E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

মা-বাবার আদর বঞ্চিত ছেলেটি কোরআনে হাফেজ হতে চায়

২০২১ এপ্রিল ২২ ১৩:৪৯:১০
মা-বাবার আদর বঞ্চিত ছেলেটি কোরআনে হাফেজ হতে চায়

উজ্জ্বল হোসাইন, চাঁদপুর : নভেম্বর মাসের কোনো এক শীতের রাত। আকাশে বজ্রপাতের গর্জন। হালকা বৃষ্টি পড়ছে। চারদিকে নীরবতা। হঠাৎ এক যুবক দুই শিশু নিয়ে হাজির চাঁদপুর কমিউনিটি পুলিশিং (সাবেক ছায়াবাণী) জেলা কার্যালয়ে। ওরা শীতে কাঁপছিল। আমি আমার দিকে এগুতে বললে দেখি তাদের শরীরটা একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে। গায়ের পোশাকগুলো ভিজে গেছে। খুব দ্রুতই তাদের গায়ের পোশাক পরিবর্তন করে আমার সাধ্যমত গরম কাপড় দিয়ে তাদের জড়িয়ে দিই। কথাগুলো বলছেন চাঁদপুর জেলা কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুফী খায়রুল আলম খোকন।

তিনি আরো বলেন, যুবকটি জানালো এ দুই শিশু চাঁদপুর শহরের রুচি হোটেলে গ্লাস বয়ের কাজ করতো। এ কাজ তাদের ভালো লাগে না। তারা আর কাজ করবে না বলে হোটেল থেকে বেরিয়ে যায়। শিশু দুটির সাথে ওই যুবকের সাক্ষাৎ হয়। সে সুবাদেই আমার কাছে আসা। আমি তাৎক্ষণিক রুচি হোটেলের মালিকের সাথে কথা বলে তাদের বুঝিয়ে আবার দিয়ে আসি। এদিকে এদের পিতা-মাতার খোঁজ করতে থাকি। কয়েকদিন হয়ে গেলো কোনো খোঁজ মেলেনি। পরে ২৩ ডিসেম্বর (২০২০) আমার ফেসবুক একাউন্ট থেকে আরাফাত ও আব্দুল আহাদকে নিয়ে একটি পোস্ট করি। এভাবে ফেসবুকে আরাফাত (৮) ও আব্দুল আহাদ (১০) নামে দু’ভাইয়ের ছবিটি ব্যাপক ভাইরাল হয়। তাদের ঠিকানাবিহীন জীবন। পথেই তাদের ঘর, পথেই তাদের বসতি। আর এভাবেই চলছিল তাদের জীবন।

তাদের পিতা-মাতার সন্ধান পেলেও কেউ আসেনি। আমি হতবাক হয়ে যাই। ওরা কেমন বাবা-মা ছেলেদের জন্যে আসেনি। আমার ফেসবুকে আল-আমিন এতিমখানা কমপ্লেক্সের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মোঃ আবদুর রহমান গাজী কমেন্ট করে জানালেন দায়িত্ব আমি নিতে চাই। পরক্ষণে আব্দুল আহাদ ও আরাফাতকে পড়াশোনার জন্য উদ্বুদ্ধ করি। এতে আরাফাত সম্মতি দিলেও আব্দুল আহাদ রাজি হয়নি।

তিনি বলেন, ২০২১ সালের ২ জানুয়ারি চাঁদপুর পৌরসভার বঙ্গবন্ধু সড়কস্থ ঘোড়ামারা আশ্রয়ণ প্রকল্প সংলগ্ন আল-আমিন এতিমখানা কমপ্লেক্সের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এএসএম শফিকুর রহমান ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মোঃ আবদুর রহমান গাজীর হাতে তুলে দিই আরাফাতকে।

এতিমখানা কমপ্লেক্সের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এএসএম শফিকুর রহমান জানান, ১৯৯৩ সালে প্রফেসর মোহাম্মদ আবদুল্লাহ এ এতিমখানা কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ প্রতিষ্ঠানের ১ একর ৯২ শতাংশ ভূমি রয়েছে। এ কমপ্লেক্স ঘিরে রয়েছে মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, হাসপাতাল, খেলার মাঠ ও এতিমদের জন্য ছাত্রাবাস। ভবিষ্যত পরিকল্পনা রয়েছে এতিমদের কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা করার।

বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মাওলানা মোঃ আবদুর রহমান গাজী জানান, এ এতিমখানায় ২৩ জন এতিম ও ১২ জন ছাত্র আছে। তাদের চাহিদা অনুযায়ী কেউ স্কুল, মাদ্রাসা ও হিফজ বিভাগে পড়ার সুযোগ রয়েছে। দুস্থ ও অসহায় ক্যাটাগরিতে আরাফাত বর্তমানে আল-আমিন এতিমখানার তত্ত্বাবধানে রয়েছে। তার ইচ্ছে অনুযায়ী সে নূরানীতে কোরআন পড়ছে। সে ভবিষ্যতে হাফেজে কোরআন হতে চায়। আরাফাতের দেয়া তথ্যে এক ফুপির সন্ধান মেলে।

তার ফুপি সামছি বেগম জানান, চাঁদপুর সদর উপজেলার শাহমাহমুদপুর ইউনিয়নের মহামায়া করবন্দ গ্রামের মেহের আলী মুন্সী বাড়ি আরাফাতের। তার বাবা মোঃ হুমায়ুন কবির মুন্সী, মাতা হালিমা বেগম। আরাফাতের বাবা প্রবাসে ছিলেন। তার বাবার সাথে মায়ের কোনো এক বিষয় নিয়ে বাক্-বিতন্ডা হয়। সে থেকেই তার মা তাদের রেখে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। এখন পর্যন্ত কোনো খবর মেলেনি। সে থেকেই সন্তানদের নেমে আসে এক দুর্বিষহ জীবন।

পরবর্তীতে তার বাবা আরেকটি বিয়ে করেন। এতে করেই তাদের আর খোঁজখবর নেয়া হয় না। যেখানে মা-বাবাই খবর রাখে না, সেখানে তাদের কে আগলে রাখবে? এভাবেই তারা একদিন বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। তাদেরকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে আমরা আল-আমিন এতিমখানার মাধ্যমে খোঁজ-খবর পাই। আরাফাতের বড় ভাই আব্দুল আহাদ অন্যত্র কাজ করে। আর আরাফাত এতিমখানায় নিয়মিত পড়াশোনা করছে। এতে আমরা খুব আনন্দিত এবং সার্বিক খোঁজখবর রাখতে চেষ্টা করছি। আমারতো সংসার আছে। আমিই চলি অনেক কষ্টে। যারা এই অসহায় ছেলেটিকে পড়ালেখার সুযোগ করে দিয়েছেন তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

বাবা-মায়ের আদর আর শাসন থেকে বঞ্চিত আরাফাত মাদ্রাসায় পড়াশোনা করবে। সে ভবিষ্যতে হাক্কানী হাফেজ কোরআন হতে চায়। সে বাবা-মাকে ফিরে পেতে চায়। সে অন্য ছেলেদের মতো বাবার আদর-সোহাগ কামনা করে। কিন্তু বাবা তাকে মোটেও পছন্দ করেনি বলে কেঁদে উঠে। তার মায়ের চেহারা ভুলে গেছে। এতিমখানায় অন্য ছাত্রদের মা যখন আসে, তখন আরাফাতও নীরবে কাঁদে।

(ইউ/এসপি/এপ্রিল ২২, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test