E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সুপ্রিম কোর্টের আদেশ ও জেলা প্রশাসকের মতামত নিয়ে বিড়ম্বনায় ভূমিহীনরা

২০২২ জানুয়ারি ১৭ ২২:৩২:২৩
সুপ্রিম কোর্টের আদেশ ও জেলা প্রশাসকের মতামত নিয়ে বিড়ম্বনায় ভূমিহীনরা

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া ইউনিয়নের খলিশাখালির ১৩২০ বিঘা জমি মহামন্য সুপ্রিম কোর্টের আদেশ ও পরবর্তীতে জেলা প্রশাসকের মতামত নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন সেখানে বসবাসরত ভূমিহীনরা। তবে এ নিয়ে আইনগত জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন জ্যৈষ্ঠ আইনজীবী।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাওয়ার পরবর্তী কোন এক সময়ে পারুলিয়া মৌজার ৪৩৯.২০ একর জমি ফেলে রেখে চণ্ডিচরণ ঘোষ ও তার ওয়ারেশনগণ ভারতে চলে যান। ওই জমি ১৯৫৩ সালের ৪ মার্চ কলিকাতা সাবরেজিষ্ট্রি অফিসের ৬৯৪ নং রেজিষ্ট্রি বিনিময় দলিল মূলে দাবি করে আসছিলেন জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরি করে দাবি করে আসছিলেন আব্দুল মালেকসহ কয়েকজন। এ ছাড়া নিলাম খরিদ মূলেও ওই জমির একাংশ দাবি করে আসছিলেন কয়েকজন। সরকারি খাল বিল হিসেবে কিছু জমি থাকলেও ওই জমি এসএ রেকর্ডে মালিকানা দেখানো হয়। ওই জমি জনস্বার্থে খাস করার জন্য দেবহাটার মুক্তিযোদ্ধা জনাব আলী ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর সাতক্ষীরার যুগ্ম জজ দ্বিতীয় আদালতে ১৮/১০ নং দেওয়ানী (টাইটেল স্যুট) মামলা করেন। এর পাশাপাশি এসএ রেকর্ড সংশোধন ও বন্টননামার জন্য একই আদালতে চাঁদপুরের গোবিন্দ সরদার ও ফজর আলীসহ ছয়জন দেঃ ১০/১০ মামলা করেন। জমির মালিকদের বিনিময় দলিলের ৬১,৬২ ও ৬৩ পাতায় সাবেক ১৮১২ খতিয়ানের জমির বিবরনের হাতের লেখার সঙ্গে অন্যসব পাতার লেখান ভিন্নতা ও বেশকয়েকজন বিবাদী নিলাম ক্রয়ের মূল কাগজপত্র জমা না দিয়ে ফটোকপি জমা দেওয়া, জনস্বার্থে ব্যবহৃত খাল বিলের খাজনা আদায় না হওয়ায় নিলাম সংক্রান্ত বিষয়টি মহামান্য হাইকোর্টের ১৯৫০ সালের একুইজিসান এণ্ড টেনেন্সি এ্যক্ট অনুযায়ি এসএ রেকর্ড ভুল বলে মনে করেন যুগ্ম জেলা জজ এএইচএম মাহমুদুর রহমান। সেক্ষেত্রে বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব আলীর জনস্বার্থে সরকারি জমি হিসেবে সরকারিভাবে রিসিভার নিয়োগের আবেদন যথাযথ বলে মনে করে আদালত। সে অনুযায়ি ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি ওই জমি খাস সম্পত্তি হিসেবে উলে­খ করে অ্যাড. কুণ্ডু চৌধুরী বিকাশ ও অ্যাড. আশরাফুল আলম বাবুকে রিসিভার নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ দেন। এ জন্য সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারকে সহযোগতিার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এ আদেশের বিরুদ্ধে কাজী গোলাম ওয়ারেশসহ জমির দাবিদারগণ মহামান্য হাইকোর্টে ২১৬/১২ রিভিউ পিটিশন দাখিল করেন। শুনানী মেষে ২০১৬ সালের ১০ আগষ্ট আদালত ওই জমি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে মর্মে উলে­খ করে যুগ্ম জজ দ্বিতীয় আদালতের আদেশ বহাল রেখে ভূমি মন্ত্রণালয় ও সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসককে ওই জমি নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আইনানুয়ারি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়। একই সাথে রিসিভার নিয়োগের প্রয়োজন নেই বলে একই আদেশে বলা হয়। একপর্যায়ে সাতক্ষীরা জজ কোর্টের সরকারি কৌশলীর মতামত চাইলে অ্যাড. গাজী লুৎফর রহমান জেলা প্রশাসক মহোদয়কে প্রজ্ঞাপন জারি করে ২০(২) ধারায় ওই জমি খাস করা ও কথিত ভূমির মালিকদের বিরুদ্ধে ১৯৫৬ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত জমি জবরদখল করে মাছ চাষ করার দায়ে ২০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবির সুপারিশ করেন ।

হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে কাজী গোলাম ওয়ারেশ ও জমির মালিক দাবিদারগণ মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে ২৫৬৮/১৭ আপিল মামলা করেন। গত বছরের ২ ফেব্রুয়ারি আদালত নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখেন। কাজী গোলাম ওয়ারেশ , ডাঃ নজরুল ইসলাম ও জমির মালিক দাবিদাররা ওই আদেশ পূর্ণ বিবেচনার জন্য গত বছরের ৮ এপ্রিল মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে ১৬৮/২১নং সিভিল রিভিউ পিটিশন দাখিল করেন। যাহা আজো শুনানীর অপেক্ষায়। এরই মধ্যে গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর খলিশাখালির ওই জমিতে সাপমারা খালের দু’পাশে বসবসাসরত ও জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত সাত শতাধিক ভূমিহীন পরিবার বসব্সা শুরু করে। তাদের বিরুদ্ধে জমির মালিকানা দাবিদাররা এ পর্যন্ত ১৯টি মামলা করে। জেলা প্রশাসকের আহবানে এসে ভূমিদস্যুদের হাতে লাঞ্ছিত হন গোলাপ ঢালীসহ তিনজন ভূমিহীন নেতা। র‌্যাব এর সোর্সদের ম্যানেজ করে সটগান ও গোলাবারুদ দিয়ে ভূমিহীন জনপদে র‌্যাব দিয়ে অভিযান চালানোর অভিযোগ ওঠে ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে।

বর্তমানে খলিশাখালির ওই জনপদটি “শেখ মুজিবনগর খলিষাখালি ভূমিহীন আবাসন প্রকল্প” হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। দীর্ঘদিন ধরে ওই জমি সরকারি খাস জমি হিসেবে বন্দোবস্ত না পাওয়ায় ১০৬জন ভূমিহীনের পক্ষে আনারুল ইসলাম বাদি হয়ে মহামান্য হাইকোর্টে ৯৫৩৯/২০২১ নং রিট পিটিশন দাখিল করেন। আদালত গত বছরের পহেলা নভেম্বর এক আদেশে আদেশ প্রাপ্তির ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে ভূমিহীনদের জমি বন্দোবস্ত সংক্রান্ত আবেদনসমূহ নিষ্পত্তির জন্য সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। এরই মাঝে গত বছরের ২৯ নভেম্বর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক বিশেষ সভার রেজুলেশনে সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান আলোচনাসভায় মহামামন্য সুপ্রিম কোর্টে সিভিল রিভিউ পিটিশন ১৬৮/২১ মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ভূমিহীনদের উচ্ছেদ না করার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে জেলা প্রশাসক মোঃ হুমায়ুন কবীর“ খলিশখালি নামক স্থানে ৪৩৯.২০ একর সম্পত্তি ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি, খাস সম্পত্তি নয়। এই জমি অবৈধ দখলদারদের খালি করতে হবে। নইলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” বলে উলে­খ করেন। ভূমি সচিবসহ বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তটি সংগ্রহ করে জমির মালিক দাবিদার ডাঃ নজরুলসহ কয়েকজন ফটোকপি করে গত ৬ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকের কার্যালয় প্রাঙ্গনসহ বিভিন্ন স্থানে বিলি করে ফায়দা লোটার চেষ্টা করেছেন। স্থানীয় প্রশাসনকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন তারা। এরই অংশ হিসেবে গত শনিবার দুপুরে দেবহাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খলিশাখালি যেয়ে ভূমিহীনদের সরে যেতে সতর্ক করেছেন। এমনকি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে ভূমিহীনদের সরে যাওয়ার ব্যাপারে হুশিয়ারি দেওয়া হবে বলে জমির মালিক দাবিদাররা প্রচার চালাচ্ছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি এটর্নি জেনারেল অ্যাড. সুজিত কুমার চ্যাটার্জী বলেন, মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট খলিশাখালির ১৩২০ বিঘা জমি সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসককে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া ও দেখভালের দায়িত্ব দেওয়ার নির্দেশটাই জমির মালিক দাবিদারদের বিপক্ষে গেছে। কারণ কোন ব্যক্তি মালিকানা সম্পত্তির ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক মহোদয়কে নির্দেশনা দেওয়ার কোন নজির নেই। তা ছাড়া ওই আদেশ কাজী গোলাম ওয়ারেশ, ডা. নজরুল ইসলামসহ জমির দাবিদারদের স্বত্বহীন করায় তারা মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে সিভিল রিভিউ ১৬৮/২১ দাখিল করেছেন। সেক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের আদেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের আদেশ। যাহা আদালত অবমাননার শামিল হিসেবে ধরতে পারেন উচ্চ আদালত।

(আরকে/এএস/জানুয়ারি ১৭, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test