E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সাংবাদিক ফাগুন হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন করল পিবিআই

২০২১ জুন ১০ ১৭:৫৭:০০
সাংবাদিক ফাগুন হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন করল পিবিআই

রাজন্য রুহানি, জামালপুর : জামালপুর রেলওয়ে থানার বহুল আলোচিত শেরপুরের তরুণ সাংবাদিক ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন (২১) হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন করল পিবিআই। মামলাটি ১ বছর ৮ মাস পর রেলওয়ে পুলিশের কাছ থেকে পিবিআইয়ের কাছে আসার ৪ মাসের মধ্যেই হত্যার কারণ উদঘাটন করল তারা।

এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো এক আসামির জবানবন্দিতে উঠে এসেছে যে, হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল ৫ ব্যক্তি। এরা ট্রেনে সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের সদস্য।খাবারের সাথে ঘুমের বড়ি কিংবা চেতনানাশক দ্রব্য ব্যবহার করে যাত্রীদের অজ্ঞান করে টাকা-পয়সা, মোবাইলসহ মালপত্র হাতিয়ে নেওয়াই এদের কাজ।

সাংবাদিক ফাগুনের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে বলে জানিয়েছে পিবিআই। তবে ছিনতাইয়ের পর হত্যার বিষয়টিই রহস্যজনক এবং এর পেছনে কোনো গোষ্ঠীর ইন্ধন রয়েছে বলে দাবি করেছেন মামলার বাদী ফাগুনের পিতা কাকন রেজা।

বৃহস্পতিবার (১০ জুন) দুপুর ১২ টায় জামালপুরের পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কনফারেন্স রুমে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পুলিশ সুপার এমএম সালাহউদ্দীন।সেই সঙ্গে ফাগুনের পিতা ঘটনাটির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে পুলিশ সুপার এমএম সালাহউদ্দীন আরও জানান, মামলার ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ময়মনসিংহের তারকান্দা এলাকার আ. মজিদের ছেলে মো.সোহরাব মিয়া (৩৮)গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানার এক মামলায় (নং-৪৯, তাং- ১৪/০৯/২০২০ ইং, ধারা ৩২৮/৩৭৯/১০৯/৪১১দ. বি.) শ্রীপুর থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন।তাকে ফাগুন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর জন্য আবেদন করলে বিজ্ঞ আদালত আসামি সোহরাব মিয়াকে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখান।

বাদীর ছেলে ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন তেজগাঁও বিশ্ব বিদ্যালয় কলেজে বিবিএ প্রফেশনাল ২য় সেমিস্টারের ছাত্র ছিলেন। তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি সাব এডিটর হিসেবে সংবাদ মাধ্যম প্রিয় ডটকমে কর্মরত ছিলেন। ২০১৯ সালের ২১মে বিকেল অনুমান ৪টার সময় বাদীর ছেলে নিজ বাড়ি শেরপুরে আসার জন্য তেজগাঁও রেলষ্টেশন হতে জামালপুরগামী কমিউটার ট্রেনে উঠেন। ওই দিন সন্ধ্যা অনুমান সাড়ে ৭টায় বাদী তার ছেলে ইহসান ইবনে রেজা ফাগুনের মোবাইলে ফোন করে কথা বললে তিনি জানান যে, ময়মনসিংহের কাছাকাছি চলে এসেছেন। এর কিছুক্ষণ পর হতে ফাগুনের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

পরদিন জামালপুরের নান্দিনা রেলস্টেশনের কাছে রানাগাছা মধ্যপাড়া গ্রামের ছুট মিয়ার বাড়ির দক্ষিণ পাশে রেল লাইনেরউত্তর পাশেফাগুনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। জামালপুর রেলওয়ে থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য জামালপুর জেনারেল হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করে।এ ঘটনায় নিহতের পিতা বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে জামালপুর রেলওয়ে থানায় মামলা দায়ের করেন।

মামলাটি জামালপুর রেলওয়ে পুলিশ ০১ বছর ০৮ মাস সময়কাল তদন্ত করে এবং তদন্তাধীন অবস্থায় পুলিশ হেড কোয়াটার্সের মাধ্যমে পিবিআই জামালপুর জেলায় পরবর্তী তদন্তের জন্য প্রেরণ করা হয়।

