E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কুলিয়ারচরে প্রাচীন পুরাকীর্তির নিদর্শন জমিদার প্রতাপ নাথের বাড়ির জায়গা দখল করে নিচ্ছে স্থানীয়রা

২০২২ ফেব্রুয়ারি ০৬ ১৫:১২:৫১
কুলিয়ারচরে প্রাচীন পুরাকীর্তির নিদর্শন জমিদার প্রতাপ নাথের বাড়ির জায়গা দখল করে নিচ্ছে স্থানীয়রা

সোহেল সাশ্রু, কিশোরগঞ্জ : ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন। এই ঐতিহাসিক নিদর্শনের মধ্যে একটি হচ্ছে জমিদার বাড়ি। যা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। এর সাথে এক-একটা জমিদার বাড়ির আছে এক এক রকম ইতিহাস। 

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের পতনের পর ১৯৪৮ সালের ৩১ মার্চ পূর্ব পাকিস্থানের পার্লামেন্টে প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ নামে বিল পেশ করা হয়। অবশেষে ১৯৫১ সালের ১৬ই মে এই বিল পাশ হয়, যার মাধ্যমে সুদীর্ঘ দেড়শ বছরের কালো জমিদারি প্রথার অবসান ঘটলেও কিছু কিছু গ্রামে তখনও জমিদারী প্রথা চালু ছিল যা ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার বিলোপ করে।

প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এর মাধ্যমে জমিদারি প্রথা বিলোপ করা হয়। সমস্ত জমি রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করে। এর ফলে জমির ওপর কৃষকের অধিকার নিশ্চিত হয়।

১৯৫০ সাল থেকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও ভারত উপমহাদেশে মুঘলদের আমল থেকে ব্রিটিশদের শাসন আমল পর্যন্ত জমিদারি প্রথা চালু ছিল। ওই জমিদারদের বাড়িকেই জমিদার বাড়ি বলা হতো বা হয়। জমিদাররা প্রজাদের উপর তাদের শাসনকার্য চালাতেন এই বাড়ি থেকেই। তাই জমিদারদের এই বাড়িগুলো প্রজাদের কাছে অর্থাৎ সাধারণ মানুষের কাছে জমিদার বাড়ি নামেই পরিচিতি পায়।

তখনকার সময় জমিদাররা ছিলেন অনেক টাকার মালিক। তাই তারা তাদের বাড়িগুলো বানাতেন দালানের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের সুন্দর সুন্দর নকশা ও কারুকার্য করে। প্রাচীন পুরাকীর্তির অন্যতম নিদর্শন জমিদার প্রতাপ নাথের বাড়ি ঘুরে তার কিছুটা নমুনা দেখা যায়। যা কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার ছয়সূতী ইউনিয়নের ছয়সূতি গ্রামে আজও দৃশ্যমান এ জমিদার বাড়িটি।

স্থানীয়দের মতে প্রাচীন পুরাকীর্তির অন্যতম নিদর্শন জমিদার প্রতাপ নাথের বাড়ি আজ ঝঁরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। এই বাড়িটি প্রায় ২শত বছর আগে তৈরি করেছিলেন জমিদার প্রতাপ নাথ। ১শত ২১ শতাংশ ভূমির মধ্যস্থলে প্রতিষ্ঠিত ২শত বছর আগের পুরানো জমিদার বাড়িটি এখন এ অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্যের নিদর্শন। জমিদার প্রতাপ নাথের নিকটাত্মীয়দের সাথে কথা হলে তারা সাংবাদিকদের জানান, জমিদার পরিবারের সর্বশেষ জমিদার ছিলেন প্রতাপ নাথ।

