E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শ্যামনগরে ভূমি কর্মকর্তা, সন্ত্রাসী ও দালালদের অত্যাচারে জমি ও জীবন হারাচ্ছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ

২০২১ অক্টোবর ০৫ ১৮:৪৮:২৬
শ্যামনগরে ভূমি কর্মকর্তা, সন্ত্রাসী ও দালালদের অত্যাচারে জমি ও জীবন হারাচ্ছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : অসাধু ভূমি কর্মকর্তা, সন্ত্রাসী ও দালালদের অত্যাচারে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ হারাচ্ছেন জমি ও জীবন।

সরেজমিনে সোমবার দিনভর শ্যামনগরের নূরনগর, রমজাননগর, ভুরুলিয়া ও কৈখালি ইউনিয়ন ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।

নূরনগর ইউনিয়নের হরিনাগারি গ্রামের মহেন্দ্রনাথ সরদার জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। স্ত্রী সীতা বালা সরদার রোগাক্রান্ত। ১৯৯৩ সালের ৪ জুলাই ৩৩২৯ নং রেজিষ্ট্রি দলিল মূলে ৯০ শতক জমির চিরস্থায়ী বসে বন্দোবস্ত পান তারা। ওই জমি তারা শান্তিপূর্ণ ভোগ দখলে থাকাকালিন একই গ্রামের পুটে সরদারের ছেলে জালাল উদ্দিন সরদার গায়ের জোরে ৩৮ শতক জমি দখল করে নেয়। প্রতিবাদ করায় তাকে ও তার ছেলে গৌর সরদার ও নিতাই সরদারকে একাধিক বার মারপিট করা হয়। বিষয়টি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনকে জানিয়েও কোন লাভ হয়নি। ফলে জীবন বাঁচাতে দু’ সন্তানকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। জালালউদ্দিন সরদারের কাছ থেকে ওই জমি উদ্ধার করে দেওয়ার কথা বলে আব্দুল আজিজ খোকন,তার দু’ ছেলে আবুল কালাম ও মোহাম্মদ আলী তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে।

গত ৩ আগষ্ট বিকেলে তাকে রাস্তায় ডেকে অলিখিত একটি ১০০ টাকার ও একটি ৫০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্টাম্পে সাক্ষর করতে বলে আব্দুল আজিজ খোকন ও তার ছেলেরা। রাজী না হওয়ায় তাকে একটি পিলারের সঙ্গে বেঁধে রেখে তার কাছ থেকে জোরপূর্বক সাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে জানাজানি করলে জীবননাশের হুমকি দিলে চেয়ারনম্যান বখতিয়ার আহম্মেদকে জানালে তিনি আইনে সম্প্রতি আব্দুল আজিজ খোকন ওই স্ট্যাম্প মূলে জমি দাবি করে তাতে ঘর বাঁধার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। এ প্রতিবেদকের উপস্থিতিতে শ্যামনগর থানার উপপরিদর্শক রিপন মল্লিক সোমবার দুপুরে ঘটনাস্থলে এলে তিনি অভিযোগের সত্যতা পেয়ে উভয়পক্ষকে ১০ সেপ্টেম্বর কাগজপত্রসহ থানায় যেতে বলেন।

শ্যামনগরের তেঘরিয়া গ্রামের কেনা সরদারের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু বক্কর ছিদ্দিকের ২০১০ সালের ৮ মার্চ দায়েরকৃত যুদ্ধাপরাধী মামলার আসামী (সিআরপি-১০০/১০)কৈখালি ইউনিয়নের মেহেন্দীনগরের মোমরেজ গাজী ওরফে মোবারক গাজী, লুৎফর রহমান, গোলাম মুছা ও আব্দুল আজিজ। ১৯৭১ সালে পুলিশের পোশাক পরে মোমরেজ গাজী ভারতে যাওয়ার সময় হিন্দুদের লুটপাট করেছেন। ধর্ষণ করেছেন হিন্দু নারীদের। তার ছেলে ইউপি সদস্য ফজলুর রহমান, নুরুল ইসলাম বাবুরালি ও মোস্তফা নুন্তু। ২০০৭ সালের ২৮ মে সকাল ১১টায় হিমাংশু মণ্ডল ও সুধাংশু মণ্ডলের বাড়িঘর ও মন্দির ভাঙচুর করে দখলে নেওয়ার সময় প্রতিবাদ করায় শফিউর রহমানের ছেলে শাহজাহান আলীকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে তারা। দখলে নেয় ওই দু’ সহোদরের সাত বিঘা জমি দখল করে নেয়। শাহজাহান হত্যা মামলা (জিআর-১৮৮/০৭, সেশন-১৬৬/১৩) বর্তমানে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ২য় আদালতে বিচারাধীন।

