E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

রাজবাড়ীর রাজার বেড়ে উঠার গল্প

২০২২ মার্চ ৩১ ১৭:৫৯:৪৩
রাজবাড়ীর রাজার বেড়ে উঠার গল্প

উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ ডেস্ক : রাজবাড়ী জেলা নিজের ক্যাডার বাহিনী দিয়ে আয়ত্তে রাখায় জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী ইরাদত আলী এখন রাজবাড়ীর রাজা। জেলার প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানেই তার ছবি ও নামই ব্যানার ও ফেস্টুন লক্ষ করা যায়, অন্য কারো ব্যানার ও ফেস্টুন লাগানো হলেও তা রাতারাতি উধাও হয়ে যায়।

রাজবাড়ীর সর্বত্র পরিচিত ‘মাইজা ভাই’ নামে তিনি। গোটা রাজ্যেই চলছে তার খবরদারি। নয় ভাইবোনের মধ্যে ইরাদত দুই নম্বর। বড় ভাই কাজী কেরামত আলী রাজবাড়ী-১ আসনের এমপি। বড় ভাইয়ের হাত ধরেই রাজনীতিতে আসেন ইরাদত। এখন ইরাদতের রাজনীতির কাছেই কোণঠাসা বর্তমান এমপি কেরামত। ২০১৮’র নির্বাচনের মাস ছয়েক আগে মূলত ইরাদত আলীর উত্থান। তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে থাকা কাজী কেরামত আলীকে এক প্রকার জোর করেই তার পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করান ইরাদত। ওই সময় ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে পদত্যাগ করার কথা লিখে দেন কেরামত। মূলত সংসদ সদস্য পদে দলীয় মনোনয়ন চাওয়ার হুমকি দিয়ে ইরাদত আলী ভাইয়ের ওপর চাপ তৈরি করেছিলেন। ইরাদত তখন জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

দলীয় মনোনয়নে ছোট ভাই যাতে বাগড়া দিতে না পারেন, সে জন্য নিজের পদ লিখে দেন কেরামত আলী। এমনকি কেরামত আলীকে শহরের স্বজ্জনকান্দা এলাকায় নিজেদের পৈতৃক বাড়ি থেকেও বের করে দেয়ার কথা চাউর রয়েছে ইরাদতের বিরুদ্ধে। যদিও বিষয়টি নিয়ে কেউই মুখ খুলছেন না। শুরু থেকে সবাই এক বাড়িতে থাকলেও বর্তমানে পৈতৃক বাড়ি থেকে কিছু দূরে নুরু কন্ট্রাক্টরের বাড়িতে ভাড়া থাকেন কেরামত আলী। তিনি এই আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য। কেরামত পদত্যাগ করার পর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ইরাদত। মূলত এ সময় থেকে সবকিছুতেই বাগড়া দেয়া শুরু করেন তিনি। পরে ২০২১ সালের অক্টোবরে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয় ইরাদতকে। বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও ইরাদত আলী জেলা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি, জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি, জেলা সার ডিলার মালিক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া দায়িত্বে রয়েছেন অনেক সংগঠন ও সমিতির। বলতে গেলে পুরো জেলাই ইরাদতের নিয়ন্ত্রণে। নানা অপকর্ম, জোর জবরদস্তি করে নিজের কব্জায় নিয়েছেন অন্যের বাড়ি, দোকান ও জমি। ইরাদতের ইশারা ছাড়া রাজবাড়ীতে কিছুই নড়ে না। তার দাপটে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও এখন কোণঠাসা। কেউ কেউ অপমানে, অভিমানে রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। আর যারা আছেন তারা দুই ভাগে বিভক্ত। বিভিন্ন টেন্ডার বাণিজ্য, চাকরি বাণিজ্য, বালুমহাল, রেজিস্ট্রি অফিস, পাটুরিয়া ঘাট, বিভিন্ন ধরনের সেটেলমেন্ট, এমনকি মসজিদ কমিটিতেও রয়েছে ইরাদতের নিয়ন্ত্রণ। এসবের মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ।

