E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

চোরের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ এলাকাবাসী, প্রশাসন নীরব

ভৈরবে ভাঙ্গারী ব্যবসার আড়ালে চোর পালন!

২০২২ ফেব্রুয়ারি ১৬ ১৭:৫১:৩৩
ভৈরবে ভাঙ্গারী ব্যবসার আড়ালে চোর পালন!

কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি : ভৈরবে ভাঙ্গারী ব্যবসাকে কেন্দ্র করে চলছে চোরাই মালের জমজমাট বাণিজ্য। এমনটাই অভিযোগ এলাকাবাসীর। এসব ব্যবসার উপর নজরদারি নেই প্রশাসনের কর্মকর্তাদের।

এসব ভাঙ্গারী ব্যবসার পালিত চোরেরা রাতের আঁধারে গ্যাসের রাইজার, বাসা বাড়ির বৈদ্যুতিক সার্ভিস লাইনের তার, বাড়ির পানির কল/টিউবওয়েল, টিউবওয়ের মাথা-হাতল, বাড়ির আওতার টিন, বাড়ি নির্মাণ সামগ্রী ও বাড়ির সামনে থাকা পরিত্যক্ত আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।

সন্ধ্যার পর থেকেই ভাঙ্গারির দোকানগুলোতে গভীর রাত পর্যন্ত এইসব চোরাই মাল কেটে টুকরা টুকরা করে অন্যসব সরঞ্জামের সাতে মিশিয়ে রাখা হয়। ফলে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ চোরাই মালামাল বিক্রি হচ্ছে ভৈরবের ভাঙ্গারী দোকানগুলোতে।

জানা যায়, ভৈরব পৌর শহরের আনাচে কানাচে, ওলি-গলিতে গড়ে উঠেছে শতাধিক ভাঙ্গারী মালামাল কেনা-বেচার দোকান। এইসব ভাঙ্গারী দোকানিদের সহযোগিতা ও দাদনের টাকা নিয়ে এলাকা ভিত্তিক গড়ে উঠেছে একাধিক ছোট-বড় চোরের দল।

এই চোরের দলগুলো বিভিন্ন এলাকা থেকে লোহার যন্ত্রাংশ, বৈদ্যুতিক মোটর, তার, দরজা-জানলার গ্রীল, টিউবওয়েল, টিনসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ চুরি করে দোকানিদের কাছে স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে।

এছাড়া বাড়ি-ঘর ও বিভিন্ন কারখানা সংস্কার কাজের জন্য রাখা রড, তারসহ লোহা দ্রব্যাদি ও চুরি হয়ে যাওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে।

১৪ ফেব্রুয়ারি মো. সামসুল আলম এর কমলপুর এলাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ৪৪০ ভোল্টের সার্ভিস লাইনের তার কেটে নেয় চোরেরা। এছাড়া ওই ব্যক্তির গত ৪ ফেব্রুয়ারি একই জায়গা থেকে আগেও সার্ভিস লাইনের তার চুরি হয়ে যায়।
পৌর শহরের ভৈরবপুর উত্তর পাড়া কলেজ রোড এলাকার ফারহানা বেগম লিপির বাড়ির গ্যাসের লাইজার গত ১৩ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে চুরি হয়। ওইদিন ওই এলাকার আরো ৫টি রাইজার চুরি হওয়ার ঘটনা ঘটে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এর আগেও আমার বাসার জানালা খুলে মোবাইল চুরি হয়ে যায়।

এছাড়া গত ডিসেম্বর মাসে আমার বাড়ির ২ রুমের যত লোহার জিনিষপত্র, সোফার কোষণ, বৈদ্যুতিক লাইট, ফ্যান, রান্না ঘরের চালার টিন খুলে নেয়াসহ বেশ কিছু জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যায়। এতে আমার লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়ে যায়। ৮ ফেব্রুয়ারি ভৈরবপুর উত্তর পাড়ার মোহাম্মদ আলীর বাড়ির সার্ভিস লাইনের তার চোরেরা কেটে নিয়ে যায়। এদিকে গত জানুয়ারি মাসে উপজেলার শিবপুর এলাকা থেকে বিভিন্ন বাড়ির টিউবওয়েলের মাথা ও হাতল চুরির ঘটনা ঘটে।

ভৈরবপুর দক্ষিণ পাড়া এলাকার আরাফাত ভূঁইয়ার ফ্যাক্টরির প্রায় লক্ষাধিক টাকার সার্ভিস লাইনের তার গত ২২ জানুয়ারি চুরি করে চোরেরা নিয়ে যায়।