এ ছাড়া মেহেন্দীনগরের কমপক্ষে ১৫টি পরিবার ফজলু মেম্বর ও তার ভাইদের কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। ফজলু মেম্বর কেখালি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তৎকালিন তহশীলদার ইয়াছিন আলীকে ব্যবহার করে অফিসের পরিচ্ছন্ন কর্মী আলমগীর বাদশাকে দিয়ে কোন ওয়ারেশ নেই দেখিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে সুভেন্দ্রনাথ মণ্ডলের সাড়ে ১৩ বিঘা জমি খাস করিয়েছেন। এর মধ্যে সুভন্দ্র মণ্ডলের দখলে সাড়ে চার বিঘা থাকলেও নয় বিঘা জমি ফজলু মেম্বর তার আত্মীয় আবুল হোসেনসহ চারজনের নামে বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। এতেও শান্তি হননি ফজলু মেম্বর। ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে ছুন্নত গাজীর ওয়ারেশদের কাছ থেকে দু’টি দলিল মূলে কেনা এক একর ১০ শতকসহ সাড়ে চার বিঘা জমির মাছের ঘের ২০১৮ সালের ৩০ এপ্রিল তারই নির্দেশে লুটপাট করেছেন আমজাদ গাজী, আব্দুর রাজ্জাক গাজী, আবুল হোসেনসহ কয়েকজন। বিষয়টি থানায় এজাহার দেওয়ার পর ফজলু মেম্বব স্থানীয়ভাবে মিটিয়ে দেওয়ার জন্য উপপরিদর্শক হাবিবুর রহমানের কাছ থেকে সময় নেন। বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর শুভেন্দ্র মণ্ডল সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ করলে তিনি শ্যামনগর থানাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাা নেওয়ার নির্দেশ দেন। এরপরও ফজলু মেম্বরের হস্তক্ষেপে মাছ লুটপাট ও ছেলে বিধু ভূষণ মণ্ডলকে মারপিটের কোন মামলা হয়নি। উপরন্তু মফজুল মেম্বর তিন মাস আগে ওই সাড়ে চার বিঘার মাছের ঘেরের ভেড়ি কেটে আত্মীয় আবুল হোসেনের ১০ শতক ঘেরের সঙ্গে একাকার করে দিয়ে দখলে নিয়েছেন।

শুভেন্দ্র মণ্ডলের চাচাত ভাই পঞ্চানন কুমার মণ্ডলের ভাই সমুজিৎ মণ্ডল ফজলু মেম্বরের কালাত বোন মরিয়মের সঙ্গে ভালবাসা করে দেশ ত্যাগ করে। এ ঘটনায় ফজলু মেম্বর পঞ্চানন মণ্ডলের সাত বিঘা জমি দখল করে নিয়েছে ২০০৭ সালে। এক ছেলে ভারতে থাকে এমন অভিযোগে তার অর্ধেক জমি কৈখালি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশীলদার সুধীন সরকার ও পরিচ্ছন্ন কর্মী আলমগীর বাদশাকে দিয়ে খাস করিয়ে দেবেন হুমকি দিয়ে পঞ্চানন মণ্ডলের কাছে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে ৭০ হাজার টাকা আদায় করেছেন ফজলু মেম্বর ও তার সহযোগী লোকমান। গত ৪ জুন খালত বোন মরিয়মকে ১৫ দিনের মধ্যে তাদের কাছে এনে দেওয়ার জন্য আল্টিমেটচাম দেয় ফজলু মেম্বর। তা না হলে তার তিন বিঘা জমি দখল করে নেওয়ার হুমকি দেওয়ায় পর দিন ভোরে বাড়ির পাশে নিম গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় পঞ্চাননের লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অভিযোগে পঞ্চাননের ছেলে পলাশ মণ্ডল ১১ জুলাই ফজলু ও লোকমানসহ তিনজনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করে। গত ২০ সেপ্টেম্বর উপপরিদর্শক আইনুদ্দিন ওই আসামীদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছেন।

