E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

৩৬ বছরেও পূর্ণাঙ্গতা পায়নি বরিশাল বিমানবন্দর

২০২১ সেপ্টেম্বর ২১ ১৭:২৩:৩৩
৩৬ বছরেও পূর্ণাঙ্গতা পায়নি বরিশাল বিমানবন্দর

আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : দীর্ঘ ৩৬ বছরেও পূর্ণাঙ্গতা পায়নি দক্ষিণাঞ্চলবাসীর একমাত্র বরিশাল বিমানবন্দর। ঢাকা-বরিশাল আকাশপথে প্রতিদিন সাত থেকে আটটি ফ্লাইট চলাচল করলেও বরিশাল বিমানবন্দরের উন্নয়ন-সম্প্রসারণ কিংবা আধুনিকীকরণসহ সবকিছুই রহস্যজনক কারণে থমকে রয়েছে। বিমানে ওঠানামা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই যাত্রীদের নানা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

বিমানবন্দরের নিরাপত্তাবেষ্টনীর অনেকটা অংশ ভাঙা। কেবল জীবজন্তুই নয়, মানুষও ঢুকে পরে রানওয়েতে। সম্প্রতি সময়ে ইউএস-বাংলার একটি বিমান রানওয়েতে নামতে না পেরে বেশ কিছুক্ষণ আকাশে চক্কর কাটতে হয়। সেবার রানওয়েতে একটি কুকুর ঢুকে পরেছিল।

বরিশাল বিভাগ উন্নয়ন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মো. আতিকুর রহমান আতিক বলেন, নিরাপত্তার দিক বিবেচনায় দক্ষিণাঞ্চলের এই বিমানবন্দরটি একেবারেই অরক্ষিত। চারপাশে সীমানা প্রাচীর থাকলেও কয়েকস্থানে ভেঙে গেছে। আবার বেশ কিছুস্থানে প্রাচীরের নিচে মাটি না থাকায় ফাঁকা স্থান দিয়ে হুটহাট লোকজন ঢুকে পরছে রানওয়েতে। এ অবস্থায় বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বন্দরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। বিশেষ করে বন্দরের রহমতপুর থেকে বাবুগঞ্জ যাওয়ার সড়কে অংশে নিরাপত্তা প্রাচীর খুবই অরক্ষিত। সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তার এমন অভাব সত্বেও বরিশাল বিমানবন্দরে প্রতিনিয়ত যাত্রী ও ফ্লাইট সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

বিমানবন্দরের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল বিমানবন্দরে ১২২ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদ থাকলেও কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৬২ জন। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসন ভবনগুলোর অবস্থাও করুণ। নতুন ভবন নির্মাণ করা হলেও বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট রানওয়ের বিমানবন্দর হলো বরিশাল বিমানবন্দর। এখানে রানওয়ের দৈর্ঘ্য মাত্র ছয় হাজার ফুট। এতো ছোট রানওয়েতে অভ্যন্তরীণ রুটের বিমানের উড্ডয়ন-অবতরণে কষ্ট হয়। এখানে বড় বিমানের ওঠানামা প্রায় অসম্ভব। ২০০৭ সালে সিডরের তান্ডবে দক্ষিণ উপকূল বিধ্বস্ত হলে ছোট রানওয়ের জটিলতা বড় হয়ে দেখা দেয়। সেসময় ত্রাণ পরিবহণের কাজে বিমানবন্দরটি ব্যবহৃত হলেও রানওয়ে ছোট হওয়ায় বিদেশী অনেক বিমান এখানে নামতে পারেনি। ফলে ঢাকায় ত্রাণ নামিয়ে তা দক্ষিণাঞ্চলে পাঠাতে হয়েছে।

বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডাঃ মিজানুর রহমান বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় প্রতিবছর ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়। এরকম ক্ষেত্রে জরুরি সহায়তার বিষয়টি মাথায় রেখে হলেও দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র বিমানবন্দরটির রানওয়ে বড় করা জরুরি হয়ে পরেছে।

তিনি আরও বলেন, এখানে যে টার্মিনাল ভবন রয়েছে, সেটিও বেশ পুরোনো। দৈনিক সাত থেকে আটটি ফ্লাইটে আসা-যাওয়া করা যাত্রীদের জন্যও এটি অপ্রতুল। তাই তিনি দক্ষিণাঞ্চলবাসীর একমাত্র বিমান বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের পাশাপাশি যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধির জন্য জরুরি ভিত্তিতে বিমানবন্দরের উন্নয়ন-সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছেন।