এছাড়া ভুক্তভোগী আরাফাত ভূঁইয়া বলেন, আমার ফ্যাক্টরির সার্ভিস লাইনের তার দুইবার চুরি হয়েছে। এতে প্রায় আমার দেড় লাখ টাকার মত ক্ষতি হয়ে যায়। আমি থানায় জিডিও করেছি। কিন্তু এখনো কোনো চোর ধরার ক্ষেত্রে প্রশাসনের তেমন কোনো ভূমিকা দেখি নাই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভাঙ্গারী ব্যবসায়ী বলেন, চুরির মাল ছাড়া প্রকৃত ভাঙ্গারী ব্যবসা করা খুবই কঠিন। আর সকলকেই ম্যানেজ করেই চলে এই ভাঙ্গারী ব্যবসা। তিনি আরও জানান, একেকজন ভাঙ্গারী ব্যবসায়ীর অধীনে ৫-৬ জন ফেরি ব্যবসায়ী থাকেন এবং বেশ কিছু চোরও দাদন দিয়ে লালন পালন করে থাকেন। তারা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কিছু নিত্যপণ্যের বিনিময়ে ব্যবহার অনুপযোগী কিংবা পরিত্যক্ত জিনিষপত্র সংগ্রহ করে আমাদের কাছে বিক্রি করে থাকেন।

এই বিষয়ে হাজী আসমত সরকারি কলেজের অধ্যাপক মোতাহার হোসেন বলেন, কিছু মাদকসেবী বাড়ি থেকে যখন নেশার টাকা যোগাড় করতে পারে না, তখন বিভিন্ন জায়গায় চুরি করে। আর চুরি করা মালামাল ভাঙ্গারী ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়।

নিরাপদ সড়ক চাই ভৈরব শাখার সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটি কার্যকরী সদস্য সাংবাদিক আলাল উদ্দিন বলেন, ভৈরবে অনেক ভাঙ্গারীর দোকান গড়ে উঠেছে। আর এইসব ভাঙ্গারীর দোকানের মালিকদের সাথে অসংখ্য চোরের সখ্যতা রয়েছে। কারণ চোরাই মাল কম দামে কিনতে পারে বলে ভাঙ্গারী ব্যবসায়ীদের একটি লাভের অংশই আসে এইসব চোরাই মাল থেকে। তাই তারা চোরা কারবারীদের সাথে সম্পর্ক রাখে।

ভৈরব পৌরসভার লাইসেন্স ইন্সপেক্টর মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, আমাদের নিয়ম অনুযায়ী ভাঙ্গারীর দোকানের নামে কোনো ট্রেড লাইসেন্স দেয়া হয় না। আমরা পুরাতন মালামাল ক্রয় বিক্রয়ের লাইসেন্স দেয়। আর যে পরিমাণ লাইসেন্স দেয়া আছে তা স্বল্প পরিমাণে দেয়া আছে।

এ বিষয়ে দৈনিক পূর্বকণ্ঠ সম্পাদক সোহেল সাশ্রু বলেন, ভৈরব থানার এক ওসি এক সময় ভাঙ্গারী ব্যবসাটি একই বারে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তখন এসব চোর নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখন আবার ভাঙ্গারী ব্যবসা রমরমা হয়ে উঠেছে। শুধুমাত্র হাজী আসমত কলেজের উত্তর পাশ থেকে রফিকুল ইসলাম মহিলা কলেজের পশ্চিম পাশ পর্যন্ত ৫শ গজের মধ্যে অন্তত পক্ষে ১০টি ভাঙ্গারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিভাবে সম্ভব এতোগুলো ভাঙ্গারী প্রতিষ্ঠান চলা? এতো অল্প জায়গাতে এই শহরের এসব ভাঙ্গারী আসে কোথা থেকে?

তিনি আরো বলেন, কুলিয়ারচর, বাজিতপুর এলাকার মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও স্যালু মেশিন, চুরি হলে উদ্ধার করা হয় ভৈরব থেকে। এমনও নজির রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা এদের কোন সাজা হয় না। যাদের প্রভাব আছে তারা এসব ভাঙ্গারীর দোকান থেকে প্রভাব খাটিয়ে চোরাই মাল উদ্ধার করতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষ নিরুপায় হয়ে তাকিয়েই দেখেন কিছুই করার নেই তাদের।

এই বিষয়ে ভৈরব থানার অফিসার ইনচার্জ মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, যাদের বাড়িতে চুরি হয়েছে তারা যদি থানায় অভিযোগ করে তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিব। এছাড়া চুরির মালামাল একশ্রেণির ভাঙ্গারীর দোকানদার গোপনে ক্রয়-বিক্রয় করছে তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভাঙ্গারী দোকানগুলো নজর দারিতে আছে যে কোনো সময় এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।

এ দিকে সাধারণ মানুষ মনে করেন, প্রতিনিয়ত এই উপজেলায় ক্রমাগত বেড়ে চলেছে ভাঙ্গারী ব্যবসা। যার কারণে বাড়ছে চুরির সংখ্যা। তাই এসব দোকানে প্রশাসনের দ্রুত নজরদারী আনা উচিত বলে মনে করেন তারা।

(এসএস/এসপি/ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test