E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সাতক্ষীরায় মহানবীকে কটুক্তির খবরে হিন্দু বসতবাড়িতে আগুন 

রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে চার্জশিটভুক্ত আসামি জিএম নূর ইসলামসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে পুণঃতদন্তে ছয় মাসেও অগ্রগতি নেই    

২০২১ জুলাই ০৬ ১৯:০০:৪৬
রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে চার্জশিটভুক্ত আসামি জিএম নূর ইসলামসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে পুণঃতদন্তে ছয় মাসেও অগ্রগতি নেই    

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের ফতেপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে মঞ্চস্ত হুজুরে কেবালা নাটকে মহানবীকে কটুক্তি করা হয়েছে ২০১২ সালের ২৯ মার্চ প্রকাশিত দৈনিক দৃষ্টিপাতের ভিত্তিহীন খবরে ফতেপুর ও চাকদাহের ১২টি হিন্দু পরিবারসহ ১৫টি পরিবারের বসত বাড়ি, ঠাকুর ঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে ছাঁই করে দেয় উগ্র মুসলিম মৌলবাদিরা। এসব ঘটনায় দায়েরকৃত পাঁচটি মামলার মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে দৃষ্টিপাত সম্পাদক জিএম নূর ইসলামসহ চার্জশিটভুক্ত ছয় আসামীদের বিরুদ্ধে আদালতের নির্দেশে চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি গোয়েন্দা পুলিশকে পুণঃতদন্তের নির্দেশ দেওয়া হলেও ছয় মাসে কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই।

এদিকে চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় চাকদাহ গ্রামে ছেলে শ্যামাপদ সরদারের সর্বস্ব লুট করার পর প্রেট্রোল দিয়ে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনার যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে ২০১৭ সালের ২০ মার্চ মারা যান মা অরুনা সরদার। বাড়ি লুটপাট শেষে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার পর পালিয়ে বাঁচতে চাওয়া পুত্রবধুকে বিচালীগাদায় নিয়ে ধর্ষণের দৃশ্য দেখার পর স্মৃতি হারিয়ে পাগল প্রায় চাকদাহের কল্যাণী সরদার। সর্বপরি এ ঘটনার নেপথ্য নায়ক দৃষ্টিপাত সম্পাদক জিএম নূর ইসলামের নাগরিক কমিটির ব্যানারে দেওয়া ত্রাণ প্রত্যাখানকারি ফতেপুরের লক্ষীপদ মণ্ডল বিচার না পাওয়ার হতাশায় ভুগছিলেন। চার্জশীট হওয়ার আড়াই বছর পর নির্যাতিতদের গ্রামে ও ইউনিয়নের বাসিন্দা না হওয়া ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের স্বজন না হওয়ার পরও জিআর-৮৪/১২ নং মামলার বাদি বিষ্ণুপুর ইউপি’র ৯নং ওয়ার্ড সদস্য খলিলুর রহমান আসামীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে নারাজি দেওয়া ও সর্বশেষ ওই নারজীর আবেদন ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি আমলে নিয়ে আদালতের পূণঃতদন্তাদেশ দেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে হতাশায় রোগগ্রস্ত হয়ে গত ২৫ মার্চ মারা যান লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে সর্বস্ব হারানো ফতেপুরের লক্ষীপদ মণ্ডল।

