E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

 

জিল্লুর রহমান সেতু এখন ধর্ষকদের আখড়া, চুরি ছিনতাই নিত্যদিনের ঘটনা! 

২০২১ আগস্ট ০৩ ১৩:৪৬:৪২
জিল্লুর রহমান সেতু এখন ধর্ষকদের আখড়া, চুরি ছিনতাই নিত্যদিনের ঘটনা! 

সোহেল সাশ্রু, কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত প্রয়াত রাষ্ট্রপতি আলহাজ্ব জিল্লুর রহমান সেতুর পশ্চিম প্রান্ত এখন ধর্ষকদের আখড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া এখানে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই যেনো এখন নিত্য দিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর ও ভৈরব উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া কালী নদীর ওপর নির্মিত প্রয়াত রাষ্ট্রপতি আলহাজ্ব জিল্লুর রহমান সেতুটি ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর উদ্বোধনের পর থেকে সেতুটি ঘিরে, সেতু ও তার আশপাশের স্থানটি বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে আশেপাশের কয়েক জেলার মানুষের কাছে ইতোমধ্যে পরিচিতি লাভ করেছে।

এ সুবাদে প্রতিদিনই দূর-দূরান্তের কিশোরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী উপজেলার মানুষজন ঘুরতে আসে এখানে। আর এখানে ঘুরতে এসেই অনেকেই হচ্ছে ছিনতাইয়ের শিকার, হারাচ্ছে প্রিয় ফোন ও সাথে থাকা টাকা-পয়সা। শুধু তাই নয় অনেক তরুণ-তরুণী ঘুরতে এসে হচ্ছে গণধর্ষণের শিকার। জানা যায়, গত দুই বছরে এখানে শতাধিক গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যার কোনো একটিরও লিখিত বা অলিখিত কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ না থাকার অযুহাত দেখিয়ে পরস্পরের মাধ্যমে জানার পরও নিরব ভূমিকা পালন করছে পুলিশ।

জানা যায়, চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর মাধবদী থেকে এক তরুণী তার প্রেমিকের সাথে ঘুরতে এসে গণধর্ষনের শিকার হলে ধর্ষণের স্পট থেকে পৌরসভার স্থানীয় ৬নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূরে আলম ওই ধর্ষিতাকে উদ্ধার করে কুলিয়ারচর থানা পুলিশ হেফাজতে দেয়। এ সময় পুলিশ হেফাজতে থাকা ধর্ষিতা ও তার সাথে থাকা প্রেমিক সাংবাদিকদের জানায়, ৭টি ছেলে ওই প্রেমিক ছেলেটিকে মারধর করে মেয়েটিকে একটি নির্জন জায়গায় নিয়ে ধর্ষণ করে।

কাউন্সিলর নূরে আলম সাংবাদিকদের বলেন, খবর পেয়ে মেয়েটিকে আমরা লম্পটদের হাত থেকে উদ্ধার করি। উদ্ধারের পর থানায় খবর দেই। পরে পুলিশ এসে মেয়েসহ মেয়েটির সাথে ঘুরতে আসা ছেলেটিকে পুলিশ থানা হেফাজতে নিয়ে যায় এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের খবর দেওয়া হয়। পরবর্তীতে জানতে পারি পুলিশ কোন মামলা না নিয়ে ধর্ষিতা মেয়ে ও ছেলেকে ছেড়ে দিয়েছে। বিষয়টি তাকেও জানায়নি পুলিশ।

এই ঘটনাটি এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে, বিষয়টি নিয়ে লোকমুখে ব্যাপক গুঞ্জন শুরু হয়। এরপরই বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে নামে কুলিয়ারচরের সাংবাদিকবৃন্দ।

