E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে মেয়েকে ধর্ষণ চেষ্টার মিথ্যা ঘটনা সাজিয়ে থানায় অভিযোগ সৎ বাবার

২০২২ ফেব্রুয়ারি ০৬ ১৫:০৫:২৯
প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে মেয়েকে ধর্ষণ চেষ্টার মিথ্যা ঘটনা সাজিয়ে থানায় অভিযোগ সৎ বাবার

সোহেল সাশ্রু, কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে তিন ভাইরা ভাইসহ প্রতিপক্ষদের ফাঁসাতে মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টার মিথ্যা ঘটনা সাজিয়ে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর থানায় লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছে সৎ বাবা।

গত ২ ফেব্রুয়ারি বুধবার কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার ভোগপাড়া গ্রামের বাদল মিয়ার ভারাটিয়া মো. রাসেল মিয়া (৩৫) তার তিন ভাইরা ভাইসহ ৬ জনের নামে সৎ মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ এনে কুলিয়ারচর থানায় অভিযোগটি দাখিল করে।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গত ১ জানুয়ারি বিকাল ৪টার দিকে মো. রাসেল মিয়ার স্ত্রী মোছা. কুলসুম আক্তার ওরুফে মোছা. সাথী আক্তার তার আগের তরফের ১৩ বছরের মেয়ে ও বর্তমান স্বামীর ৭ বছরের ছেলেসহ বোন আম্বিয়াকে নিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার বাজরা তারাকান্দি গ্রামে তার বড় বোনের বাড়িতে বেড়াতে যায়। পরে রাসেল মিয়ার স্ত্রী, ছেলে ও সৎ মেয়েসহ স্ত্রীর বোন আম্বিয়া বাজরা তারাকান্দি গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে কথা বলতে যায়। সন্ধ্যা সারে ৭টার সময় রাসেল মিয়ার ১৩ বছরের সৎ মেয়ে ওই আত্মীয়ের ঘর থেকে বাহির হয়ে পানি আনতে চাপকলের পারে গেলে মেয়েটির আপন বড় খালা তাসলিমার স্বামী সায়েম মিয়া (৩৫) মেয়েটিকে তার খালার নিকট নিয়ে যাবে বলে অসৎ উদ্দেশ্যে পাশেই একটি খালি জায়গায় তারাকান্দি রাস্তার পার্শ্বে নিয়ে যায়। সেখানে আপন বড় খালু সায়েম মিয়াসহ মেজো খালা রিমার স্বামী রাফাত সিদ্দিকী (২৪) ও ছোট খালা শিখার স্বামী মিলন মিয়া (৩০)সহ বাজরা তারাকান্দি গ্রামের লায়েছ মিয়া মেম্বারের ছেলে উজ্জ্বল মিয়া (২৪), মৃত শাহজাহান মিয়ার ছেলে তারাকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরী বায়েজিদ মিয়া (২৮) ও মৃত হিরু মেম্বারের ছেলে হুমায়ুন (৪৫) পূর্ব হতে উৎপেতে থাকে। তারা সংঘবদ্ধভাবে ওই মেয়েকে জোরপূর্বক তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষণের চেষ্টা করে এবং সকলে মিলে ওই মেয়ের পরিহিত জামা কাপড় ছিড়ে এবং খুলে অর্ধ নগ্ন করে ফেলে। মেয়ের ডাক চিৎকারে আশপাশের লোকজনসহ চলন্ত এক সিএনজি থামিয়ে স্বাক্ষীরাসহ মেয়ের মা ঘটনাস্থলে গিয়ে মেয়ের তিন আপন খালুসহ ৬ জনের কবল থেকে অজ্ঞান অবস্থায় মেয়েটিকে উদ্ধার করে কিশোরগঞ্জ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, অভিযোগকারী মো. রাসেল মিয়া ও অভিযোগে উল্লেখিত ১নং স্বাক্ষী অভিযোগকারীর স্ত্রী মোছা. সাথী আক্তার ওরুফে কুলসুম আক্তার এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ও মামলাবাজ হিসেবে পরিচিত।
অভিযোগে উল্লেখিত ২নং স্বাক্ষী রাজিব মিয়ার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবী করেন ঘটনার সময় তিনি সিএনজি যোগে ভৈরব যাচ্ছিলেন। এসময় ভৈরব-কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কের পার্শ্বে মনোহরপুর একটি মুরগীর ফার্মের নিকট অনেক মানুষ দেখতে পান।