পিবিআইয়ের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বিপিএম (বার), পিপিএম এর সঠিক তত্ত্বাবধান ও দিক-নির্দেশনায় পিবিআই জামালপুর ইউনিট ইনচার্জ পুলিশ সুপার জনাব এমএম সালাহ উদ্দীনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই (নিঃ) আলমগীর কবির মামলাটি তদন্ত করেন।

আসামি সোহরাব মিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান যে, তিনি প্রায় ৪ বছর ধরে গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানাধীন উত্তর মাওনা নয়নপুরে ভাড়া বাসায় থাকেন। তার সাথে আসামি মাজহারুল ইসলাম রুমান ও ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকেন। আসামি শফিক খান আন্তঃজেলা অজ্ঞান পার্টির সক্রিয় সদস্য ও ছিনতাইকারী।শফিক খানের নেতৃত্বে আসামি সোহরাব মিয়া, মাজহারুল ইসলাম রুমান, নজরুলও শফিকুল ইসলাম ট্রেনে ও বাসে নেশা জাতীয় দ্রব্য খাবারে মিশিয়ে কৌশলে যাত্রীদের খাইয়ে অজ্ঞান করে যাত্রীদের সাথে থাকা মোবাইল, টাকা-পয়সাসহ অন্যান্য জিনিসপত্র কৌশলে ছিনতাই/চুরি করেন।

ঘটনার দিন বিকেলে শফিক খানের বাড়িতে তারা সবাই মিলিত হন। বিকেল অনুমান ৫ টায় নয়নপুর (মাওনা) হতে আসামি সোহরাব মিয়া, শফিক খান, নজরুল, মাজাহারুল ইসলাম রুম্মান ও শফিকুল ইসলাম সিএনজিযোগে গফরগাঁও রেলস্টেশনে যান। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় তারা ট্রেনের একটা বগিতে উঠেন। ট্রেনে উঠার পর একজন ২০/২২ বছর বয়সী যুবককে (ফাগুন) তারা টার্গেট করেন। যুবকটি (ফাগুন) তখন তার সিটে বসে ল্যাপটপ চালাচ্ছিলেন। আসামি সোহরাব মিয়া, শফিক খানও রুমান ছেলেটির পাশে এসে দাঁড়ান। নজরুল ও শফিকুল দাঁড়ান পাশের সিটের কাছে। আউলিয়া নগর স্টেশনে ট্রেন এসে থামার পর ভিকটিমের পাশে বসা একজন লোক নেমে যায়। তখন শফিক খান ছেলেটির পাশে বসেন এবং ছেলেটির সাথে কথা বলে ভাব জমাতে থাকেন। সোহারাব মিয়া, রুমান ও শফিকুল ট্রেনের দুই সিটের ফাঁকা জায়গায় বসে তিন তাস খেলা শুরু করেন। তাদের মধ্যে নজরুল তিন তাস খেলায় পারদর্শী। ময়মনসিংহ রেল স্টেশনের কাছাকাছি ট্রেন আসলে তারা তাস খেলা বন্ধ করে দেন।

ময়মনসিংহ স্টেশনে ট্রেন এসে থামার পর তাদের বগি হতে অনেক যাত্রী নেমে যায়। নতুন করে উঠে ২/৩ জন যাত্রী। এ সময় শফিক খান আসামি সোহরাব মিয়ার হাতে ১০০ টাকা দিয়ে তাদের সবার জন্য কোক কিনে আনতে বলেন। সোহরাব ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্মের একটি দোকান হতে ১৫ টাকা করে ৬ টা কোকের বোতল কিনে ট্রেনে উঠেন এবং ১ টা বোতলের মুখ খুলে তার ভেতরে ঘুমের বড়ির গুড়া মেশান। এসব ঘুমের বড়ির গুঁড়ো তাদের সবার কাছেই থাকে। ট্রেনে ওঠার পর তা্রা প্রত্যেকে একটা করে বোতল নেন। শফিক খান ঘুমের বড়ির গুঁড়ো মেশানো বোতলটি ফাগুনকে খাবারের জন্য দিলে তিনি রাজি হননি। পরে সবাই মিলে অনুরোধ করলে ফাগুন কোকের অর্ধেক খেয়ে রেখে দেন। আসামি রোমান সেই বোতলটি ফেলে দেন।

