E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর ৫১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

২০২১ আগস্ট ০৯ ১৭:০২:৫৫
মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর ৫১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

সোহেল সাশ্রু, কিশোরগঞ্জ : নিরবে নির্ভৃত্তে সবার অলক্ষ্যে পার হয়ে গেল বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক বিপ্লবী জননেতা মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর ৫১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ৯ আগস্ট ছিল স্বাধীনতার দেশ প্রেমিক এই মহানায়কের মৃত্যু দিবস। পলাশির প্রান্তরে হারিয়ে যাওয়া ভারত বর্ষের স্বাধীনতাকে পূনঃউদ্ধার এবং স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে নিজ জন্মভূমির আর্থসামাজিক, রাজনীতি স্বাধীনতার জন্য যে মানুষটি সূদীর্ঘ ৩০ বছর জেলে কাটিয়েছেন সেই বিপ্লবী দেশপ্রেমিক সমাজ সংস্কারকের মৃত্যু দিবসে নেই কোন কর্মসূচি।

জাতীয় বা স্থানীয় কোন সংগঠনও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেনি আমৃত্যু এই বিপ্লবীকে। শুধু ইতিহাসের পাতায় স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হওয়া ৮২ বছরের কর্মময় জীবন। কিশোরগঞ্জ জেলায় কুলিয়ারচর উপজেলায় নির্ভৃত পল্লী এলাকা কাপাসাটিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে ১৮৮৯ সালের বাংলা ১২৯৬ বঙ্গাব্দের ২১ বৈশাখ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী জন্ম গ্রহন করেন। পিতা দূর্গাচরণ চক্রবর্তী ও মাতা প্রসন্নময়ী দেবীর ৬ সন্তানের মধ্যে মহারাজ সর্ব কনিষ্ঠ। তার পারিবারিক নাম ছিল ত্রৈলোক্যমোহন চক্রবর্তী আবার উড়িষ্যার পুরিতে ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী “শশীকান্ত” ছদ্মনামে বাস করেন।

ময়মনসিংহ জেলার তখনকার মহারাজের নাম ছিল শশীকান্ত রায় চৌধুরী। লোকে তাকে শশীকান্ত রায় মনে করে “মহারাজ” বলে ডাকতেন। এভাবে তিনি হয়ে যান মহারাজ। পরে ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী বলে কেউ না চিনলেও মহারাজ নামে সবাই তাকে চিনে। মহারাজের ছাত্রজীবন শুরু হয় মালদহ জেলার কানসানে। দু’বছর পর তিনি চলে যান ময়মনসিংহ জেলার ধলাস্কুলে। সেখানে তিনি বেশী পড়াশোনা করতে পারেননি। ইংরেজ বেনিয়া শাসক গোষ্ঠি ভারতবাসীর স্বাধীনতা সংগ্রামকে ধুলিস্যাৎ করে দেয়ার জন্য ১৯০৫ সালে ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা দেন। জাতীয় কংগ্রেস নেতারা উপযুক্ত সময় বঙ্গভঙ্গ উপলক্ষ করে স্বদেশী আন্দোলনের জন্ম দেন। এ আন্দোলনই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সোপান। তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। শৈশবেই তিনি জন্মভূমির স্বাধীনতার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন।

তিনি যখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র তখনই স্বদেশী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনুশীলন সমিতিতে যোগদেন। তিনি যখন নরসিংদী জেলার সাটিরপাড়া স্কুলের ছাত্র সেই সময় ১৯০৬ সালের বিপ্লবী পুলিন বিহারী দাসের সান্নিধ্যে এসে স্বদেশী আন্দোলন শুরু করেন এবং ব্যারিস্টার প্রথম মিত্রের (পি.মিত্র) নেতৃত্বাধীন অনুশীলন সমিতির মাধ্যমে মহারাজ তার নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হন। সেই সময় তিনি মহেশ্বরদী পরগনায় স্বদেশী আন্দোলনরত সদস্যদের নিয়ে গঠিত ৫০টি অনুশীলন সমিতির নেতৃত্ব দেন। সেই সঙ্গে এলাকায় গণজাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করেন। রাজনৈতিক এই পথ পরিক্রমার মাধ্যমে মহারাজের পরিচয় হয় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, রবি সেন, দেশ বন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের মত দেশ প্রেমিক নেতাদের সঙ্গে।

দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামে রাজনৈতিক জীবনে মহারাজ প্রথম বারের মত ১৯০৮ সালে গ্রেফতার হন নারায়নগঞ্জে নৌকা চুরির অভিযোগে। ১২ মাস কারা ভোগের পর মুক্তি পান তিনি। গ্রেফতারের কারনে তাঁর প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করা হয়নি। পরবর্তী সময়ে ১৯১২ সালে রতিলাল রায় নামের এক পুলিশ সদস্যকে হত্যার অভিযোগে পুনরায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। কয়েক মাস কারা বাসের পর মুক্তি পায়। এক পর্যায়ে তৎকালীন সরকার মহারাজকে গ্রেফতারের জন্য পুরস্কার ঘোষনা করেন। অবশেষে ১৯১৪ সালে গঙ্গাস্নানের সময় কোলকাতা পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। এই সময় বরিশাল ষড়যন্ত্র নামে একটি মামলায় আসামি করে তাঁকে কোর্টে হাজির করা হলে ম্যাজিস্ট্রেট ১০ বৎসরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে নির্বাসন দ- প্রদান করেন। দীর্ঘ ১০ বছর পর ১৯২৪ সালে আলীপুর সেন্টার জেল থেকে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।

