E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টারের ২৮ তম প্রয়াণ দিবস আজ

২০২১ জুলাই ২৩ ১৮:৫২:২৭
বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টারের ২৮ তম প্রয়াণ দিবস আজ

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : কালের বিবর্তনে পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হয়েছে মহাপুরুষ ও জাতীয় বীরগণ। যাদের জন্ম না হলে ইতিহাস হয়ে যেতো ফিকে। স্বার্থপর এই সমাজে অনেকেই তাদেরকে সম্মান না করলেও ইতিহাসের পাতায় অমলিন হয়ে থাকবে তাদের নাম। স্মরণীয় এসব মানুষের মধ্যে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেহলার টাউনশ্রীপুর গ্রামের প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার ১৯৯৩ সালের ২৩ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। ২৩ জুলাই তার ২৮ তম মৃত্যুবার্ষিকী। তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে দেবহাটার টাউনশ্রীপুর জামে মসজিদে জুম্মা নামাজের শেষে খুদবা পাঠ করা হয়।  

এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম, দেবহাটা উপজেলা চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান, জেলা পরিষদের সদস্য আল ফেরদৌস আলফা, টাউন শ্রীপুর জামে মসজিদ পরিচালণা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম, সাতক্ষীরা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুর রশিদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওহাব প্রমুখ। টাউনশ্রীপুর উত্তর পাড়া জামে মসজিদসহ পাঁচটি মসজিদে দোয়া অনুষ্ঠিত হয়। টাউনশ্রীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় চত্বরে কবর জিয়ারতের মধ্য দিয়ে তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন জাতি,ধর্ম বর্ণ নিবের্শেষে বিভিন্ন পেশার মানুষ। ভোরে তার নিজ বাড়িতে কোরআন খতম করা হয়। তবে করোনা পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সংগঠণ তাদের স্মরণসভা থেকে বিরত থাকে।

সাতক্ষীরার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ৯নং সেক্টরের প্রতিষ্ঠাতা সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার ১৯৩৭ সালের ৬ ফেব্র“য়ারি সীমান্তবর্তী ইছামতী নদীর তীরের দেবহাটার টাউন শ্রীপুরের বিখ্যাত মিস্ত্রী বংশে জন্ম করেন। তৎকালিন ব্রিটিশ শাসনামলে সাত জমিদারের বসতি ও বাংলাদেশের প্রথম পৌরসভা টাউন শ্রীপুর গ্রামের মুন্সি খিজির মিস্ত্রির পুত্র ছিলেন তিনি। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় ইতিহাস হবেন বলেই ১৩ ভাই বোনের মধ্যে একমাত্র তিনিই বেঁচে ছিলেন। তার পিতা অত্যন্ত সহজ সরল প্রকৃতির সাদা মনের মানুষ ছিলেন। ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি হিসাবে তিনিএলাকায় বিশেষ খ্যাতি অর্জণ করেছিলেন। হিন্দু জমিদার প্রতিষ্ঠিত টাউন শ্রীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন শাহজাহান মাষ্টার। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর টাউনশ্রীপুর শরৎচন্দ্র হাইস্কুলে ভর্তি হন।

তিনি নবম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় মাতৃভাষা রক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদার দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনকে বেগবান করতে তিনি নিজ বিদ্যালয়ের ৪০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। সেখানে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেওয়ার পর তিনি সকলের নজর কাড়েন। ১৯৫৪ সালে তিনি ওই বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। পরে সাতক্ষীরা মহকুমার একমাত্র কলেজে আইকম ক্লাসে শাহজাহান মাষ্টার ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে তিনি আইকম পাশ করেন। একই বছরে সাতক্ষীরা পদ্মশাঁখরা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন।

পরে ১৯৫৯ সালে তিনি শ্যামনগর থানার ভেটখালি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬২ সালে রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড পাশ করেন এবং শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করেন। পরবর্র্তীতে টাউনশ্রীপুর ও সখীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পদ্মশাঁখরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে হাড়দ্দহ নিবাসী মোঃ আজিজুর রহমানের কণ্যা রাবেয়া খাতুনকে বিবাহ করেন তিনি। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান- ভারত যুদ্ধে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তানি মিলিটারি পরিচালিত মুজাহীদ বাহিনীতে যোগদান করেন। তার দক্ষতার ফলে পাকিস্তান সরকার তাকে সাতক্ষীরা মহকুমার মুজাহীদ বাহিনীর দায়িত্ব দেন। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার তাকে ক্যাপ্টেন উপাধীতে ভূষিত করেন।

এ কারণেই তিনি“ ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার” নামে পরিচিত হন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। তিনি স্থানীয় যুবকদের নিয়ে নিজ এলাকায় মুৃক্তি বাহিনী গঠণ করেন। দেবহাটা থানায় পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে “জয় বাংলা পতাকা ” উত্তোলনের নির্দেশ দেন ক্যাপ্টেন শাহজাহান। বিওপি ৬জন পাকিস্তানি ইপিআরদের বন্দী করে তাদের কাছ থেকে চায়না রাইফেল ছিনিয়ে নেন। যুদ্ধকালিন সময়ে ৯নং সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করেন। যেটি শেষ পর্যন্ত“ ৯নং সেক্টর” - এর মর্যাদা পায়। এ কারণে তাকে ৯ নং সেক্টরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। তার নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধের মধ্যে টাউনশ্রীপুর, ভোমরা, ভাতশালা ও কুলিয়ার যুদ্ধ অন্যতম। টাউনশ্রীপুরের মুক্তিযোদ্দা আব্দুর রউফ, আজিজপুরের কাজী ইদ্রিসসহ ১০০ মুক্তিসেনাকে নিয়ে তিনি খুলনার গল্লামারির খুলনা বেতার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে মুক্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলায় নিজ এলাকায় ফিরে এসে পুনরায় শিক্ষকতায় যোগদান করেন তিনি।

১৯৮৫ সালে তৎকালিন রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে বাংলাদেশে প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি দেবহাটা উপজেলার প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালে তিনি রেজিষ্ট্রির মাধ্যমে মৃত পরবর্তী দু’টি চোখ দান করে যান। ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই সখীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাথে সাথে তাকে সখীপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। পরে দুপুর ১২ টা ৩০ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পরদিন ২৪ জুলাই টাউন শ্রীপুর হাইস্কুল প্রাঙ্গনে বিকাল ৫টায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়। সদালাপী, নিভৃতচারি, শিক্ষানুরাগী, আজীবন সমাজসেবী এ মানুষটি জীবনের শেষ মুহুর্তটি পর্যন্ত সমাজ সেবায় আত্মনিয়োগ করে গেছেন।

জাগতিক কোন লোভ লালসা তার জীবনের পথচলাকে ব্যহত করতে পারেনি। ক্ষমতার যে স্থানে ছিলেন সেই স্থানে থেকে প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হতে পারতেন তিনি। তবে সাদাসিদে সরলমনা এই মানুষটি কেবল দেশের কল্যাণে মন দিতে যেয়ে খেয়াল দিতে পারেননি নিজের পরিবারের প্রতিও। তার এ পথচলায় সাথে পেয়েছিলেন যোগ্য প্রিয়তমা স্ত্রী এবং নির্লোভ সন্তানদের। এই বীরের আধা পাকা বাড়িটি জানান দেয় তিনি কতটা সৎ ছিলেন। নষ্ট হয়ে যাওয়া এই সমাজে শাহজাহান মাষ্টারের মত লোকেরাই আমাদের আদর্শ হয়ে থাকবেন চিরকাল।

(আরকে/এসপি/জুলাই ২৩, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

১০ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test