E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

করোনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, বাড়ছে বাল্যবিয়ে

২০২১ আগস্ট ০৬ ১৯:১৯:০৭
করোনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, বাড়ছে বাল্যবিয়ে

রাজারহাট (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি : করোনার মহামারী আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে কুড়িগ্রামে ক্রমেই বাড়ছে বাল্যবিয়ের সংখ্যা। দারিদ্র পীড়িত উত্তরের এই জনপদে কন্যা সন্তানকে বোঝা হিসেবেই এখনো দেখেন অভিভাবকরা। দারিদ্রতার কষাঘাত আর কুসংস্কারের কারণে অল্প বয়সে বিয়ে দিচ্ছেন অনেকেই।

সরেজমিনে দেখা যায়, রৌমারী উপজেলার যাদুরচর ইউনিয়নের সীমান্ত ঘেঁষা বাগবান্ধা গ্রামে রাতের রান্নাবান্না করছে ৫ম শ্রেণীর ছাত্রী চৌদ্দ বছরের কিশোরী রূপালী খাতুন। মাটির চুলোয় খড়ির আগুনে কড়াইতে মাছের টুকরা ভাজতে দেখা যায় রূপালীকে। যে হাতে থাকবার কথা বই-কলম-খাতা। এখন সেই হাতে সংসারের হাড়ি-পাতিল-খুন্তি। যে বয়সে দুরন্তপনা করার কথা সেখানে তাকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। স্বামী মঞ্জু মিয়া রৌমারী-ঢাকা বাসের হেলপার। গত বছরের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রায় ৭০হাজার টাকা খরচ করে বিয়ে দেয় রূপালীর পরিবার। দিনমজুর হেলাল উদ্দিন-ফুলবানু দম্পতির মেঝ কন্যা রূপালী। করোনার প্রভাবে একদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ অন্যদিকে হাতে কাজ না থাকায় ৫ম শ্রেণিতে পড়–য়া রূপালীর বিয়ে দেন বাবা-মা। তুলনামূলক এই চরাঞ্চল গুলোতে বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে থেকে বেশি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং করোনার প্রভাবে পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় রূপালীর মতো রাজিবপুর উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার কোদালকাটি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী নুরি আক্তার ২৪ডিসেম্বর বিয়ে হয়। রূপালী, মমতাজ, ফাতেমা, নুরিসহ বহু মেয়ে বাল্যবিয়ের স্বীকার হয়েছে গত দেড় বছরেই। বাল্যবিয়ের দৃশ্য জেলার চরাঞ্চলগুলোতে হরহামেশাই ঘটছে। জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা ও দুধকুমারসহ অর্ধশতাধিক নদ-নদীর ছোট-বড় প্রায় ৫শতাধিক দ্বীপচর চরাঞ্চল। এসব চরাঞ্চলে প্রাইমারী কিংবা উচ্চ বিদ্যালয়ের গন্ডি পার হবার আগেই বিয়ের পীড়িতে বসতে হয়। প্রত্যন্ত এসব চরাঞ্চল গুলোতে ধর্মীয় চিন্তা, কুসংস্কার ছাড়াও অভাব, দারিদ্রতার কারণে অল্প বয়সে বিয়ে দেন অভিভাবকেরা।

একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্যানুযায়ী-২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১সালের জুন পর্যন্ত জেলায় ২১হাজার ১০০টি বিয়ে সংগঠিত হয়েছে। এরমধ্যে নিবন্ধিত বিয়ের সংখ্যা-১৭হাজার ৯’শ ৮৪টি এবং অনিবন্ধিত বিয়ের সংখ্যা ৩হাজার ১’শ ১১টি। জেলার ৯টি উপজেলায় বাল্যবিয়ে সংগঠিত হয়েছে ২হাজার ৯’শ ৫৩টি। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ হয়েছে ১হাজার ১’শ ২০টি। এরমধ্যে কুড়িগ্রাম সদর-৭০২টি, রাজারহাট-৭৩টি, উলিপুর-২৫৯টি, চিলমারী-১৪০টি, রৌমারী-৮৪টি, রাজিবপুর-৪৯টি, নাগেশ্বরী-১১২৮টি, ফুলবাড়ি-২৯১টি, ভূরুঙ্গামারীতে-২২৭টি বাল্য বিয়ে সংগঠিত হয়েছে। যদিও করোনার লকডাউন চলাকালিন সময় জরিপের কার্যক্রম কিছুটা স্থবিরতা হয়ে পড়েছে। ফলে জেলার বাল্যবিয়ে হার বাস্তবতার আলোকে আরো অনেক বেশি।

