E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কুলিয়ারচরে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরে ফের ফাটল, আতঙ্কে বসবাস!

২০২১ আগস্ট ০২ ১৪:৩৬:৪৩
কুলিয়ারচরে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরে ফের ফাটল, আতঙ্কে বসবাস!

সোহেল সাশ্রু, কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের স্বপ্নের ঘর নির্মাণে নিম্নমানের কাজ হওয়ায় আতঙ্কে বসবাস করছে এমন অভিযোগ উপকারভোগীদের। বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে এসব ঘরে বসবাস করতে গেলেও ভীত মজবুত না থাকায় সামান্য বাতাসে উড়ে যাওয়ার আশংকায় নতুন নতুন সমস্যায় পড়ছে তারা। ঘর নির্মাণের ৬ মাস অতিবাহিত না হতেই ফের ভাঙ্গন ও ফাঁটল দেখা দিয়েছে।

নির্মাণের শুরুতেই ঘরের পিলার, দেয়াল ও প্লাষ্টার ভেঙ্গে পড়ায় বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, স্থানীয় দৈনিক ও অনলাইন নিউজ পোর্টালসহ টিভিতে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর কিছুটা সংস্কার করা হলেও বর্তমানে ঘরের পিলার ভাঙ্গন, ঘরের মেঝেতে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি, কারোর ঘরের দেয়ালের প্লাষ্টার পরে যাওয়া, ঘরের দরজা-জানালা কব্জা খুলে যাওয়া এবং কয়েকটি ঘরের ভিটা মাটির জমিন থেকে নিচা হওয়ায় বৃষ্টির পানি ঘরের ভিতরে ঢুকে যাওয়ার ফলে উপকারভোগীদের বসবাস করতে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এ কারণে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে নতুন ঘরে বসবাসরতদের।

মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় গত ২৩ জানুয়ারি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে একযোগে সারা দেশের ন্যায় কুলিয়ারচরে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে ২০টি ঘরের চাবি হস্তান্তর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

উপকারভোগীদের অভিযোগ এসব ঘর নির্মাণ কাজের শুরুতেই বেশীরভাগ ঘরের নির্মাণ কাজে অনিয়ম হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের সামগ্রী। ফলে বেশিরভাগ ঘরই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় নতুন করে সংস্কার করতে দেখা গেছে। অথচ প্রতিটি ঘর নির্মাণে যে বরাদ্দ দিয়েছে সরকার তাতে বেশ ভালো মানের কাজ করা সম্ভব ছিল বলে দাবি ওই উপকারভোগীদের।

ঘর পাওয়া রোকসানা (৩৫) বলেন, ঘরে উঠার পরই তাদের ঘরের পিলার ভেঙ্গে গেছে। ঘরের মেঝে (ফ্লোরে) বড় বড় ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে, টয়লেট ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কয়েকদিন আগে ফাঁটল ও ভাঙ্গনের স্থানে সিমেন্ট-বালু দিয়ে লেপ দিয়ে গেছে। এ ঘরে বসবাস করতে ভয় পাচ্ছে তারা।

রূপবানু (৫০) বলেন, ঘরে উঠার আগে ও পরে তার ঘরে ও টয়লেটে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এখানে ১৬টি ঘরের জন্য একটি মাত্র টিউবওয়েল স্থাপন করে দেওয়ায় পানি ব্যবহারে অনেক সমস্যা হচ্ছে।

ছখিনা বেগম (৫০) বলেন, ঘরে ঢুকার পর বৃষ্টির পানি ঘরে গিয়ে বসবাসে অনুপযোগী হয়ে পড়ায় ইউএনও স্যারকে জানালে তিনি মাটি ভরাটের ব্যবস্থা করেন। দেখা যায়, মাটি ভরাটের পর অনেক ঘরের ভিটা নিচু হয়ে যাওয়ায় আরো অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে।

উপকারভোগীদের মধ্যে অনেকেই বলেন, মূল রাস্তা থেকে ঘরগুলো সামান্য দূরে হলেও সেখানে যাওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত তেমন কোন রাস্তা নির্মাণ করা হয়নি। বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের জন্য যে ১টি টিউবওয়েল দিয়েছে তা তুলনামূলক ভাবে কম হয়েছে। এতে করে তাদের সমস্যা বাড়ছে প্রতিনিয়ত।