স্থানীয় সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে উঠে আসে ভয়ংকর সব তথ্য। যে সকল তথ্য উঠে এসেছে, তা যেনো বাংলা সিনেমার নাটকীয় গণধর্ষণের দৃশ্যকেও হার মানায়। আর এসব নাটকীয় গণধর্ষণের বাস্তব সাক্ষী একটি মহল্লার পুরো পাড়া। যে পাড়ায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মেয়েদের তুলে এনে ধর্ষণ করা হতো। দৃশ্য পুরো বাংলা সিনেমার স্টাইলে দিনে দুপুরেই ঘটতো। ওই পাড়ার মানুষ যখন কোন একটি মেয়েকে ধরে নিয়ে আসছে দেখতো, তখন সেই পাড়ার মানুষজন ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিতো। কারণ তারা এসে যে ঘর খোলা পাবে, সেই ঘরের সবাইকে (ছেলে-মেয়ে, বউ বাচ্চার) বের করে দিয়ে ঘরের ভিতরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধর্ষণ করবে। আর যতক্ষণ ধর্ষকরা ঘরে অবস্থান করবে, ততক্ষণ সেই ঘরের লোকজনকে বাহিরে অবস্থান করতে হবে। এমন ঘটনাও একাধিক ঘটেছে।

কুলিয়ারচর পৌর সদরের ভাটিদোয়ারিয়া গ্রামের হিন্দু একটি ছোট্ট পাড়া। পাড়াটিতে অল্পকিছু সংখ্যক পরিবার বসবাস করে এবং দুই একটি পরিবার ছাড়া সকলেই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তার উপর পাড়াটি নিরব ও জনবসতি স্থানে না হওয়ায় ধর্ষকদের জন্য গ্রামটি পছন্দের টার্গেট স্পট হয়ে দাঁড়ায়। স্থানীয়দের তথ্য ও অভিযোগ মতে শুধুমাত্র এই পাড়ায় ২০২০ সালে (এক বছরে) ধর্ষণ করা হয়েছে শতাধিক তরুণীকে।

২০২১ সালের ১৬ জানুয়ারি কুলিয়ারচর পৌর নির্বাচনে ৬নং ওয়ার্ড থেকে নূরে আলম কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর তার বাঁধা ও প্রতিবাদের চাপে ধর্ষকদের নতুন ধর্ষণ স্পষ্ট হয় ব্রিজ সংলগ্ন কুলিয়ারচর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় এলাকাটি। সর্বশেষ ২৬ জুন ঘুরতে এসে ওই স্কুল এরিয়ার ভিতরের ১৫/২০ জন ছেলে কর্তৃক গণধর্ষণের শিকার হয় ২টি মেয়ে। তারা লাইকি ও টিকটিক করতে প্রায় এই ব্রিজে ঘুরতে আসতো।

সব থেকে ভয়ংকর বিষয় হলো এসব ধর্ষণের পর ধর্ষিতারা মানসম্মানের ভয়ে কোনো অভিযোগ করে না। অভিযোগ না করার আরও একটি কারণ ধর্ষণের শিকার হওয়া বেশির ভাগ মেয়ে পরিবারকে না জানিয়ে প্রেমিকের সাথে দূর-দূরান্ত থেকে এখানে ঘুরতে এসে ধর্ষণের শিকার হয়। অভিযোগ করলে ঘটনা পরিবার ও এলাকায় জানাজানি হবে এই ভেবে অভিযোগ করে না।

দীর্ঘ ৫ মাসের অনুসন্ধানে এ সকল তথ্য উঠে এসেছে। উঠে এসেছে যারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে তাদের অধিকাংশই এখানে ঘুরতে এসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণ ছাড়াও এই সংঘবদ্ধ চক্রটির শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে স্থানীয় অসংখ্য নারী। এদের মধ্যে নারী সাংবাদিক, মাদ্রাসার শিক্ষিকা থেকে শুরু করে মসজিদের ইমাম সাহেবের স্ত্রীও রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে স্থানীয়রা অনেক সময় ধর্ষণ থেকে রক্ষা পেলেও হারাতে হয়েছে সাথে থাকা টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোন ও গহনা।

তেমনই নির্যাতনের শিকার স্থানীয় কিছু মেয়ের সাথে কথা হলে তারা জানান, তারা কোন রকম ইজ্জত নিয়ে বেঁচে ফিরেছে, তবে হারাতে হয়েছে সাথে থাকা অলংকারসহ ফোন, টাকা-পয়সা। এসব ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার হলেও কোনো মেয়ে মানসম্মানের ভয়ে মুখ খুলতে রাজি নয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভাটিদোয়ারিয়া, পূর্ব দ্বাড়িয়াকান্দি ও চারারবনসহ আশেপাশে কয়েক গ্রামের শতাধিক মানুষের অভিযোগ, স্থানীয় কয়েকটি ছেলে মিলে একটি গ্যাং তৈরী করে এই অপকর্মগুলো করছে। তাদের অপকর্মের মধ্যে নেই এমন কোন অপকর্ম। মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি এদের নিত্যদিনের ঘটনা। এরা এতটাই লাগামহীন ও পাবলিকলি এসব কাজ করে যে, কেউ এদের বিরুদ্ধে কথা বলবে, প্রতিবাদ করবে এটা ভাবতেও ভয় পায়। তবে কিছু কিছু ঘটনায় এখানে একাধিক ধর্ষকচক্র রয়েছে এমন ধারণাও উঠে আসে অনুসন্ধানে।

