E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

৩০৩ ছাত্র-ছাত্রীর সবাই অনুপস্থিত

বিদ্যালয়ে লেখাপড়া বন্ধ, ভূত আতঙ্কে উদ্বিগ্ন অভিভাবক

২০১৪ সেপ্টেম্বর ১৯ ১০:৫৪:৪১
বিদ্যালয়ে লেখাপড়া বন্ধ, ভূত আতঙ্কে উদ্বিগ্ন অভিভাবক

কলাপাড়া (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি : অজ্ঞাত রোগ আতঙ্কে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার হাজীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার এ বিদ্যালয়ে ৩০৩ ছাত্র-ছাত্রীর একজনও ক্লাসে আসেনি।

দুপুর একটা পর্যন্ত শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকলেও ছাত্র-ছাত্রী না আসায় তারা অলস সময় কাটিয়েছে। তবে ছাত্র-ছাত্রীরা জানায়, বিদ্যালয়ে ভূত ও জ্বীন আতঙ্কে তারা ক্লাসে যেতে ভয় পাচ্ছে। এ বিদ্যালয়ের নয় ছাত্র-ছাত্রী অজ্ঞাত রোগে গত এক মাস ধরে অসুস্থ্ থাকায় একং অস্বভাবিক আচরণ করায় অভিভাবকরাও আতঙ্কে তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে সাহস পাচ্ছে না।

সরেজমিনে বৃহস্পতিবার বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের প্রতিটি ক্লাসই শূন্য। বিদ্যালয়ের চারদিকে নীরবতা। সবার মুখেই আতঙ্কের ছাপ। বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে শিক্ষকরা গল্প করে অলস সময় কাটাচ্ছে।

গত এক মাস ধরে এ বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিতির হার কমতে থাকলেও বৃহস্পতিবার ছিল শূন্য উপস্থিতি। হাজিরা খাতায় দেখা যায় ৬ষ্ঠ শ্রেনীতে ৬০, সপ্তম শ্রেণিতে ৭২, অষ্টম শ্রেণিতে ৫৮, নবম শ্রেণিতে ৫৮ ও দশম শ্রেণিতে ৫৫ জন ছাত্র-ছাত্রী থাকলে গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার হাজিরা খাতায় কারো উপস্থিতি নেই।

স্থানীয়রা ও শিক্ষকরা জানান, গত ১৯ আগস্ট এ বিদ্যালয়ের লাবনী বৈদ্য, নিশি আক্তার, সোহেল, জান্নাতী ও ষষ্ঠ শ্রেণির সুমি, রুজিনা বেগম অসুস্থ্ হয়ে পড়ে। গত মঙ্গলবার হাজীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী সুমি ও ফাতেমা অসুস্থ্ হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের কলাপাড়া ও বরিশাল মেডিকেলে চিকিৎসা দেয়া হলেও রোগের কারণ বের করতে পারেনি চিকিৎসকরা।

বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র তানজিল খান জানায়, “সকালে ক্লাসে দেখি কেউ নাই। দুপুর ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর বাসায় ফিরে যাচ্ছি। একইভাবে অন্তত ২০ জন ছাত্র-ছাত্রী এভাবে ফিরে গেছে।”

অসুস্থ্ ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী রুজিনার মা আমেনা বেগম জানায়, “তার মেয়ে দুই দিন ধইর‌্যা কথা কয় না। হারদিন হুইয়া থাহে। ল্যাহাপড়া বন্ধ হইয়া গ্যাছে। মানুষ আইলে ফ্যাল ফ্যাল কইরা খালি চায়। মাঝে মধ্যে শুধু পানি চায়। একমাস ধইর‌্যা এইভাবে বিছানায় হুইয়া থাহে। মাঝে মধ্যে খিঁচ দিয়া ওডে। খালি ছটফট করে ও চিৎকার করে। এ সময় সামনে যে আসে তাকেও মারধর করে।”