জমিদার বাড়ির পূর্ব দিকে কালী নদী বহমান। যা এখন শুকিয়ে গিয়ে মরা খালে পরিনত হয়েছে। কালী নদীর পশ্চিম পাড় ঘেঁষে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া প্রতাপ নাথের বাজার। প্রতাপ নাথ নিজেই ২শ একর ৫৬ শতাংশ জমির উপর গড়ে তুলেছিলেন এই বাজারটি। বাজারটিতে একসময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রেতা-বিক্রেতারা এসে ভীড় জমাতেন। সে সময় অনেক সুনাম অর্জন করেছিলেন তিনি। তার প্রতিষ্ঠিত বাজারটি আজও এই অঞ্চলের মানুষের কাছে প্রতাপ নাথ বাজার নামে পরিচিত। বাজারটিতে এখন রয়েছে ছোট ছোট চারটি দোকান আর কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশালাকৃতির তিনটি বটগাছ। বাজারের দক্ষিণ পাশে রয়েছে প্রতাপ নাথ বাজার জামে মসজিদ, পূর্বপাশে কালী নদীর পাড় ঘেঁষে পোল্ট্রি মুরগীর ফার্ম, পশ্চিম পাশে মনজুরুল হামিদ শাহ্’র মাজার। বর্তমানে বাজারটি সরকারি ভাবে ২২ হাজার টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, বাজারের বেশ কিছু জমি দিন দিন স্থানীয়রা দখল করে নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয়দের মতে, জমিদার প্রতাপ নাথ হল বধু নাথের পুত্র শিব নাথের ছেলে। প্রতাপ নাথের দাদা বধুনাথ কখন থেকে এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন তা কারোর জানা নেই। তবে শিব নাথের একমাত্র পুত্র ছিলেন জমিদার প্রতাপ নাথ। প্রতাপ নাথের বাড়িটিতে এখন বসবাস করেন প্রতাপ নাথেরই বংশধর গিরিশ নাথের উত্তরসূরী।

সরেজমিনে প্রতাপ নাথের বাড়িতে দাঁড়িয়ে কথা হয় গিরিশ নাথের পুত্রবধূ মৃত নরেন্দ্র নাথের বৃদ্ধা স্ত্রী মঞ্জুশ্রী ও তার পুত্র তাপস চন্দ্র দেবনাথের সাথে, তাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী জমিদার প্রতাপ নাথের জমির পরিমাণ ছিল ৮৪ ধুন। যা ১৬ কানিতে ১ ধুন হিসেব অনুযায়ী ১৩৩৪ কানি। অর্থাৎ ৪৭৪০ শতাংশ। প্রতাপ নাথের সমাধিস্থল কোথায় জানতে চাইলে তারা জানান, জমিদারি প্রথা শেষ হওয়ার পর প্রতাপ নাথ নিঃস্ব হয়ে দেশ ছেড়ে চলে যায় কলকাতায়। পরবর্তীতে তিনি দেশে এসে তার শ্বশুর বাড়ি কিশোরগঞ্জের হাওড়াঞ্চল অষ্টমগ্রামের বাঙ্গালপাড়া গ্রামে পরলোক গমন করেন। বর্তমানে প্রতাপ নাথের উত্তরসূরী হিসেবে তাদের কি পরিমান জমি-জমা আছে জানতে চাইলে তারা জানান, শুধু এক একর ২১ শতাংশ বাড়ি আছে। অর্থাৎ মোট ১২১ শতাংশ ভূমি।

জমিদার প্রতাপ নাথের কয়টি ভবন ছিল তাও তারা জানেনা। তবে যে ভবনটি এখন দাঁড়িয়ে আছে এর প্লাস্টার খসে পড়েছে, দরজা-জানালা ভেঙে গেছে, কিছু জায়গায় ছাদও ধসে পড়েছে, ছাদের ওপর গাছের জন্ম হয়ে শিকড় ছাদ ও দেওয়াল বেয়ে নিচের দিকে আসছে। ভবনের ভিতরে দেখা গেছে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ। ভবনের দরজা জানালাও খুলে নিয়ে গেছে।

স্থানীয়রা এই অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে জমিদার প্রতাপ নাথের বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসক ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। একই সাথে প্রতাপ নাথ বাজারটি রক্ষার দাবিও করেন তারা। বাজারটির সঙ্গে জমিদার প্রতাপ নাথের ইতিহাস লুকায়িত। বাজারটি সংরক্ষণ করাও খুব জরুরি। তা না হলে অচিরেই শেষ হয়ে যাবে জমিদার প্রতাপ নাথের স্মৃতিবিজড়িত ভবন ও প্রতাপ নাথ বাজার। স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাবে বিশালাকৃতির বাজারের জায়গা-জমি।

(এসএস/এসপি/ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test