E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শোকগাথার এক বছর

প্রাণহানি ১১৩৫ :আহত ২৪৩৮ :পরিচয় মেলেনি ১০৫ :পঙ্গু ৪০০

২০১৪ এপ্রিল ২৪ ১৫:৩৮:৩৩
প্রাণহানি ১১৩৫ :আহত ২৪৩৮ :পরিচয় মেলেনি ১০৫ :পঙ্গু ৪০০

স্টাফ রিপোর্টার : সাভারে রানা প্লাজা ধসের সেই বিভীষিকাময় ঘটনার বছর পূর্তি আজ। নিহত ১১৩৫ জন শ্রমিকের স্বজনদের তীব্র কষ্টের বছর পূর্তি হচ্ছে আজ। চার শতাধিক পঙ্গু শ্রমিকের তীব্র যন্ত্রণারও আজ এক বছর হচ্ছে।

এই এক বছরে মেলেনি দাফনকৃত ১০৫ জনের পরিচয়। যে ২,৪৩৮ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন তারা ভুলতে পারেনি সেই দিনের দু:সহ অভিজ্ঞতার কথা। তবে যাদের ভুলে যাওয়ার কথা ছিল না, তারা ঠিকই ভুলে বসেছেন ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কথা। অথচ আশ্বাস, ভাষণ-বক্তৃতার কমতি ছিল না এই এক বছরে। তৈরি পোশাকের যারা ক্রেতা, সেই পশ্চিমা বিশ্ব দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন ইস্যুতে এই একটি বছর অনেক হৈ চৈ করেছে এবং করছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় তেমন কিছু করেনি।

ঘটনার পর শ্রমিকদের পাশে এসে দাঁড়ান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার হস্তক্ষেপে সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, র্যাব, আনসার ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেদের বেতন থেকে ও কল্যাণ ফান্ড থেকে অর্থ সহায়তা দিয়েছে। বিজিএমইএ, ব্যবসায়ী সংগঠন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ সাধারণ মানুষ আর্থিক- চিকিত্সা সামগ্রী দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।

ঘটনার পর পর আটকে পড়াদের উদ্ধারে এগিয়ে আসে সাধারণ মানুষ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী, র্যাব, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন। সেই সময় শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ায় সবকটি রাজনৈতিক দল। আহতদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের চিকিত্সক, নার্স, কর্মকর্তা কর্মচারী ও বেসরকারি সংস্থাসমূহ।

আহতদের সাভার সিএমএইচে, সিআরপি এবং বেসরকারি এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ স্থানীয় ২২টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিত্সা দেয়া হয়। গুরুতর আহত ৮৫০ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, পঙ্গু হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা সিএমএইচ, বারডেম, অ্যাপোলো, ইউনাইটেড ও স্কয়ার হাসপাতালে চিকিত্সাসেবা দেয়া হয়। এছাড়া ঐ সময় রাজধানীর প্রায় সকল সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের চিকিত্সা দিয়ে সহযোগিতা করেছে।

উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়ে মারা গেছেন বেসরকারি উদ্ধারকর্মী ইজাজ উদ্দিন চৌধুরী কায়কোবাদ। তার চিকিত্সার জন্য সিঙ্গাপুর পাঠাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। অশনাক্ত শ্রমিকদের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ৫০ লাখ টাকা দেন প্রধানমন্ত্রী। নিহত শ্রমিকদের স্বজনদের প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল হতে ২২ কোটি ১১ লাখ ৫২ হাজার ৭২০ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। ২২টি হাসপাতাল ওই সময় চিকিত্সাধীন শ্রমিকদের চিকিত্সাসেবার জন্য ১ কোটি ৪২ লাখ ১৪ হাজার টাকা দেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া পুনর্বাসন কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন প্রধানমন্ত্রী। বিজিএমইএসহ অন্যান্য সংগঠন নিহত শ্রমিকদের পরিবারের আর্থিক সহায়তাসহ পুনর্বাসন সহযোগিতা করেছে।

রানা প্লাজায় দুর্ঘটনার জন্য

গার্মেন্টস মালিকরাই দায়ী

ঘটনার আগের দিন রানা প্লাজার ভবনের তৃতীয় তলায় পিলারে ফাটল দেখা দেয়। তখনই চারটি গার্মেন্টস মালিকরা শ্রমিকদের ছুটি দেয়। ভবনের মার্কেট বন্ধ করে দেয়া হয়। ঐদিন দুপুরে পৌর মেয়র হাজী রেফায়েত উল্লাহ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা প্রধান প্রকৌশলীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রানা প্লাজায় যান, সবাই ভবনটির ফাটল দেখে বন্ধ রাখার পক্ষে মত দেন। পাশাপাশি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে বিশেষজ্ঞ এনে ভবনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে উপস্থিত কর্মকর্তারা মতামত দিয়েছিলেন।