বাল্যবিয়ের স্বীকার রূপালী বলেন, আমার বাবা-মায়ের থাকার জমিজমা নেই। অভাবে পড়েই বিয়ে দিয়েছে। স্কুলও বন্ধ। খাবারের সমস্যা। এজন্যই বিয়ে দিছে।

নুরি আক্তার বলেন, রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাটি উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী। বাবা-মা ভালো পরিবার পাইছে তাই বিয়ে দিয়েছে। স্কুল বন্ধ থাকায় বাড়িতে থাকার কারণে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই হয়তো বিয়ে দিছে। এমন অনেক মেয়েরই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।

দিনমজুর হেলাল উদ্দিন বলেন, কাজকর্ম নাই। মেয়েকে যত বড় করমো ততই ডিমান্ড বাড়বে। তাতে স্কুল বন্ধ। অভাবের মধ্যে খরচ বেশি হয়। সেজন্য মেয়েকে কম বয়সেই বিয়ে দিয়েছি। যৌতুক ৩০হাজার টাকার মধ্যে নগদে দিছি ১৫হাজার টাকা দিয়া বেটি পার করছি।

কোদালকাটি এলাকার মজিবর বলেন, এই চরের মধ্যে বাহে বেটির কোন নিরাপত্তা নাই। আর নেকা পড়া করিয়া কি করবে? করোনার কারণে আগের মতন আর কাম কাইজ নাই। খাওয়াইয়া বেশি। ছোটতে বিয়া দিলে যৌতুক কম নাগে তাই বেটিক বিয়া দিছি।

একই এলাকার মমতাজের মা মহেলা বেগম বলেন, করোনার কারণে ৬ষ্ট শ্রেণিতে থাকতে বিয়ে দিয়েছি। করোনার কারণে পড়া লেখা নাইকা। কাম কাজ নাইকা। বিয়া না দিয়া উপায়ও নাই। চিলমারীতে মমতাজের বিয়া দেছি। স্কুল বন্ধ থাকায় এই গ্রামে অনেকেই তাদের মাইয়ার বিয়া দিয়া দেওছে বাপ-মাও।

স্থানীয় বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ বলেন, চরাঞ্চল এলাকা হওয়ায় এখানে বাল্যবিয়ের হার অনেক বেশি। পিতা-মাতাকে নিষেধ করলেও তারা গোপনে পার্শ্ববর্তি চিলমারী উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে গিয়ে গোপনে বিয়ে দেন। তারা ভূয়া জন্ম সনদ দিয়ে এসব বিয়ে পড়ালেও পরবর্তিতে দেখা যায় মেয়ের অভিভাবকরাই বিপদে পড়েন। যৌতুকের টাকা কিংবা অভাবের কারণে বাল্যবিয়ের বিচ্ছেদ ঘটতেছে অহরহ। কাজীরা বাল্যবিয়ে পড়ার কারণে বিয়ের আসল কাগজপত্র দেয় না। ফলে আইনী সহযোগিতা থেকেও মেয়ের অভিভাবকরা কোন আইনী সহায়তা পায় না।

রৌমারী যাদুরচর ইউপি চেয়ারম্যান সরবেশ আলী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সুযোগে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা স্বীকার। ছেলে-মেয়েদের বয়স লুকিয়ে অন্য উপজেলা কিংবা অন্য ইউনিয়নে নিয়ে গিয়ে পারিবারিকভাবে বিয়ে দেন। আবার এমনও ঘটনা ঘটে শুধুমাত্র হুজুর ডেকে কলেমা পড়িয়ে বিয়ে দেয়া হচ্ছেও। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকারকে আরো কঠোর হবারও আহবান জানান তিনি।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সুযোগে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে স্বীকার করেন। তিনি আরো বলেন, আমাদের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ চেয়ারম্যানরা সজাগ রয়েছে। ইনশাল্লাহ যে কোন সময় আমরা বাল্যবিয়ের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করব। আইনি ব্যবস্থাও নেয়া হবে বলে তিনি জানান।

(পিএমএস/এএস/আগস্ট ০৬, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test