রুজিনা কথা না বলতে পারলেও সে লিখে জানায় “তাকে “রামায়ণ” নামে একজন ধরেছে। স্কুলের সামনে আমড়া গাছে সে থাকে। রোজ দুইবার তাকে এসে মারধর করে। আর খালি ছাগল জবাই দিতে বলে। তার মতো অন্যদেরও একই অবস্থা বলে অসুস্থ্ ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকরা জানান।

একাধিক গ্রামবাসী জানান, বরিশাল থেকে প্রথম অসুস্থ্ ছয় জন ফিরে আসার পরই এলাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে তাদের ভূত ও জ্বীনে ধরেছে।

বিদ্যালয়ের সামনে প্রায় ২৫ বছরের পুরনো বিশাল একটি আমড়া গাছ আছে। ওই গাছটি কেটে তার গোড়ায় একটি ছাগল পুতে দিতে হবে। এছাড়াও ছয়টি ছাগল জবাই করে তার মাংস বিলিয়ে দিতে হবে। অসুস্থ্ ছাত্র-ছাত্রীদের স্বপ্নে এসে জ্বীন ও ভূতেরা এ নির্দেশ দিয়ে গেছে বলে তারা জানান।

এদিকে এ ঘটনায় গত বুধবার সকালে হাজীপুরসহ ছয় গ্রামের মানুষ ও ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতিতে বিদ্যালয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অভিভাবকরা তাদের আতঙ্কের কথা শিক্ষকদের জানান। কেননা প্রতিদিনই এভাবে ছাত্র-ছাত্রী অসুস্থ্ হয়ে পড়ছে। তারা এ রোগের কারণ না জানলেও জ্বীন ও ভূতের আচড় হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে।

সভায় বিদ্যালয় থেকে আতঙ্ক দূর করতে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জালাল উদ্দিনসহ তিন জনকে একজন ওঝা ও ফকির এনে এ ঝাড়ফুঁক করানোর দায়িত্ব দেয়া হয়।

এদিকে ভূত আতঙ্কে স্কুল সংলগ্ন হাজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি কমে গেছে বলে শিক্ষকরা জানান। এ কারণে গোটা এলাকায় এক ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক গ্রামবাসী জানান, বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি নিয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দ্বন্দ্ব রয়েছে। এ দ্বন্ধের কারণেও এ ভূত আতঙ্ক ছড়ানো হতে পারে। তবে যারা অসুস্থ্ সবাই যে অভিনয় করছে তা নয়। তারা সত্যিই অসুস্থ্। এর কারণ এখনই খুঁজে বের করতে না পারলে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যাবে।

বিদ্যালয় সংলগ্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নুর ইসলাম হাওলাদার (৮০) জানান, তিনি স্কুলের পাশে প্রায় আট বছর ধরে ব্যবসা করছেন। এবারের মতো ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে আর আতঙ্ক দেখেননি। ভয়ে কেউ স্কুলেই আসে না।

বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক পরেশ চন্দ্র মজুমদার জানান, তারাও এখন অসহায়। স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী না এলে তারা কাদের পড়াবেন। আজ (বৃহস্পতিবার) একজনও স্কুলে আসেনি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকও স্কুলে নেই। তবে অভিভাবকরা জানান, তিনি স্কুলে ঝাড়ফুঁক করাতে হুজুরের কাছে গেছেন।

প্রধান শিক্ষক মো. জালাল উদ্দিন জানান, তিনি জরুরি কাজে বাইরে আছেন। তবে কোন হুজুরের কাছে গিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।

এ ব্যাপারে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. কাজী রুহুল আমিন জানান, তিনি শুনেছেন স্কুলে একজনও ছাত্র-ছাত্রী আসেনি। এটা সত্যিই এখন তাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। স্কুলের বর্তমান সমস্যা নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

(এমকেআর/এনডি/সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test