মেহেন্দীনগরের জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ফজলু মেম্বরের বিরুদ্ধে তার ভাই জাকির হোসেনের ঘেরে চাঁদাবাজি ও লুটপাটের মামলা(টিআর-৪৭/১১) সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে চলামান রয়েছে। এ ছাড়া কালীগঞ্জের ভদ্রখালি গ্রামের ব্যবসায়ি বাপ্পির বাড়িসহ দু’ বিঘা জমি জবর দখল ও লুটপাটের অভিযোগে গত ২৪ সেপ্টেম্বর থানায় মামলা হয়েছে। তবে মঙ্গলবার বিকেলে ফজলু মেম্বরের সঙ্গে তার ০১৮১৯-০৪১৪৮৩ নং মুঠোফোনে যোগোযোগের চেষ্টা করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

স্থানীয়রা জানান, কালীগঞ্জের নলতার সুধীন সরকার কৈখালি ভূমি অফিসের পরিচ্ছন্ন কর্মী ছুন্নতের স্ত্রীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলেছেন। হিন্দুদের সম্পত্তি ওয়ারেশ নেই ছুন্নতের ছেলে পরিচ্ছন্ন কর্মী আলমগীর বাদশার কথামত মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে খাস করে অন্যত্র বন্দোবস্ত দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। ছুন্নত গাজীর স্ত্রীকে খুশী রাখতে ভুমি অফিস সংলগ্ন নয় বিঘা সরকারি খাস জমি ভাগে দেওয়ার নামে বিনা পয়সায় ইজারা দিযেছেন তহশীলদার সুধীন সরকার। ক্ষমতার দাপট দেখাতে আলমগীর বাদশা তার ভাইকে কৈখালি ভূমি অফিসের কম্পিউটর ম্যান হিসেবে যোগদান করিয়েছেন। বাদশা ভূমি অফিসের সামনে মেইন সড়কের পাশে মান্দার নদীর চরভরাটি জমি দখল করে দোকান ঘর বানিয়েছেন। যদিও সুধীন সরকার ছুন্নত গাজীর স্ত্রীর সঙ্গে কোন অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা ও অবৈধভাবে বাদশাকে সরকারি জমি ভোগদ খল করার কথা অস্বীকার করেছেন সুধীন সরকার।

তিনি বলেন, অনেকেকে তার বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে জায়গা ডিসআর না দেওয়ার অভিযোগ কররেও কেউ কোন ঘুষ দূর্ণীতির প্রমান দিতে পারবে না। তবে বিকল্প কোন লোক না পাওয়ায় অভিযোগ থাকার পরও বাদশাকে তার অফিসে রাখা হয়েছে।

ভুরুলিয়া ইউনয়নের কাছরাহাটি গ্রামের উৎপল মণ্ডল বলেন, সরকারিভাবে ভুলবশতঃ জমির সিসি কেস করায় তার টাকা জমা দেওয়ার পরও এক একর তিন শতক জমি খাস করে স্থানীয় ভূমি অফিস। সাতজনকে ডিসিআর দেওয়ার পর তা সাতক্ষীরার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের(রাজস্ব) কাছে স্থগিত করা হয়। এরপরও উপজেলা সহকারি ভূমি কমিশনার আব্দুল হাই ওই জমি সাংসদ জগলুল হায়দারের ছোট চাচাসহ ১৪জনকে ডিসিআর দিয়েছিলেন। ওই জমি জবরদখলে বাধা দেওয়ায় তাদের উপর হামলা চালিয়ে তাকেসহ সাতজনকে পিটিয়ে জখম করা হয়। থানায় মামলা হলেও বিচারের গতি নেই। ভুরুলিয়ার দেবেন মণ্ডলের জমি দখল করতে তার ছেলেকে হত্যা করে বাড়ির উঠানের আমগাছে ঝুলিয়ে রাখে একই এলাকার জবেদ আলীও তাদের সহযোগীরা। ওই হত্যা মামলার তদ্বিরকারি হিসেবে দেবেন মণ্ডলের ছোট ছেলেকে হত্যা করতে এসে মা বোনসহ তিনজনকে নৃশংশভাবে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এখন তারা জীবন বাঁচাতে জমি ফেলে রেখে খুলনায় বসবাস করেন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ হিন্দু পরিষদের শ্যমানগর শাখার সভাপতি অনাথ মণ্ডল জানান, হুমকি ধামকি, জাল দলিল তৈরি ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করে হিন্দুদের দেশ ত্যাগ করানোর চেষ্টা অব্যহত রয়েছে। এদের পিছনে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় নেতাদের মদত। ফলে অনেকে প্রতিকার পাচ্ছে না।

(আরকে/এসপি/অক্টোবর ০৫, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test