এসব বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে কথা বলার সময় ইরাদতের নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা ভয়ে কথা বলতে চাননি। যারা কথা বলেন- তারাও নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেন।

অভিযোগ রয়েছে, শুরুতে বাসের মালিক না হয়েও বাস মালিক সমিতির সভাপতি হয়েছেন ইরাদত আলী। সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের ধাওয়াপাড়া ঘাট এলাকায় ফসলি জমির ইজারা ছাড়াই হাজার বিঘা জমির মাটি কেটে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে ইরাদতের লোকজনের বিরুদ্ধে। মাটি কেটে নেয়া জমিগুলোতে বেশির ভাগ অংশেই বাদামের চাষ করেছিলেন স্থানীয়রা। আর মাটি লোড করা প্রতি ট্রাক থেকে ১৪০০ টাকা করে নেয় ইরাদত বাহিনী। ওই এলাকায় মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার গাড়ি মাটি বহন করে নিয়ে যায়। এই ঘাটে বালু নিতে আসা প্রতিটি ১০ চাকার ট্রাক থেকে এক হাজার আর ৬ চাকার ট্রাক থেকে ৬০০ টাকা চাঁদা নেয় ইরাদতের লোকজন। আর ট্রলি থেকে নেয়া হয় তিনশ’ টাকা। বালু নেয়ার জন্য প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার ট্রাক ঘাটে আসে বলে জানা গেছে। এসবের জন্য কোনো ইজারা নেয়া হয় না। রাস্তায় চেকপোস্ট বসিয়ে চাঁদা আদায় করে ইরাদতের বাহিনী। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তাদের কোনো বাধা দেয়া হয় না। এখান থেকে বালু তুলে খুলনা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুরে নেয়া হয়। এই ঘাটের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বালি উত্তোলন করে রাখা হয়। দূর থেকে দেখলে এটাকে ছোট পাহাড়ের মতো মনে হয়। এ ছাড়া বালুমহাল থেকে প্রতি ঘনফুট বালু থেকে ৩ টাকা ইরাদতের সিন্ডিকেট পায়। ইরাদতের পক্ষে বালুঘাট নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসায়ী দীপক কুণ্ড। তার নামে বালুঘাটের ডাক হয়। মূলত দীপক কুণ্ডই ইরাদতকে বালু ব্যবসায়ে উদ্বুদ্ধ করেন। বালু তোলার কারণে সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ১০ হাজার হেক্টর এলাকা বিলীন হয়ে গেছে। এখানে বাংলা ড্রেজার দিয়ে মাটি উত্তোলন করা হয়। বালু তোলার কারণে ওই সকল এলাকাবাসীর দুর্ভোগের শেষ সেই। তবে ইরাদতের লোকজনের বিরুদ্ধে কেউই মুখ খোলে না। গত বছরের শেষের দিকে এলাকাবাসী অবৈধ বালু উত্তোলনের প্রতিবাদ করায় তাদের মারধর করে ইরাদতের ছোট ভাই কাজী টিটু। এ সময় বেশ কয়েকজন গ্রামবাসী আহত হয়েছেন। পরে ওই এলাকার প্রায় পাঁচ শতাধিক গ্রামবাসী এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রধানমন্ত্রী, পানিসম্পদ মন্ত্রী, বিআইডব্লিউটিএ’র বরাবর আবেদন করেন। যদিও এখন পর্যন্ত এর কোনো সুরাহা হয়নি। উল্টো বিভিন্ন সময় ইরাদতের লোকজনের হামলার শিকার হন ভুক্তভোগীরা।

স্থানীয় লোকজন জানান, রাজবাড়ীর মানুষ সব সময় ইরাদত বাহিনীর আতঙ্কে রয়েছে। কোনো কিছু হলেই তার লোকজন এসে হাজির হয়। সব কিছু তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। এদের বাইরে কেউ কথা বললেই বিভিন্নভাবে হুমকি ধামকি, মারধর এমনকি মামলাও দেয়া হয়।

