E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দেবহাটায় পুলিশ হেফাজতে মারা যাওয়া বাবলু সরদারের পরিবারে অজানা আতঙ্ক

২০২১ ডিসেম্বর ১৫ ১৮:৫৪:০৮
দেবহাটায় পুলিশ হেফাজতে মারা যাওয়া বাবলু সরদারের পরিবারে অজানা আতঙ্ক

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : ফেনসিডিলসহ আটকের পর গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার সদর ইউনিয়নের বসন্তপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সন্তান বাবলু সরদারের বাড়িতে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। ওই বাড়িতে কে কখন যাচ্ছে, কে কার সঙ্গে কথা বলছে তা নিয়ে চলছে কঠোর নজরদারি। সরেজমিনে মঙ্গলবার সকালে বাবলু সরদারের বাড়িতে গেলে এ দৃশ্য দেখা গেছে।

বাবলু সরদারের বাড়িতে যেয়ে দেখা গেছে ছেলে আল আমিনের বাড়ির তৈরির জন্য প্রস্তুতকৃত উঁচু ভিটার উপর কয়েকজন বসে আছে। সাইফুল ইসলাম নিজেকে নিজেকে বাবলু সরদারের শ্যালক পরিচয়ে বসতে বলেন। সামনে বসে থাকা বাবলু সরদারের মেয়ে সুলতানা মুন্নির সঙ্গে কথা বলতে চাইলে সাইফুলের ইশারায় সে চলে যায়। কথোপকথনের একপর্যায়ে বাবলু সরদারের বসত ঘর দেখিয়ে দেন। বসত বাড়িটি ছিল ভূমিহীনদের খুপড়ি ঘরের চেয়েও নিম্ন মানের। একজন মাদক ব্যবসায়ির বাড়ি এত খারাপ হতে পারে সেটা ভাবা যায় না। ফেনসিডিল দিয়ে দুলা ভাইকে গ্রেপ্তার করানো পরিকল্পিত হতে পারে বলে তিনি মনে করেন। তবে নিজে থানায়, ডিবি কার্যালয়ে না গেলেও যেভাবে কথা বললেন তাতে মনে হয়েছে তিনি গলায় কড সুতো দিয়ে আত্মহত্যা করা বাবলু সরদারের লাশ দেখেছেন বা কারো প্রেসক্রিপশান বাস্তবায়ন করে চলেছেন। উচ্চ রক্তাচাপ ও ডায়াবেটিকসে আক্রান্ত দুলা ভাই কোমরে কড সূতা পরতেন দাবি করে তিনি বলেন, মেয়েটা বিয়ে দেওয়ার জন্য যোগাযোগ চলছিল। এমন সময় এ ধরণের গ্রেপ্তারে মান সম্মানের দায়ে সে আত্মহত্যা করেছে। তবে এ নিয়ে আর বেশিদূর এগিয়ে যাওয়ার দরকার নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। কথা বলার একপর্যায়ে গোয়েন্দা সংস্থার দু’জন লোক বেড়িবাঁধের উপর রয়েছেন বলে তার কাছে একটি মোবাইল ফোন আসে।

