E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

স্বামীকে জজ পরিচয় দিয়ে প্রতারণা, শিক্ষিকা স্ত্রী শ্রীঘরে

২০২১ জুন ৩০ ১৩:৪৮:২৪
স্বামীকে জজ পরিচয় দিয়ে প্রতারণা, শিক্ষিকা স্ত্রী শ্রীঘরে

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি : এ যেন সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। অসৎ উপায়ে প্রতারণার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার নেশায় মেতেছিলো ছিলো এই দম্পতি। স্কুল শিক্ষিকা হওয়ার সুবাদে নিজের স্বামীকে জেলা জজ পরিচয় দিয়ে অন্য সহকর্মীদের মামলা-মোকদ্দমা নিস্পত্তি, নিয়োগ-বদলীর তদবির, একের পর এক মিথ্যা নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার কাগজ তৈরী করে অন্যকে ফাঁসিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, আদালতের ভূয়া সমন তৈরী করে মানসিক ভয়-ভীতি সৃষ্টি করে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করাই ছিলো যেন তাদের নিত্য দিনের কাজ। তবে তাদের এ প্রতারণা বেশিদিন টিকেনি। ওই শিক্ষিকার প্রতারণার শিকার নিজ কর্মস্থলের এক শিক্ষা কর্মকর্তার দায়ের করা মামলায় ফাঁস হয় সবকিছু।

ওই ভূয়া জজ ও তার স্কুল শিক্ষিকা স্ত্রী এক শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রতারণাসহ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৪টি ভূয়া মামলার কাগজপত্র তৈরী করে এবং তা নিষ্পত্তি করার কথা বলে প্রতারণার মাধ্যমে ১৫ লক্ষ ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়।

বর্তমানে ওই স্কুল শিক্ষিকা আদালতের নির্দেশে কারাগারে আটক থাকলেও পলাতক রয়েছে তার ভুয়া জজ পরিচয়দানকারি স্বামী। এদিকে প্রতারণা মামলায় কারাগারে বন্দি থাকায় জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে।

বরখাস্ত হওয়া স্কুল শিক্ষিকার নাম জেসমিন আরা, তিনি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ৮৩ নং মাধবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার স্বামীর নাম মো: শরীফুল ইসলাম, তিনি নিজেকে জেলা জজ, সহকারি জজ, পুলিশ অফিসারসহ বিভিন্ন পরিচয়ে প্রতারণা করে আসছেন।

প্রতারণার শিকার জেলা সহকারি শিক্ষা অফিসার আনিসুর রহমান জানান, একই কর্ম এলাকায় চাকুরী করার সুবাদে পরিচয় হয় সহকারি শিক্ষিকা জেসমিন আরার সাথে। জেসমিন আরা সেসময় নিজেকে সিরাজগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেন এবং তার স্বামীর সাথে আমাকে মোবাইলে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। এদিকে আমার নামে একটি ফৌজদারী মামলা হওয়ায় পরিচিত হওয়ার সুবাদে তিনি আমাকে মামলায় সাহায্য সহযোগিতার কথা বলেন, এমনকি আমার স্ত্রী’র সাথেও কথা বলে বিশ্বস্ততা অর্জন করেন। এছাড়াও আমাদের সরলতার সুযোগে আমার চাকুরীর বিবরণ, ব্যক্তিগত তথ্যসহ মামলার কাগজপত্র কৌশলে হাতিয়ে নেয় সেই প্রতারক।

মোবাইলে কথোপোকথনের মাধ্যমে গত বছরের জুন মাসে তিনি জানান, তিনি পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইডতে গবেষণা রত আছেন। এদিকে গত আগষ্ট মাসে মাসুদ নামে ওই চক্রের একজন নিজেকে এসআই পরিচয় দিয়ে আমার স্ত্রীকে জানায় কুষ্টিয়ায় শিউলি নামে এক নারী আমার নামে প্রতারণার মামলা করেছেন এবং তিনি সেই মামলার আইও।পরে আমার ঠিকানায় একটি ভূয়া সমন প্রেরণ করেন। মামলা মোকদ্দমায় আমার জ্ঞান না থাকায় প্রতারক শরীফুল উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে আমাকে বিভিন্ন পরামর্শ দিতে থাকেন। অপরদিকে যোগসাজসের মাধ্যমে শরীফুল আবারও অক্টোবর মাসে আবুল কালাম আজাদ ও বৃষ্টি খাতুনকে বাদী দেখিয়ে একই তারিখে পাবনা জেলা জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেসি আদালতের দুটি আরজি তৈরী করে আমার ঠিকানায় পাঠান এবং আমাকে বলেন আমি যদি উক্ত মামলার বাদীদের সাথে টাকা-পয়সা দিয়ে মামলা আপোষ-নিস্পত্তি না করি তাহলে আমার গুরুতর ক্ষতি হবে।