সালমা (৩০) জানান, তারা যে প্রকল্পে ঘর পেয়েছে এখানে মোট চারটি ঘর থাকলেও পানি ব্যবহারের জন্য কোন টিউবওয়েল স্থাপন করে দেওয়া হয়নি। ইউএনও স্যারকে জানালে তিনি এখনো টিউবওয়েলের ব্যবস্থা করে না দেওয়ায় তারা অনেক অনুরোধ করে বহু কষ্টে প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে পানি এনে খাবার ব্যবস্থা করতে পারলেও গোসলের অনেক সমস্যা হচ্ছে তাদের। তাই এখানে দুইটি ঘরে বসবাসরতরা মাঝে মধ্যে ক্ষনিকের জন্য এসে ঘরে তালা ঝুলিয়ে আবার চলে যায়। তিনি আরো বলেন, নতুন ঘরের কাজ নি¤œমানের হওয়ায় ঘরের মেঝেতে ও দেয়ালে ফাঁটল দেখা দিয়েছে।

গোবরিয়া আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্বাস উদ্দিন জানান, তার ইউনিয়নে একটি প্রকল্পে ১০টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে একটি টিউবওয়েল স্থাপন করে দেওয়া হয়েছে। কোন প্রকল্প পেলে আরো টিউবওয়েল স্থাপন করে দেওয়া হবে।

প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২০- ২১ অর্থ বছরে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প আশ্রয়ণ-২ এর আওতায় প্রথম ধাপে এ উপজেলায় ২০টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ২ শতাংশ খাস জমি বন্দোবস্ত দিয়ে একটি করে সেমি পাকা ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়। যার প্রতিটি ঘর নির্মাণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লক্ষ ৭১ হাজার টাকা। একই ভাবে দ্বিতীয় ধাপে ১০টি ঘর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করে উপকারভোগীদের মাঝে চাবি বুঝিয়ে দেন ইউএনও। এসব ঘরের মধ্যে সালুয়া ইউনিয়নে ১৬টি, রামদী ইউনিয়নে ৪টি ও গোবরিয়া আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নে ১০টি ঘর নির্মাণ করা হয়।

এর মধ্যে নির্মাণ কাজের শুরুতেই বেশির ভাগ উপকারভোগী ঘরগুলোর নির্মাণ কাজ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ তুলে আসছে। ঘরের চাবি বুঝিয়ে দেওয়ার পরও বেশ কয়েকটি ঘরে এখনো উপকারভোগীরা না উঠার কারণে ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে।

এই প্রকল্পের অধীনে নির্মাণাধীন কাজের দেখবাল করেছেন স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন। এই প্রকল্পের উপহার ঘর নির্মাণ বাস্তবায়নে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুবাইয়াৎ ফেরদৌসী এবং ঘর নির্মাণ কাজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করেছেন প্রকল্পের সচিব উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোসা. খাদিজা আক্তার। প্রকৃত ভূমিহীনদের মাঝে সরকারি খাস জমির দলিল রেজিষ্ট্রি করে না দিয়ে জমি ও গৃহ আছে এমন স্বচ্ছ ব্যক্তিদের মাঝে ভূমি রেজিষ্ট্রি করে দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে উপজেলা প্রশাসন।

এলাকাবাসী বলেন, কোন লাভ ছাড়া স্বচ্ছ ব্যক্তিদের মাঝে প্রধানমন্ত্রীর উপহার ঘর দেয়নি সংশ্লিষ্টরা। তারা আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উপহার নতুন ঘরে যদি বার বার ফাঁটল দেখা দেয় ও গর্তের সৃষ্টি হয় তা হলে যে কোন মূহুর্তে ভেঙ্গে উপকারভোগীদের উপরে পরবেনা এর নিশ্চয়তা কে দিবে? বর্তমান সরকার যেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স গ্রহণ করেছে আর সেখানেই কিছু অসাধু সরকারি কর্মকর্তার গাফিলতির কারণে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের মাঝে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের উপহার ঘরে ভাঙ্গন ও ফাঁটল দেখা দেওয়ায় সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রীর উপহার ঘরে নতুন করে ভাঙ্গন, ঘরের মেঝেতে ফাঁটল ও টয়লেট ভাঙ্গন ধরার কথা স্বীকার করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও প্রকল্পের সচিব উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোসা. খাদিজা আক্তার বলেন, যে সব ঘরে ভাঙ্গন, ফাঁটল কিংবা নির্মাণ ত্রুটি দেখা দিয়েছে সে গুলো কয়েকদিন আগে সংস্কার করে দেওয়া হয়েছে।

এ ব্যাপারে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব ইয়াছির মিয়া বলেন, শুনেছি মজিববর্ষ উপলক্ষ্যে ভূমিহীনদের মাঝে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া স্বপ্নের উপহার ঘর নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম হওয়ায় ঘরে বার বার ভাঙ্গন ও ফাঁটল দেখা দিচ্ছে। নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহার ঘর নির্মাণ করে সরকারের এ মহৎ উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে। এসব ঘর পরিদর্শন করে নির্মাণ কাজের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেন।

তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবায়নে দুর্নীতি মুক্ত শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন সোনার বাংলা বাস্তবায়িত হবে।

(এস/এসপি/আগস্ট ০২, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test