সেনপাড়া গ্রামের সবুজ শ্যামল প্রান্তরে সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়েছে মাত্র। আচমকা ধরনী কাঁপিয়ে গর্জে উঠে হানাদার বাহিনীর মর্টার ও স্টেনগান। বৃষ্টির মতো গুলি চলে। জিবন বাঁচানোর তাগিদে কেউ জঙ্গলে, কেউ বা ধান ক্ষেতে লুকিয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে পাকহানাদার ও তার দোসর আলবদর-রাজাকার বাহিনী ওই গ্রামটি ঘিরে ফেলে। হায়নারা বাড়ি বাড়ি তল্লাসী করে মানুষদের ধরে নিয়ে এসে সমাবেত করে গ্রামের একটি পুকুর পাড়ে। পৈশাশ্চিক নির্যাতনের পর তাদেরকে একত্রিত করে সারিবদ্ধ করে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে।

জষণ্যতম বর্বরতা চালিয়ে হত্যাকান্ড সংঘটিত ও লুটপাটের পর প্রায় ২শতাধিক বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। মুহূর্তে আগুনের লেলিহান শিখায় ভস্মিভূত হয় সম্পুর্ণ গ্রাম। পাকিস্তানী বাহিনীর এ নির্মম বর্বরোচিত হত্যা যজ্ঞের এ দৃশ্য পালিয়ে থাকা লোকজন দেখলেও তারা আর ফিরে আসেনি নিজ বসত ভিটায়। তারা আশ্রয় নেয় দেশের বিভিন্ন স্থান সহ ভারতে। হানাদাররা যাওয়ার সময় সব লাশগুলো পুতে ফেলে ওই পুকুর পাড়ে। বেদনাবিধুর গণহত্যার স্থানে এলাকাবাসীরা নিজ উদ্যোগে নির্মিত করে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতি স্তম্ভ।

৬ মার্চ শনিবার সরেজমিনে গিয়ে এলাকার লোকজনদের কাছ থেকে সেদিনের পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার ৫ জনের নামের তালিকা পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের সহায়তাকারী এই শহীদরা হচ্ছেন- অশ্বিনী বিশ্বাস, খোকা সেন, দেবেন্দ্র সেন, নারায়ন বিশ্বাস ও কান্দুরা সেন। রাজারহাট উপজেলাধীন সেনপাড়া মৃত প্রায় একটি জনপদ। ’৭১এর জ্বলজ্বালে স্মৃতি আজো যেন জ্বলে আছে গ্রামটিতে। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী ঘনবসতিপূর্ণ হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই ভারতে পাড়ি জমিয়েছে। যারা রয়েছে তারা আজো ভূলতে পারেনি সেদিনে কথা।

গুড়ড়ে গুমড়ে কেঁদে উঠে এ জনপদের মানুষ। পাকহানাদার বাহিনীর হাতে নিহত দেবেন্দ্র সেনের বিধবা স্ত্রী সাবিত্রী সেন(৯৮) স্বামীর কথা বলতে গিয়ে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে। মেহেদীর রং মুঁছতে না মুঁছতেই তিনি অবুঝ শিশু আর স্বামীর স্মৃতি বুকে নিয়েই দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েছেন। পুত্র বিরেন্দ্রনাথ(৬৫) বাবার কথা মনে করে এখনো বুক ভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তার বড় দুঃখ স্বাধীনতা পর প্রায় ৫০ বছর অতিবাহিত হলেও তাদের কেউ খোঁজ রাখেনি।

রাজারহাট উপজেলার মুক্তিযোদ্ধার সাবেক কমান্ডার মোঃ রজব আলী বলেন, তিস্তা-রাজারহাট রেল সড়কের পাশে সেনপাড়া গ্রাম। পাকবাহিনীরা রেলযোগে এসে প্রথমেই ওই গ্রামটিতে ঢুকে হিন্দুদের ধরে গুলি করে হত্যা করেছিল। সেখানে যুদ্ধের এলাকাবাসীরা গণকবরের স্মৃতি স্তম্ভ তৈরি করে সেনপাড়া গণহত্যা দিবস পালন করতো।

(পিএস/এসপি/মার্চ ০৬, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test