ইরাদতের সকল লেনদেনের দেখাশোনা করেন শরিফুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ী। ইরাদতের আরেক ঘনিষ্ঠজন হচ্ছেন আলমগীর শেখ তিতু। যিনি রাজবাড়ী পৌরসভার বর্তমান মেয়র। ইরাদতের অবর্তমানে রাজবাড়ী পৌর এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন তিতু।এছাড়াও রাজবাড়ী-২ আসনের সংসদ সদস্যর বড় ছেলে অস্ত্রধারী ক্যাডার জনি এখন যুক্ত হয়েছে। এই জনিই পাংশার সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদ হত্যা চেষ্টা মামলার অন্যতম আসামি।

এদিকে রাজবাড়ীতে দুটি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকেও মাসিক চাঁদা নেয় ইরাদতের লোকজন। সেখানে তার বলয়ের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। রেজিস্ট্রি অফিসে যে কেউ চাইলেই কোনো দলিল রেজিস্ট্রি করতে পারেন না। ওই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দলিল রেজিস্ট্রি করতে হয়। এখানে প্রতি দলিলে শতকরা ৭ টাকা কমিশন দিতে হয় ইরাদতের সিন্ডিকেটকে। এর মধ্যে স্থানীয় নেতারা পায় শতকরা ৩ টাকা আর বাকি ৪ টাকা নেয় ইরাদত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্কুলশিক্ষক বলেন, আমি কিছুদিন আগে বাড়ির পাশে একটি জায়গা কিনেছি। এটার দলিল করতে গেলে অফিসের কেউই রেজিস্ট্রি করতে রাজি হয়নি। জানতে পারলাম এক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জমি রেজিস্ট্রি করতে হবে। পরে বাধ্য হয়ে তাদের মাধ্যমে কাজটা করলাম। এই জমি রেজিস্ট্রি করতে নির্ধারিত সরকারি খরচ ৩০ হাজার টাকা লাগলেও আমার গুনতে হয়েছে ৬০ হাজার টাকা।

এ ছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দপ্তরি নিয়োগ, এমনকি পুলিশে নিয়োগ দেয়ার জন্যও রয়েছে ইরাদতের আলাদা সিন্ডিকেট। চাকরি বাণিজ্য হচ্ছে তার আরেক ব্যবসা। চাকরি দেয়ার নাম করে অনেক মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যেই অনেকেই চাকরি পায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, আমি প্রাইমারি স্কুলের চাকরির জন্য ইরাদত ভাইয়ের কাছের এক লোকের কাছে ৫ লাখ টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চাকরির কোনো খবর না পেয়ে তার কাছে গেলে তিনি নানা রকম টালবাহানা করেন। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে থ্রেট দেন। বিষয়টি আমি ‘মাইজা ভাই’কে জানালে প্রথমে তিনি বিষয়টি দেখবেন বলে জানান। পরের বার তার কাছে গেলে তিনি বিভিন্নভাবে ধমকাধমকি করেন। এক পর্যায়ে আমি এই টাকার আশা ছেড়ে দেই।

ইরাদতের আরেক হাতিয়ার জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রাজীব। তিনি এখন ঠিকাদারি ব্যবসা করেন। রাজীব মূলত পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করেন। কেউ টেন্ডার ড্রপ করতে চাইলে আগে থেকেই তাকে বিভিন্ন হুমকি ধামকি দেয়া হয়। এ ছাড়া কেউ কাজ পেতে হলে তাকে ১০ পারসেন্ট দিতে হয়। এর থেকে মোটা অঙ্কের ভাগ পায় ইরাদত। কয়েক বছর আগে পানি উন্নয়ন বোর্ডের টেন্ডার নিয়ে গোলাম মোস্তফা নামে একজনের সঙ্গে ঝামেলা হয় ইরাদতের লোকজনের। পরে গোলাম মোস্তফাকে নারী নির্যাতনের মামলা দিয়ে জেলে পাঠানোর অভিযোগও রয়েছে ইরাদতের বিরুদ্ধে। যদিও পরে ওই মামলা থেকে খালাস পান গোলাম মোস্তফা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শহর আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, আমার তিনটি ঠিকাদারি লাইসেন্স ছিল। সবগুলোই বাতিল করেছি। নিজের দল ক্ষমতায় থাকতে কাউকে এক টাকা চাঁদা দিয়ে আমি ঠিকাদারি করবো না। বিরোধী দল যখন ছিল তখনই তো আমি কাউকে চাঁদা দেইনি। এখানে ইরাদতই সব। সে যা চায়, তাই হয়। দলের দুঃসময়ে আওয়ামী লীগ করেছি, এখন অবসরে আছি। আওয়ামী লীগের দুঃসময় হলে আমি এবং জেলার যারা দলের জন্য নিবেদিত তারা আবার সক্রিয় হয়ে কাজ করবো। টেন্ডারবাজি ও নানা অপকর্ম করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট যারা করেছে এদের আইনের মাধ্যমে কঠোর বিচার হওয়া দরকার।