এভাবেই ১৯০৮ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তারণ্যের ৩০টি বছর ইংরেজদের দেওয়া দ- পর্যায়ক্রমে ভোগ করেছেন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ দখলদার মুক্ত ভারতবর্ষে দেশ বিভাজনের ঘটনা ঘটে। এই সময় তিনি ভারতে না গিয়ে জন্মভূমির উন্নয়নের স্বপ্ন নিয়ে ১৯৪৮ সালে বরিশালে পাকিস্তান সোশালিষ্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্লন্টের প্রার্থী হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ওই বিপ্লবী দেশ প্রেমিককে পাকিস্তান সরকার ২ বছর কারারুদ্ধ করে রাখে। কারাগার থেকে তিনি বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। সেগুলো হলো জেলে ৩০ বছর, পাক-ভারতের সংগ্রাম, গীতার স্বরাজ। সেই সময় তৎকালীন সরকার মহারাজের লিখা জেলে ত্রিশ বছর ও পাক-ভারতের সংগ্রাম বই দুটি বাজেয়াপ্ত করে। যে স্বাধীনতার জন্য এত ত্যাগ, এত কষ্ট সেই স্বাধীন দেশের সরকারের জেল জুলুম অত্যাচার এই চির বিপ্লবী সহ্য করতে পারেননি। তিনি অসুস্থ্য হয়ে পড়েন।

কারা কর্তৃপক্ষ মহারাজের শারীরিক অবস্থার অবনতিতে ভীত হয়ে তড়িঘড়িতে তাঁকে মুক্তি দেয়। অসুস্থ্য এই নেতাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৯৭০ সালের ২৪ জুন কোলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। এই সময় ভারতবাসী থাকে সম্মানের সহিত গ্রহন করেন। ১৯৭০ সালের ৫ আগস্ট ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধি দিল্লীর পার্লামেন্টে এক নাগরিক সংবর্ধনায় তাঁকে সংবির্ধত করেন। ভালবাসা জানাতে কোণ্ঠাবোধ করেননি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও। ৮ আগস্ট তাঁর সম্মানে সুরেন্দ্র মোহন ঘোষ মধু বাবুর বাড়িতে এক ভোজ সভার আয়োজন করা হয়। ভোজসভায় কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী, লোকসভার সরকারি ও বিরোধী দলের অনেক সদস্য উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে বাসায় ফেরার পর থেকে মহারাজ শারীরিক ভাবে আরও বেশি অসুস্থ্য অনুভব করতে থাকেন এবং ওই দিন রাত ৩টার পর বিপ্লবী চিরকুমার মহানায়ক মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী ইহলোক ত্যাগ করেন।

পরবর্তীতে লাখো ভক্তের চোখের পানিতে ১০ আগস্ট মহারাজের মরদেহ নিয়ে কোলকাতায় এক শোক র‌্যালি শেষে কোলকাতার কেওড়াতলা শ্মশানে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন। মহান এই বিপ্লবীর স্বাধীকার আন্দোলনের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কারো জানা নেই। নিজ মাতৃভূমির আজাদীর জন্য যে ত্যাগ তিনি উৎস্বর্গ করেছেন এবং দেশ প্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা যুগ যুগ ধরে দেশ প্রেমিকদের প্রেরণা দেবে। কিন্তু অত্যান্ত পরিতাপের বিষয় এই মহান বিপ্লবীর মৃত্যুবার্ষিকীটি কেটে গেছে সবার অলক্ষ্যে।

রাষ্ট্র, সুশীল সমাজ বা কোন সংগঠনই এই দেশ প্রেমিকের স্মরণে চোখে পড়ার মতো তেমন কোন কর্মসূচি পালন করেনি। স্থানীয়ভাবেও উদ্যোগী হয়ে তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনকে তুলে ধরার প্রয়াস নেননি। ২০০১ সালে কুলিয়ারচর উপজেলার তৎকালীন উপজেলার নির্বাহী অফিসার বাবু সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী উদ্যোগী হয়ে মহারাজের স্মৃতিকে ধারণ করার জন্য উপজেলা কোট প্রাঙ্গনে সরকারিভাবে মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী স্মৃতি পাঠাগার নামে একটি পাবলিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেন।

তিনি বদলী হওয়ার পর লাইব্রেরীর কার্যক্রমও ভেঙ্গে পড়েছে। মহারাজের গ্রামের বাড়িতে কোন সামাজিক সংগঠন বিপ্লবী এই নেতার কর্মকা-কে তুলে ধরার চেষ্টা না করায় প্রতি বছরই সবার অলক্ষ্যে পাড় হয়ে যায় মহারাজের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী। তার এই মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

(এস/এসপি/আগস্ট ০৯, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test