স্থানীয় ও আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের ২৯ মার্চ দৃষ্টিপাত পত্রিকায় ছাপানো মিথ্যা খবরের ভিত্তিতে বিএনপি নেতা নুরুজ্জামান পাড় কোন প্রকার সম্পৃক্ততা না থাকলেও সহকারি শিক্ষিকা মিতা রানী বালাকে ৩০ মার্চ দুপুর ১২টায় বাড়ি থেকে মোটর সাইকেলে তুলে এনে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে জেল হাজতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। পরদিন কৃষ্ণনগর ইউপি চেয়ারম্যান জাপা নেতা মোশাররফ হোসেন, সাবেক চেয়ারম্যান আনছার আলী, মুকুন্দপুর চৌমুহুনী দারুল উলুম ফাজিল মাদ্রাসার তৎকালিন অধ্যক্ষ জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের হেলালী ও জুলফিকার সাঁফুই এর নেতৃত্বে আসা মিছিলের মৌলবাদি মুসলিমরা মিতা রানী বালার বাড়ি ঘর লুটপাট ও ভাঙচুর শেষে সকালে ও বিকেলে দু’দফায় প্রেট্রাল ঢেলে আগুণ লাগিয়ে দেয়। আগুণে ছড়িয়ে দেওয়া হয় গান পাউডার। ছোট ছেলে অনির্বানকে আগুনে ছুুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করা হয় । মামলা থেকে অব্যহতি পেলে ও মিতা ঘটনার সাড়ে আট বছর পরও বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই যন্ত্রনা। দু’সন্তান, স্বামী ও শ্বাশুড়িকে নিয়ে চলছে তার কঠিন জীবন সংগ্রাম। পুড়ে যাওয়া বাড়ির গ্রীলগুলো যন্ত্রণা দিলেও টাকার অভাবে সংস্কার করতে পারেননি। একইভাবে একই গ্রামের লক্ষীপদ মণ্ডলের বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট শেষে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় ফতেপুর সাংস্কৃতিক পরিষদ।

ফতেপুরের ঘটনার জের ধরে ওই বছরের পহেলা এপ্রিল পুড়িয়ে দেওয়া হয় চাকদহ গ্রামের আটটি হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি। লুটপাট করা হয় তাদের যথাসর্বস্ব।

সম্প্রতি ফতেপুর ও চাকদাহ গ্রামে গেলে ২০১২ সালের ৩১ মার্চ ও পহেলা এপ্রিলের মুসলিম মৌলবাদের ভয়াবহ হামলার স্মৃতি চারণা করতে যেয়ে আতকে ওঠেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা। মামলাটি নয় বছর পর পূণঃতদন্তে যাওয়ার পরও ছয় মাসে কোন অগ্রগতি না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করে তারা বলেন, ২০০২ সালের ৩০ আগষ্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলার মামলার বিচারে ৫০ জনের সাজা হলো। অথচ তাদেরকে যে পত্রিকা সর্বস্ব ক্ষতি করে রাস্তায় নামিয়ে দিলো রাষ্ট্রদ্রাহীতার অভিযোগে চার্জশীটভুক্ত আসামী ওই পত্রিকার সম্পাদক জিএম নূর ইসলাম, নির্বাহী সম্পাদক আবু তালেব মোল্লা, তৎকালিন বার্তা সম্পাদক ডিএম কামরুল ইসলাম, দক্ষিণ শ্রীপুর প্রতিনিধি অস্ত্রধারি শিবির ক্যাডার মিজানুর রহমান, ফতেপুরের আল আমিন তরফদার ও যুবলীগ নেতা নীলকণ্ঠপুর গ্রামের মামুনর রশীদ মিন্টুকে পূণঃতদন্তকালে কেন রিমাণ্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো না তা বোঝা গেল না। জিএম নূর ইসলামরা প্রভাব খাটিয়ে চিরদিনই আইনের বাইরে থেকে যাবেন বলে মনে করেন তারা।

ফতেপুর ও চাকদাহের ক্ষতিগ্রস্ত ১২টি হিন্দু পরিবারের সদস্যরা জানান, পাঁচটির মধ্যে একটি মামলার বাদি বিষ্ণুপুর ইউপি সদস্য খলিলুর রহমান রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার চার্জশীটভুক্ত দৃষ্টিপাত পত্রিকা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা নিয়ে অভিযোগপত্র দায়েরর আড়াই বছর পর আদালতে নারাজি দেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে অভিযোগপত্র দাখিল করা হলেও ওই তথ্য গোপন করে কুখ্যাত শিবির ক্যাডার মিজানুর রহমানের হাইকোর্টে স্থগিত করে রাখা মামলা খারিজ হয়ে গেলেও সুপ্রিম কোর্টে রিভিশনের নামে নামমাত্র কাগজপত্র জমা দিয়ে মামলার কার্যক্রম দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করলেও ২০১৯ সালের ১০ জুলাই তার খারিজ হয়ে যায়। এর ১৬ মাস পর ওই মামলা পূণঃতদন্তে গেছে। মামলার দ্রুত তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির দাবিতে গত ২৫ জানুয়ারি বিষ্ণুপুর বাজারে এলাকাবাসী মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে। মামলার বিচার বিলম্বিত করার নেপথ্যে দৃষ্টিপাত কর্তৃপক্ষের হয়ে দু’জন সাংসদ, একজন সাবেক পিপি, কয়েকজন দাপুটে সাংবাদিকসহ কয়েকজন রাজনীতিবীদের হাত রয়েছে।