মৃত বাবলু সরদারের পুত্রবধু এহসেনআরা জানান, তার শ্বশুর জুড়ন সরদার, চাচা শ্বশুর আব্দুল মজিদ ও বাহাদুর সরদার মুক্তিযোদ্ধা। ১১ ডিসেম্বর শনিবার সকাল ১০টার দিকে তাদের গ্রামের পুটে সরদারের শ্যালিকা সদর উপজেলার চৌবাড়িয়া গ্রামের বোরকা পরা নারী মুন্নি খাতুন আকস্মিকভাবে তাদের বাড়িতে ঢুকে তার শ্বশুড়ি শাহানারা খাতুনের কাছে পানি চায়। পানি পান করে সে চলে যাওয়ার পরপরই গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক মনির ও উপপরিদর্শক এনামুলসহ দুই কনস্টেবল ঘরে ঢুকে শ্বশুরকে ডেকে এসে দরজার বাইরে থাকা একটি প্যাকেটে ৫০ বোতল ফেন্সিডিল দেখিয়ে তার হাতে হাতকড়া পরান। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে শ্বশুরকে হ্যাণ্ডকাপ পরিয়ে মারপিট করার খবর পেয়ে বাড়ি থেকে ঢিঁল ছোঁড়া দূরত্বে বেড়িবাঁধের উপরে হাওয়া ভাটার পাখা প্রস্তুতকারি ছোট দেবর আলমগীর হোসেন ছুঁটে আসে। ঘটনা শুনে প্রতিবাদ করায় আলমগীরকেও পুলিশ মারপিট করে। পরে তার ঘরে ঢুকে পুলিশ শোকেজের মধ্যে থাকা বাড়ি তৈরির জন্য সখীপুর ব্রাক অফিস থেকে তোলা ৩৫ হাজার টাকা নিয়ে নেয়। এতে প্রতিবাদ করলে তাকেও গালিগালাজ করে পুলিশ পৌনে ১১টার দিকে শ্বশুরকে পুলিশের মোটর সাইকেলে বসিয়ে সাতক্ষীরায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন রবিবার দুপুরে তিনিসহ শ্বশুড়ি শাহানারা, বড়ভাসুর শাহীনুর, চাচা শ্বশুর ফজর আলী ও চাচী শ্বাশুড়ি রবিলা সাতক্ষীরার মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অফিসে হয়ে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে আসেন। সেখানে প্রথমে তাদেরকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পরে সেখানে যেয়ে গোয়েন্দা পুলিশ বাবার কোমরে থাকা কড সুতা গলায় পেঁচিয়ে গারদের জানালার সাথে আত্মহত্যা করেছে বলে জানায় পুলিশ। এ সময় শ্বশুরের এক পা, ও এক হাত মোড়ানো অবস্থায় ছিল। গারদ ঘরের মেঝে থেকে জানালার রড এর উচ্চতা ছিল দেড় হাতের মতো। লাশ ময়না তদন্ত ছাড়াই দেওয়ার কথা বলে তাদের কাছ থেকে একটি কগিজে সাক্ষর করিয়ে নেয় পুলিশ। এহছেনআরা বলেন, তার শ্বশুর কোমরে কখনও সুতালি(রশি) ব্যবহার করতেন না। তাহলে তিনি কিভাবে লকআপের মধ্যে আত্মহত্যা করলেন প্রশ্ন রেখে তিনি আরও বলেন, গেটের গ্রীলের সাথে নিজেকে সুতালিতে ঝুলিয়ে ওই টুকু উচ্চতায় কি কখনও আত্মহত্যা করা সম্ভব? পুলিশ তারা এর বিচার চান। রাত নয়টার দিকে পারিবারিক কবরস্থানে তার শ্বশুরের লাশ দাফন করা হয়। শুক্রবার বাড়িতে মিলাদ হবে।

সেখান থেকে উঠে পুকুর পাড়ে যেয়ে দেখা গেছে বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে ১৩ ডিসেম্বর জামিনে মুক্তি পাওয়া আল আমিন বাবার কবর পাকা করণের কাজ করছে শ্রমিকদের সাথে। পাশে তার মা শাহানারা, চাচা ফজর আলী, বড় ভাই শাহীনুর। শাহানারা খাতুন বলেন, স্বামী কোমরে ঘুনসি বা কটসুতো ব্যবহার করতেন কিনা তিনি না জানলেও পুলিশ জানতে পেরেছে এর চেয়ে আশ্চর্যের আর কি হতে পারে। । তিনি মনে করেন, ফেনসিডিল বহনকারি ওই মুন্নিকে পুলিশ ধাওয়া করলে সে তাদের বাড়ির মধ্যে ঢুকে ঘরের সামনে ফেনসিডিলের ব্যাগ ফেলে তার কাছে পানি চায় সে। সে চলে যেতে না যেতেই পুলিশ তার স্বামীকে আটক করে।

আল আমিন বলেন, বাবাকে মাদকসহ গ্রেপ্তার করার ঘটনা সাজানো। তবে এভাবে তাকে মরতে হবে সেটা কখনো ভাবেননি। এরপরও মাথা গোজার ঠাঁই করার জন্য ব্যারাক থেকে তোলা ৫০ হাজারের মধ্যে ৩৫ হাজার টাকা পুলিশ নিয়ে গেলো। আর বুঝি ঘর বানানো হলো না।