কৌতুহলে ড্রাইভার সিএনজিটি থামালে একটি মহিলা বলেন, তার মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তিনি ধর্ষণ করতে বা ধর্ষণের ঘটনাস্থল থেকে কাউকে পালিয়ে যেতে দেখেননি। ৩নং স্বাক্ষী দুলাল মিয়ার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবী করেন তিনি একজন সিএনজির ড্রাইভার। ঘটনার সময় যাত্রী নিয়ে ভৈরব যাচ্ছিলেন। এসময় ভৈরব-কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কের পার্শ্বে মনোহরপুর এলাকায় একটি মুরগীর ফার্মের নিকট অনেক মানুষ দেখতে পান।

কৌতুহলে সিএনজি থামিয়ে ঘটনাস্থলে গেলে একটি মহিলা বলেন, তার মেয়েকে ৩ জন ব্যক্তি ধর্ষণ করেছে। ধর্ষণ করতে বা ধর্ষণের ঘটনাস্থল থেকে কাউকে পালিয়ে যেতে দেখেননি তিনিও। ৫নং স্বাক্ষী আম্বিয়া কুলসুম আক্তার ওরুফে সাথী আক্তারের বোন হয় না দাবী করে বলেন, ঘটনার দিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে অভিযোগকারী রাসেল মিয়ার স্ত্রী সাথী আক্তার আগের তরফের মেয়ে (১৩)সহ রাসেল মিয়ার ছোট ছেলে রিফাত (৭)কে নিয়ে মনোহরপুর গ্রামের নান্নু মিয়ার বাড়িতে যাওয়ার সময় সাথে তাকেও নিয়ে যান। নান্নু মিয়ার বাড়িতে যাওয়ার সাথে সাথে মেয়ে প্রস্রাবের কথা বলে নান্নু মিয়ার বসত ঘরের পিছনে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর তার মা সাথী আক্তার মেয়ের নাম বলে চিৎকার করে ডাকতে থাকে। তার ডাকা ডাকির শব্দে তিনিসহ নান্নু মিয়ার স্ত্রী অভিযোগের ৬নং স্বাক্ষী চন্দনা, নান্নুর ভাই আবুল কাশেম ও মেয়ের মা সাথী আক্তার টর্চ লাইট নিয়ে মেয়েকে খুঁজতে থাকে। এ সময় মেয়েটির কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে পার্শ্ববর্তী ভৈরব-কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কের পার্শ্বে মনোহরপুর নামক স্থানে বাক্কার মিয়ার মুরগীর ফার্মের নিকট রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখে তারা জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? তখন মেয়েটি বলে তার খালু সায়েম তাকে এখানে খারাপ কাজ করতে চেয়েছিলো। এখন দৌঁড়ে চলে গেছে। সাথে সাথে টর্চ লাইট টিপে কাউকে দেখতে পাননি তারা।

অভিযোগের ৬নং স্বাক্ষী চন্দনা ও আবুল কাশেমসহ স্থানীয়রা বলেন, এখানে ধর্ষণের চেষ্টার কোন ঘটনা ঘটেনি। কুলসুম আক্তার ওরুফে সাথী আক্তার ও তার স্বামী একজন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ও মামলাবাজ। তাদের নামে একাধিক মাদক ও মানব পাচারের অভিযোগে মামলা রয়েছে। তারা নান্নু মিয়ার বাড়িতে এসে মেয়েকে দিয়ে মিথ্যা ঘটনা সাজিয়ে তিন বোনের স্বামীসহ এলাকার তিনজন নিরীহ মানুষকে ফাঁসাতে মিথ্যা অভিযোগ করেছে। কারণ জানতে চাইলে তারা বলেন, বাজরা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে মাদক ব্যবসা করার কারণে অভিযোগকারী রাসেল মিয়াসহ তার স্ত্রী সন্তানদের বাজরা বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে বিতারিত করে লায়েছ মিয়া। এছাড়া রাসেল মিয়া ও সাথী আক্তারের সাথে অন্যান্য বিবাদীদের মামলা মোকদ্দমা চলছে। তাই প্রতিপক্ষদের ফাঁসাতে নাবালিকা মেয়েকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ধর্ষণের চেষ্টার এ মিথ্যা অভিযোগ দাখিল করেছে। অভিযোগনামায় উল্লেখিত কতক স্বাক্ষীসহ এলাকাবাসী এ মিথ্যা অভিযোগের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে মেয়ের বড় খালু সায়েম মিয়া মেয়েটিকে তার খালার নিকট নিয়ে যাবে বলে অসৎ উদ্দেশ্যে পাশেই একটি খালি জায়গায় তারাকান্দি রাস্তার পার্শ্বে নিয়ে যায়। আবার উল্লেখ করছে সকল বিবাদী পূর্ব হতে তারাকান্দি রাস্তার পার্শ্বে এক সাথে উৎপেতে ছিলো। সায়েম মেয়টিকে চাপকলের কাছ থেকে আনতে যাওয়া ও রাস্তার পার্শ্বে উৎপেতে বসে থাকা একই সময়ে এক সাথে দুটি জায়গায় অবস্থান করছিলো কি ভাবে এমন প্রশ্ন অনেকেরই?
অভিযোগে রাসেল মিয়া উল্লেখ করেছে ঘটনাস্থলে গিয়ে বিবাদীদের কবল থেকে তার মেয়েকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে।