সাতক্ষীরা জজ কোর্টের অতিরিক্ত পিপি অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, ফতেপুর ও চাকদাহে সহিংসার ঘটনাকে ছোট করে দেখার কোন সূযোগ নেই। মামলাটি নতুন করে তদন্তে যাওয়ার পর ছয় মাসেও কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখতে পাননি। এ মামলার দ্রুত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য করোনা পরবর্তী কার্যক্রম শুরু হলে তারা আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা সাতক্ষীরা গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক হাফিজুর রহমান মঙ্গলবার দুপুরে এ প্রতিবেদককে জানান, তদন্ত কাজ অব্যহত রয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ২৭ মার্চ ফতেপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রখ্যাত নাট্যকার আবু আল মুনসুৃরের হুজুরে কেবালা গল্প অবলম্বনে মঞ্চস্ত হয় নাটক। নাটকের দ্বিতীয় পর্বে যুবলীগ নেতা মামুনার রশিদ মিণ্টু কুখ্যাত হরিণ শিকারী সাত্তার মোড়লের কথামত মহানবীকে কটুক্তি করা হয়েছে মর্মে গুজব ছড়ায়। দৃষ্টিপাতের দক্ষিণ শ্রীপুর প্রতিনিধি অস্ত্রধারি শিবির ক্যাডার ফতেপুরর মিজানুর রহমান ২৯ মার্চের পত্রিকায় প্রকাশ করে। ফতেপুর ও চাকদাহে সহিংসতার সকল ঘটনায় ২০১২ সালের ৫ এপ্রিল দায়েরকৃত চারটি মামলায় ৯৪ জনের নামসহ অজ্ঞাতনামা দু’ হাজার ২০০ লোককে আসামী শ্রেণীভুক্ত করা হয়। কর্তব্যে অবহেলার দায়ে কালীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক লস্কর জায়াদুল হককে বাগেরহাটে স্ট্যাণ্ড রিলিজ করা হয়। সাতক্ষীরা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইয়াছিন আলম চৌধুরী কালীগঞ্জের ওই পাঁচটি সহিংসতার মামলার একটির তদন্তকারি কর্মকর্তা ছিলেন।

৮ এপ্রিল তৎকালিন পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান খান ও কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ ফরিদউদ্দিনকে প্রত্যাহার করা হয়। ১০ এপ্রিল তৎকালিন জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের নির্দেশে দৃষ্টিপাত পত্রিকার প্রকাশনা বাতিল করা হয়। ১২ এপ্রিল অস্ত্রধারি শিবির ক্যাডার দৃষ্টিপাত পত্রিকার সাংবাদিক মিজানুর রহমানকে গাজীপুর সদরের একটি ব্যাচেলার ছাত্রবাস থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২৫ এপ্রিল তৎকালিন পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান খান ও কালীগঞ্জ থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ ফরিদউদ্দিনকে হাইকোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ভৎর্সনা করা হয়। হাইকোর্টের নির্দেশে একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে তদন্ত হলেও ওই বেঞ্চ ভেঙে যাওয়ায় প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। নতুন কোন বেঞ্চে রাষ্ট্রপক্ষ তদন্ত প্রতিবেদন শুনানীর চেষ্টাও করেনি। এমনকি তৎকালিন জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের পত্রিকা বন্ধের আদেশের বিরুদ্ধে জিএম নূর ইসলামের হাইকোর্টে স্থগিতাদেশ সম্পর্কে খোঁজ রাখে না কেউ।

(ওএস/এসপি/জুলাই ০৬, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

১২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test