সূত্রমতে, ১৯৯১ সালে নেওয়া প্রকল্পের আওতায় নির্মিত টার্মিনাল ভবনের ব্যবহার ১৯৯৫ সালে শুরু হয়। তখন এ বন্দর দিয়ে সপ্তাহে মাত্র দুইদিন বিমান চলাচল করতো। তখনকার তুলনায় বর্তমানে প্রায় ২০ গুণ বেশি যাত্রী চলাচল করলেও টার্মিনালের আয়তন আর বাড়েনি। এমনকি গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গাটিও তার ধারণক্ষমতা হারিয়েছে বহু বছর আগে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানবন্দরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের কারণে যাত্রীদের ভিড় সামলাতে আমাদের প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেক সময় যাত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করা রীতিমতো কঠিন হয়ে পরে। এখানে বিমানে ওঠানামার সব সুবিধা অনুপস্থিত। রানওয়ে এতো ছোট যে পাশাপাশি দুটি বিমানের অবস্থান করতেও অসুবিধা হচ্ছে। এখানকার অ্যাপ্রোনের আকার ২০০ ফুট প্রস্থ ও ২৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের।

সিভিল এভিয়েশনের প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইটিএও) নীতিমালা অনুযায়ী যেকোনো বিমানবন্দরে রানওয়ের কেন্দ্র থেকে দুইদিকে কমপক্ষে ৫০০ ফুটের মধ্যে কোনো স্থাপনা থাকতে পারবে না। কিন্তু এখানে ২০০ ফুটের মধ্যে নিরাপত্তাবেষ্টনী রয়েছে। এছাড়া ১৬০ একর জমির ওপর নির্মিত বিমানবন্দরটি নিরাপত্তার দিক থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তাদের (আইটিএও) সুপারিশ অনুযায়ী রানওয়ে সম্প্রসারণসহ অবকাঠামোগত ঝুঁকি দূর করতে এর আয়তন ৩২৫ একর বাড়াতে হবে।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, এখানে বিমান ওঠানামায় ব্যবহৃত ল্যান্ডিং ইকুইপমেন্টও আধুনিক নয়। বিমানের এক পাইলট জানান, আইএলএস থাকলে শীত মৌসুমে ঘণ কুয়াশা কিংবা পাইলট অসুস্থবোধ করলেও অটো পাইলটে খুব সহজে বিমান অবতরণ করতে পারে। দেশের যেসব বিমানবন্দরে এখনো আইএলএস নেই, সেখানে অন্তত ডিভি ওয়্যার আছে। এ সিস্টেমেও বিমান উড্ডয়ন কিংবা অবতরণে খুব একটা সমস্যা হয়না। বরিশাল বিমানবন্দরে যে সিস্টেম রয়েছে তা পুরোনো হওয়ায় অনেক সময় উড্ডয়ন ও অবতরণে মানসিক চাঁপে পরতে হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের প্রায় সব বিমানবন্দরে বর্তমানে উন্নয়ন ও সস্প্রসারণের কাজ চলছে। এসব কাজে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে। অথচ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বরিশাল বিমান বন্দর মেরামত ও সংস্কারের জন্য কিছু টাকা দেওয়া হয়েছিল। এরপর আর কোনো বরাদ্দ আসেনি।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলেন, আইএলএস সিস্টেম বাংলাদেশের কোনো বিমানবন্দরে নেই। এছাড়া বরিশাল বিমানবন্দরে বর্তমানে যে সিস্টেম রয়েছে, একে খুব বেশি পুরোনো বলা যাবেনা। আমরা বর্তমানে সেখানে পারফরম্যান্স বেইজড ল্যান্ডিং সিস্টেম চালু করেছি। এটা যথেষ্ট আধুনিক। এ সিস্টেমে উড্ডয়ন ও অবতরণে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেন বলেন, বরিশাল বিমানবন্দর সস্প্রসারণসহ আধুনিকীকরণের পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত জরিপ হলেও করোনার কারণে কাজে কিছুটা ধীরগতি তৈরি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সিভিল এভিয়েশনে খুব শীঘ্রই দেড় হাজারের বেশি লোক নিয়োগ দেওয়া হবে।

উল্লেখ্য, আকাশ থেকে শস্যখেতে কীটনাশক ছিটানোর কাজে ব্যবহারের জন্য ১৯৬৩ সালে বরিশাল নগরী থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরত্বের বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নে ‘প্ল্যান্ট প্রোটেকশন’ বন্দর হিসেবে দুই হাজার ফুট রানওয়ে নির্মাণ করা হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৮৫ সালে এটিকে বিমানবন্দরে রূপান্তর করা হয়। এরপর ১৯৯৫ সালের ১৭ জুলাই থেকে দিনের বেলা ঢাকা-বরিশাল রুটে বাণিজ্যিক বিমানের চলাচল শুরু হয়।

(টিবি/এসপি/সেপ্টেম্বর ২১, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test