ফজর আলী সরদার বলেন, ভাই এভাবে মরতে পারে না। তারা বিচার চাওয়ার প্রস্তুতি নিলেও সোমবার রাত ৮টার দিকে আরমান মেম্বর, ভাইয়ের শ্যালক সাইফুলসহ তাদের পরিবারের সদস্যরা একত্র বসেন। সেখানে মেম্বর মামলা না করার জন্য তাদেরকে বার বার অনুরোধ করেন। মামলা না করলে নিজে ও আলফা ভাইকে দিয়ে জেলা পরিষদের সহায়তা পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্র“তি দেন। মামলা করলে বাড়ির ছেলে মেয়েদের উপর নতুন মামলা হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ সময় সুলতানা মুন্নি বলেন, তিনি ১২ ডিসেম্বর যা বলেছেন তাতে তিনি কঠোর রয়েছেন। তবে বিচার চাইতে দাবিকৃত নির্যাতনকারিদের শাস্তি চান কিনা তা জানতে চাইলে তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে সাংবাদিকদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাবলু সরদারের কয়েকজন প্রতিবেশি জানান, সাম্প্রতিক নির্বাচনে পরাজিত ইউপি সদস্য বহুল আলোচিত বিজিবি সদস্য আব্দুর জব্বার হত্যাসহ কমপক্ষে দু’ ডজন মাদক মামলার আসামী আরমান হোসেন। আব্দুল হাই খুব কম ভোটে জিতে যান। বাবলু সরদারসহ তার পরিবারের সদস্যরা আব্দুল হাই এর ভোট দেওয়ার কারণে বাবরু সরদারকে এভাবেই জীবন হারিয়ে প্রতিদান দিতে হলো।

আরমান হোসেন বলেন, বসন্তপুর গ্রামের পুটে সরদারের শ্যালিকা মুন্নি খাতুন মাদক ব্যবসায়ি বাবলুর কাছ থেকে মাদক কেনার একপর্যায়ে ধরা খেয়েছে। প্রায় দু’ মাস আগে বাবলু সরদারকে তার বাড়ির পাশের পুকুর পাড়ের বাগানের মধ্য থেকে ১৫ বোতল ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার করে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাতক্ষীরা অফিস। ওই মামলায় বাবলু তিন সপ্তাহ আগে জামিন পায়। মামলা করে ওই পরিবারের লোকজনদের ভোগান্তি বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।

নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য ডাঃ আব্দুল হাই বলেন, বাবলু সরদার ও তার পরিবারের সদস্যরা এবার নির্বাচনে তাকে ভোট দিয়েছিল। তাকে নির্বাচনের পর মাদকসহ গ্রেপ্তার করা, শ্রীরামপুরের বোরকা পরা মাদক ব্যবসায়ি মুন্নির উপস্তিস্থিতির পর মাদক উদ্ধার করার বিষয়টি গোলমেলে বলে তার মনে হয়েছে।

ইউপি চেয়ারম্যান আবু বক্কর জানান, এক সময়ে বাবলু সরদারের বিরুদ্ধে মাদক বিক্রির অভিযোগ ছিল । সম্প্রতি সাত- আট বছরে তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ শোনেননি।

জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক ইয়াসিন আলম চৌধুরী ১২ ডিসেম্বর এক প্রেস বিবৃতিতে জানান যে, চারটি মাদক মামলার আসামী বাবলু সরদারকে ১১ ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে ৫০ বোতল ফেনসিডিল ও ৩৫ হাজার টাকাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। পরিদিন তাকে আদালতে মামলা দিয়ে চালান দেওয়ার সময় তিনি জানতে পারেন যে বাবলু সরদার আত্মহত্যা করেছে। নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আক্তার হোসেন ও সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডাঃ জয়ন্ত সরকার এসে লাশ নামান । বিকেল ৫টার দিকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের মর্গে লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। তবে কর্তব্যে অবহেলার দায়ে সহকারি উপপরিদর্শক শেখ সোহেল রানা ও কনস্টেবল শরিফুল ইসলামকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ঘটনায় ১২ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গোয়েন্দা পুলিশের সহকারি উপপরিদর্শক শেখ সোহেল বাদি হয়ে সদর থানায় ৯৫ নং অপমৃত্যু মামলা করেছে।

(আরকে/এসপি/ডিসেম্বর ১৫, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

০৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test