স্বাক্ষীদের বক্তব্যে জানা যায়, মেয়েটিকে ভৈরব-কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কের পার্শ্বে বাক্কারের মুরগীর ফার্মের এক পার্শ্বে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখতে পায়। এখানে অজ্ঞান হওয়া কিংবা বিবাদীদের কবল থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করার কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। এমনকি বিবাদীদের মধ্যে কাউকে কেউ দেখেছে এমন কোন তথ্যও পাওয়া যায়নি। এছাড়া যে স্থানে মেয়েটিকে ধর্ষণ অথবা ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে উক্ত স্থানের ১০ গজ পূর্ব দিকে ভৈরব-কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক (হাইওয়ে) ব্যস্ততম রাস্তা। এ রাস্তা দিয়ে ১-২ মিনিট পর পর ছোট বড় যানবাহন চলাচল করে। যানবহনের আলোতে এ যায়গা পুরোদমে আলোকিত হয়ে যায়। এখানে এমন কোন ঘটনা ঘটানো আদৌও সম্ভব নয়। এটা বিশ্বাস যোগ্যও না।

এছাড়া অভিযোগ লিপিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে তার স্ত্রী বর্তমানে কিশোরগঞ্জ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। আসলে অভিযোগের বিবরণ থেকে বুঝার কোন উপায় নেই কাকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে মাকে না কি মেয়েকে। আবার দু’জন স্বাক্ষী বলছে ঘটনাস্থলে মেয়েটির মা বলেছে তার মেয়েকে তিনজন মিলে ধর্ষণ করেছে। মেয়ে বলেছে তার আপন খালু সায়েম তাকে রাস্তার উপর খারাপ কাজ করার চেষ্টা করেছে। কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা বুঝার কোন উপায় নেই।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে রাসেল মিয়ার স্ত্রী ছেলে মেয়ে নিয়ে কুলিয়ারচর থানাধীন বাজরা তারাকান্দি সাকিনে তার স্ত্রীর বড় বোনের বাড়িতে বেড়াতে যান। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাজরা তারাকান্দি গ্রামে অভিযোগকারী স্ত্রীর কোন বড় বোনের বাড়ি নেই। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় কুলিয়ারচর উপজেলার মনোহরপুর গ্রামে বাদীর পরিচিত নান্নু মিয়ার স্ত্রী অভিযোগের ৬নং স্বাক্ষী চন্দনার নিকট গিয়ে ছিলো।

অভিযুক্ত উজ্জ্বল মিয়ার পিতা রামদী ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউপি সদস্য মো. লায়েছ মিয়া এবং অভিযুক্ত হুমায়ুন বলেন, এলাকার একটি কুচক্রী মহল এলাকায় তাদের ভাবমূর্তী নষ্ট করে মানসম্মান ক্ষুন্ন করার হীন চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে মাদক সম্রাজ্ঞী কুলসুম ওরুফে সাথী আক্তার ও রাসেল মিয়াসহ একাধিক ব্যক্তিকে দিয়ে একের পর এক অভিযোগ ও মামলা করিয়ে প্রতিনিয়ত তাদের হয়রানি করে আসছে। তারা এর একটি সুষ্ঠু প্রতিকার চেয়ে দুষ্কৃতকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করেন।

এ ব্যাপারে অভিযোগের তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই কাউসার আল মাসুদ বলেন, অভিযোগে উল্লেখিত ঘটনাস্থলে কোন নাবালিকা মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা করেছে বলে স্বাক্ষীরাসহ আশপাশের লোকজন বলতে পারেনি। এমনকি বাজরা তারাকান্দি এলাকায় অভিযোগকারীর স্ত্রীর কোন বোনের বাড়িও নেই বলে জানান তিনি।

এ ব্যাপারে কুলিয়ারচর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, অভিযোগটি নিয়ে সন্দেহ আছে। তদন্ত না করে কিছুই বলা যাচ্ছেনা।

(এসএস/এসপি/ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test