রাজবাড়ী শহরের মোনেদা টাওয়ার, সোনালী ব্যাংক ভবন, খলিফাপট্টি ভবন, অগ্রণী ব্যাংক ভবনের মালিক ইরাদতের পরিবার। তবে এসব তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, কয়েক বছর আগেও এসব জায়গায় তেমন কিছুই ছিল না। এখন রয়েছে বড় বড় ভবন। ভবন বড় করার জন্য অনেকের জমি দখল করারও অভিযোগ রয়েছে ইরাদতের বিরুদ্ধে।

এ ছাড়া এলাকায় যেকোনো বিষয়ই ইরাদতের লোকজন ছাড়া মীমাংসা করা যায় না। মীমাংসা করতে গেলেও তাদের চাঁদা দিতে হয়। এদিকে পাটুরিয়া ফেরিঘাট থেকেও বিপুল অঙ্কের চাঁদা পেয়ে থাকেন ইরাদত। গোয়ালন্দের সাবেক পৌর মেয়র নুরু মণ্ডলও ছিলেন তারই লোক।

এদিকে নিজের লোক না হলে দলীয় পদ-পদবিতে বাগড়া দেন ইরাদত। মূলত কেরামত আলী জেলা আওয়ামী লীগের পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার পর পাল্টে যায় রাজবাড়ীর রাজনীতি। জেলার মূল রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ইরাদত আলীর নিয়ন্ত্রণে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা জানান, পদ পাওয়ার পর ইরাদত আলীর চেহারা পাল্টে যায়। কোনো নির্বাচনে নিজের লোকের বাইরে কেউ দলীয় মনোনয়ন পেলে তার বিপক্ষে প্রার্থী দাঁড় করান ইরাদত। একবার কালুখালী উপজেলা চেয়ারম্যান পদে দলের মনোনয়ন পেয়েছিলেন তৎকালীন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী সাইফুল ইসলাম। কিন্তু তাকে সমর্থন না করে ইরাদত বিরোধিতা করেন। ভোটে দাঁড় করান আলীউজ্জামান চৌধুরী ওরফে টিটুকে। শৃঙ্খলাবিরোধী এই কাজের জন্য দল থেকে বহিষ্কৃত হন আলীউজ্জামান। এ ছাড়া বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন আবুল কালাম আজাদ। এখানে সাধন হাকিম নামের এক আওয়ামী লীগ নেতাকে প্রার্থী করেন ইরাদত। যদিও পরে দল থেকে বহিষ্কার হন সাধন হাকিম। এদিকে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে দেয়া অথবা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জিতিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আর্থিক সুবিধা নেয়ার অভিযোগও রয়েছে ইরাদতের বিরুদ্ধে।

এ ছাড়া এলাকায় যেকোনো বিষয়ই ইরাদতের লোকজন ছাড়া মীমাংসা করা যায় না। মীমাংসা করতে গেলেও তাদের চাঁদা দিতে হয়। এদিকে পাটুরিয়া ফেরিঘাট থেকেও বিপুল অঙ্কের চাঁদা পেয়ে থাকেন ইরাদত। গোয়ালন্দের সাবেক পৌর মেয়র নুরু মণ্ডলও ছিলেন তারই লোক।