ময়মনসিংহ স্টেশন হতে ট্রেন ছাড়ার পর ফাগুন তার ল্যাপটপ বন্ধ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখেন এবং পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটি বের করে কথা বলেন। তারপর আসামিরা সবাই মিলে ফাগুনের সাথে গল্প করতে থাকেন।

ট্রেন বিদ্যাগঞ্জ স্টেশনে থামার পর আরও কয়েকজন যাত্রী নেমে যায়।ফাগুন তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন হন। তখন আসামিরা ফাগুনের সঙ্গে থাকা মোবাইল ও টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পুরোপুরি অচেতন না হওয়ায় আসামিরা ফাগুনের সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিতে পারেনি। এরমধ্যে ট্রেন পিয়ারপুর স্টেশন হয়ে নুরুন্দি স্টেশনে এসে থামে। আসামিরা ও ফাগুন বাদে অন্যান্য সব যাত্রী নেমে যায়। নুরুন্দি স্টেশন হতে ট্রেন ছাড়ার পর আসামি সোহরাব ফাগুনের পকেট হতে কৌশলে মোবাইলটি নিয়ে নেন। রুমান ও শফিকুল ইসলাম ফাগুনের পকেটে থাকা ১২০০ টাকা নিয়ে নেন। আসামি শফিক খান ফাগুনের সঙ্গে থাকা ব্যাগ টান দিয়ে নিতে চাইলে ফাগুন উঠে দাঁড়িয়ে ট্রেনের দরজায় গিয়ে দুই হাতেব্যাগ ধরে রাখেন। আসামিরা সবাই ট্রেনের দরজার কাছে এসে দাঁড়ান। নুরুন্দি হতে ট্রেন নান্দিনা স্টেশনের কাছাকাছি আসার পর শফিক খান এবং রুমান দুজনে মিলে ফাগুনকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেন হতে লাইনের পাশে ঝোঁপের মধ্যে ফেলে দেন। ট্রেন নান্দিনা স্টেশনে আসার পর আসামিরা সবাই ট্রেন থেকে নেমে মেইন রোডে গিয়ে সিএনজিযোগে ময়মনসিংহ ব্রিজে যান।

আসামিরা ময়মনসিংহ হতে বাসে করে রাত অনুমান ১২টার দিকে গাজীপুর জেলাধীন মাওনা এলাকায় যান। আসামি শফিক খান প্রত্যেককে ২০০ টাকা করে দেন এবং আসামি সোহরাব মিয়াকে ফাগুনের মোবাইলটি বিক্রি করে দিতে বলেন এবং ল্যাপটপসহ ব্যাগটি আসামি শফিক খান নিজের কাছে রাখেন।পরদিন দুপুরে আসামি সোহরাব ফাগুনের মোবাইলে তার নিজের নামে রেজিঃকৃত সিমটি ভরে তিন দিন ব্যবহার করেন এবং বিক্রি করার চেষ্টা করেন। তিনি মোবাইলটি বিক্রি না করতে পেরে আসামি মাজাহারুল ইসলাম রুমানকে মোবাইলটি বিক্রি করার জন্য দেন। পরে রুমান মোবাইলটি ২৭০০ টাকায় জনৈক পারভেজের কাছে বিক্রি করেন।

পুলিশ সুপার এমএম সালাহউদ্দীন আরও বলেন, ঘটনায় জড়িত অন্যান্য আসামিদের গ্রেফতারসহ লুষ্ঠিত মালামাল উদ্ধার এবং হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্য কারো সংশ্লিষ্টতা আছে কি-না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

ফাগুনের পিতা কাকন রেজা জানান, একজন লোককে চেতনানাশক খাইয়ে সহজেই মালামাল লুট করা যায়। ট্রেন ও বাসে যারা এই কাজে জড়িত থাকেন তারা কেউই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করেন না বলে সাংবাদিক হিসেবে আমি জানি। এর পেছনে আরও ঘটনা আছে এবং পরোক্ষভাবে কেউ এই হত্যাকাণ্ডে রসদ যুগিয়েছেন। ফাগুনকে হত্যার আগে তার একটা অনুসন্ধানী নিউজের কারণে হুমকি এসেছিল। ওই গোষ্ঠীটাও এই হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।

(আরআর/এসপি/জুন ১০, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

১৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test