ভবন মালিক সাভার পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সোহেল রানা ওরফে রানা ওই দিন সন্ধ্যায় রাজ্জাক নামে এক প্রকৌশলীকে ডেকে আনে। ঐ প্রকৌশলী ভবনের ফাটল দেখে বলেন, ফাটল নিয়ে কোন সমস্যা নেই এবং ভবনে কাজ করা যাবে। রাতে সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একই সুরে বললেন, এ ফাটলে কাজ করা যাবে। রাতে শ্রমিকদের কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়া হয়। ভবনের বেইজমেন্টে মার্কেট অফিস ও গ্যারেজ, নিচ তলায় ব্র্যাক ব্যাংকের এটিএম বুথ ও বিভিন্ন আইটেমের দোকান, দোতলায় ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা, ফাস্টফুডের দোকান ও বিভিন্ন সামগ্রীর দোকানপাট। তৃতীয় তলায় নিউওয়েভ বাটন লিমিটেড, চতুর্থ ও ষষ্ঠ তলায় ইথারটেক্স লিমিটেড, পঞ্চম তলায় বারটেক্স লিমিটেড এবং সপ্তম ও অষ্টম তলায় নিউওয়েভ স্টাইল লিমিটেড নামের গার্মেন্টস ছিল। নবম তলায় রানা প্লাজার ৪টি গার্মেন্টস ছাড়াও ছিল কয়েকটি ব্যাংকসহ দোকানপাট।

পরদিন সকালে ৮টায় শ্রমিক আসে। তারা ভবনে ঢুকতে চাননি। রানাসহ ৪টি গার্মেন্টস মালিকরা শ্রমিকদের চাকরি হারানোর ভয় দেখায় এবং বিভিন্ন হুমকি দেয়। অবশেষে ৯টার দিকে ৪টি গার্মেন্টসে প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক কাজে যোগদান করেন। যোগদানের কয়েক মিনিট পর বিদ্যুত্ চলে যায়। ভবনের ৯ তলায় বিশাল আকারের জেনারেটর চালু করে কর্তৃপক্ষ। এ জেনারেটর চালুর সময় ঝাঁকুনি দিয়ে হুড়মুড় করে ধসে পড়ে ৯ তলা রানা প্লাজা। মুহূর্তে হাজার হাজার লোক যার যা আছে তা নিয়ে উদ্ধারে নেমে পড়ে। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী, র্যাব, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে ছুটে আসে।

বেসরকারি সংস্থার কয়েক হাজার কর্মী। সরকারিভাবে খোলা হয় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। ঐ সময়ের সাভার ক্যান্টনমেন্টের ৯ম পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সোহরাওয়ার্দীর সার্বিক পরিচালনায় উদ্ধার কাজ চলে। ১৭ দিনের মাথায় ১০ মে বিকাল ৪টা ২৭ মিনিটে মেজর মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে গার্মেন্টস শ্রমিক রেশমাকে উদ্ধার করা হয়। তিনি হলেন সর্বশেষ উদ্ধার হওয়া গার্মেন্টস কর্মী। টানা ৪০৮ ঘন্টা ধ্বংসস্তূপে ছিলেন রেশমা। তার উদ্ধারের তিন দিন পর অর্থাৎ ২০ দিনের মাথায় আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধার কার্যক্রম শেষ করা হয়। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ছাড়াও আস্থা মনোবল ও নিষ্ঠার সঙ্গে বাঙালিরা এত বড় দুর্ঘটনায় সফল উদ্ধার কার্যক্রম শেষ করায় জাতিসংঘসহ সারা বিশ্ব প্রশংসা করে। দুর্যোগে বাংলাদেশের এ উদ্ধার কার্যক্রম বিশ্বের জন্য একটি মডেল বলে মন্তব্য করেছে জাতিসংঘ। এ ভবন ধসে শ্রমিক ছাড়াও ফ্যান্টম অ্যাপারেলের নির্বাহী পরিচালক এমএম আবু সাঈদ ও ইথারটেক্সের কর্মকর্তা মো. ইসহাক নিহত হয়েছে। তাদের সন্তানদের বিনা খরচে লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি বিজিএমইএর পক্ষ থেকে সহযোগিতা করেছে। রানা প্লাজার ঘটনায় পুলিশের পক্ষে হত্যার চেষ্টা সাভার থানায় মামলা দায়ের করা হয়। রাজউকের পক্ষ থেকে আরো একটি মামলা করা হয়। বিষয়টি এখন বিচারাধীন।

যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেয়ে শ্রমিকের আত্মহত্যা মাথার তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে এ বছরের জানুয়ারিতে আত্মহত্যা করেছেন তুরাগের বামনারটেক এলাকার সালমা খাতুন। রানা প্লাজা ধসে তার মাথায় আঘাত লাগে। মাথায় তার তীব্র যন্ত্রণা হত। যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে তিনি আত্মহত্যা করেন বলে জানান সালমার স্বামী বাবু।


(ওএসিএটিিএপ্রিল ২৪, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test