এছাড়াও তিনি বলেন, তিনি জেলা ও দায়রা জজ, তার সাথে সারাদেশের আদালতের পরিচিতি আছে। তিনি সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞ বিচারকদের সাথে কথা বলে কথিত বাদীদের ডেকে আপোষ-মিমাংসা করে দিতে পারবেন-এই মর্মে তিনি টাকার দরকষাকষি শুরু করেন।এরই মাঝে তিনি জানান শারমিন ওরফে সাবরিনা নামে আরও এক নারী আমার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন আইনে মামলা করেছে এবং সেটার ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে,তিনি ক্ষমতাবলে তা আটকে রেখেছেন-এইভাবে আমাকে আরও ভয়ভীতি দেখাতে থাকে যাতে আমি তাদের ফাঁদে পা দেই।

এমন পরিস্থিতিতে ১৫ লক্ষ টাকা হলে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে আমাকে টাকা প্রদানের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে-এ অবস্থায় আমি নিরুপায় হয়ে তাদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে ১৫ লক্ষ টাকা প্রদান করতে সম্মত হই।

সে মোতাবেক গত ১৩ অক্টোবর’২০ তারিখে তাদের কথামতো দিনাজপুর জেলার গোড়া শহীদ ময়দানে (বড় মাঠে) প্রতারক শরীফুল, তার স্কুল শিক্ষিকা স্ত্রী জেসমিনসহ আরও বেশ কয়েকজনের সাথে মিলিত হয়ে মোট ১৩ লক্ষ টাকা প্রদান করি এবং অবশিষ্ট টাকা নিস্পত্তির পর দিতে রাজি হই।

পরে প্রতারক শরীফুল আমাকে মোবাইল ফোনে জানায় আপনার সব মামলা নিস্পত্তি হয়ে গেছে এবং বাদিরা টাকা নিয়ে গেছে, আপনাকে আরো ২ লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা শোধ করতে হবে। আপনি কুরিয়ারের মাধ্যমে এই টাকা দ্রুত পাঠান। কথামতো করতোয়া কুয়িার সার্ভিসের মাধ্যমে সেই টাকাও সরল বিশ্বাসে তার কাছে পাঠানো হয়।

পরবর্তীতে প্রতারক শরীফুল মামলা নিষ্পত্তির ভূয়া কাগজপত্র তৈরী করে আমার কাছে পাঠায়। তার পাঠানো কাগজপত্রগলি দেখে আমার সন্দেহ হলে স্থানীয় এক উকিলকে কাগজপত্রগুলি দেখাই। তিনি সবকিছু যাচাই-বাছাই করার পর আমাকে জানান এসবকিছু ভূয়া, পরে সেই উকিল প্রতারক শরীফুল এর সাথে কথা বললে তিনি অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেন-এ থেকে আমার আর বুঝতে বাকি নেই যে আমি বিরাট প্রতারণার শিকার হয়েছি।পরে প্রতারক শরীফুল, তার স্ত্রী জেসমিনসহ ২১ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা দায়ের করি।

তিনি বলেন, আমি প্রতারকদের আদালতের মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতসহ আমার ১৫ লক্ষ ২০ হাজার টাকা ফেরতের জোর দাবি জানাই।

এ বিষয়ে জানতে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো: হারুনর রশিদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমাকে মর্মাহত করেছে। যে শিক্ষিকা নিজের উর্ধতন কর্মকর্তার সাথে এমন করতে পারে, না জানি তিনি বাকিদের সাথে কি করেছেন? তিনি বলেন, প্রতারনার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে আটক হয়ে কারাগারে যাওয়ায় বি.এস.আর-৭১ ও এফ আর-৫৩ (বি) বিধির অধীনে সদর উপজেলার ৮৩ নং মাধবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা জেসমিন আরা নামে ওই শিক্ষিকাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আদালতের রায়ের উপর বিবেচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এদিকে আসামী শরিফুল ইসলাম পলাতক থাকায় ও অভিযুক্ত স্কুল শিক্ষিকা কারাগারে থাকায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

(ওএস/এসপি/জুন ৩০, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

২১ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test