এই সব ঘটনার পর ভয়ে মুখ না খোলার প্রধান কারণ এদের (ধর্ষকদের) নামে কুলিয়ারচর থানায় মাদক, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই এবং নারী নির্যাতন সহ ১০-২৫ টিরও অধিক করে মামলা রয়েছে এবং যে বা যারা মুখ খুলে তাদের ভয়ানক পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। এসবের পরও এরা পুলিশের সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে প্রকাশ্যে চলাফেরা করে, মাদক ব্যবসা, চুরি, ছিনতাইসহ দিনের বেলা ব্রিজ থেকে মেয়েদের তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করে বেড়ায়। সম্প্রতি অষ্টগ্রাম থানায় বদলী হওয়া কুলিয়ারচর থানার কনস্টেবল মো. সাইফুল ইসলাম মোল্লা পুলিশের পক্ষ থেকে এসব অপরাধী চক্রের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখতো বলে জানা যায়। যার প্রমাণ সাইফুল ইসলামের ব্যবহৃত একাধিক মোবাইল নাম্বারগুলোর কল লিষ্ট চেক করলেই আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে মনে করেন অনেকেই।

সর্বশেষ ২৬ জুন ঘুরতে আসা দুইটি মেয়ে ওই চক্র কর্তৃক গণধর্ষণের শিকার হলে বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্থানীয় সাংবাদিক আলি হায়দার সংঘবদ্ধ ধর্ষক চক্রের বিরুদ্ধে ধর্ষণের কিছু বর্ণনা প্রকাশ করে ওই শক্তিশালী চক্রের বিরুদ্ধে কিছু করতে না পারার আক্ষেপ জানিয়ে এলাকাবাসিকে ওই চক্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার আহবান জানিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেয়। যা দেশব্যাপী ভাইরাল হয়। এরপর প্রশাসনও একটু নড়েচড়ে বসে। এসব ঘটনা নিয়ে তদন্তে নামে একাধিক গোয়েন্দা বাহিনী যা এখনও চলমান।

সর্বশেষ তথ্য প্রাপ্ত ধর্ষণের শিকার হওয়া দুইজন মেয়ের একজন ঘটনার পর স্থানীয় কয়েকজনকে বলেন, তারা টিকটক করতে প্রায় এখানে আসতো। কিন্তু ওই দিন স্থানীয় কয়েকটি ছেলে তাদের দুইজনকে জোরপূর্বক ধরে স্কুলের পিছনে নিয়ে যায় এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত আটকে রেখে বিভিন্ন ভাবে নির্যাতন করে। পরবর্তীতে সন্ধ্যার পর ১৫/২০ জন ছেলে দুই জনকে স্কুলের দুই দিকে নিয়ে নির্যাতন করে।

তাদের ধর্ষণের শিকার হওয়া এক শিশু মেয়ের মা কান্না জড়িত কণ্ঠে জানান, আমার ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটিও তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। এই ঘটনার পর আমি একটি মামলাও করেছিলাম। তিনি বলেন, শুধু আমার মেয়ে নয়, এমন আরও অনেকের মেয়েকে তারা ধর্ষণ করেছে। কিন্তু কেউ মানসম্মান ও ভয়ে কিছু বলে না। আপনারা কিছু একটা করুণ, আল্লাহ আপনার মঙ্গল করবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুলিয়ারচর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এ.কে.এম সুলতান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়গুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। কিন্তু ধর্ষিতাদের অভিযোগ না থাকায় কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে ধর্ষণ বন্ধে এবং ধর্ষকদের ধরতে ব্রিজসহ ধর্ষণের স্পষ্ট এবং আশপাশ এলাকাটি সিসি টিভির আওতায় আনার কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

(এস/এসপি/আগস্ট ০৩, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test