এদিকে নিজের লোক না হলে দলীয় পদ-পদবিতে বাগড়া দেন ইরাদত। মূলত কেরামত আলী জেলা আওয়ামী লীগের পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার পর পাল্টে যায় রাজবাড়ীর রাজনীতি। জেলার মূল রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ইরাদত আলীর নিয়ন্ত্রণে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা জানান, পদ পাওয়ার পর ইরাদত আলীর চেহারা পাল্টে যায়। কোনো নির্বাচনে নিজের লোকের বাইরে কেউ দলীয় মনোনয়ন পেলে তার বিপক্ষে প্রার্থী দাঁড় করান ইরাদত। একবার কালুখালী উপজেলা চেয়ারম্যান পদে দলের মনোনয়ন পেয়েছিলেন তৎকালীন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী সাইফুল ইসলাম। কিন্তু তাকে সমর্থন না করে ইরাদত বিরোধিতা করেন। ভোটে দাঁড় করান আলীউজ্জামান চৌধুরী ওরফে টিটুকে। শৃঙ্খলাবিরোধী এই কাজের জন্য দল থেকে বহিষ্কৃত হন আলীউজ্জামান। এ ছাড়া বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন আবুল কালাম আজাদ। এখানে সাধন হাকিম নামের এক আওয়ামী লীগ নেতাকে প্রার্থী করেন ইরাদত। যদিও পরে দল থেকে বহিষ্কার হন সাধন হাকিম। এদিকে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে দেয়া অথবা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জিতিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আর্থিক সুবিধা নেয়ার অভিযোগও রয়েছে ইরাদতের বিরুদ্ধে।

নৌকা প্রতীক পেয়েও দলীয় নেতাদের বিরোধিতায় পরাজয়ের শিকার প্রার্থীরা বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় কমিটিকে অবহিত করেছেন। দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর চিঠি লিখেছেন কেউ কেউ। এ ছাড়া নির্যাতনের শিকার ও বিনা কারণে পদ থেকে বিতাড়িত নেতারাও কষ্টের কথা কেন্দ্রকে লিখে জানিয়েছেন। তবে কেউই প্রতিকার পাননি বলে জানিয়েছেন।

রাজবাড়ী সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক এক নেতা বলেন, দলের সাধারণ সম্পাদকের পদটি বাগিয়ে নেয়ার পর থেকেই বেপরোয়া ইরাদত আলী। এরপর দলের নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীদের বিতাড়িত করতে থাকেন। জেলা আওয়ামী লীগের বিগত কমিটি গঠনের পর জেলার সর্বস্তরে ‘পকেট কমিটি’ করেছেন তিনি। ইরাদত রাজবাড়ী আওয়ামী লীগকে নিজের পারিবারিক সম্পদে পরিণত করেছেন।

এদিকে রাজবাড়ীতে কোনো দলীয় বা সামাজিক ব্যানার- ফেস্টুনেও ইরাদতের ছবি রাখা বাধ্যতামূলক। ইরাদতের ছবি না থাকলে কেউই ব্যান্যার ও ফেস্টুন লাগাতে পারেন না। জেলা আওয়ামী লীগের আরেক গ্রুপের এক নেতা বলেন, দলের এক বর্ধিত সভাকে কেন্দ্র করে পুরো শহরে ব্যানার ও ফেস্টুন টানায় ইরাদত আলী ও তার লোকজন। কিন্তু আমাদেরগুলো লাগাতে গিয়ে দেখি সারা রাস্তায় ইরাদতের পোস্টার। তারপর আমাদের লোকজন রাতে যখন ফেস্টুন টানাতে গেছে, তখন ইরাদতের লোকেরা গিয়ে বলে যেখানে দড়ি টানানো আছে সেখানে তোমরা ফেস্টুন লাগাতে পারবা না। পরে ইরাদতের লোকজন চলে গেলে আমাদের কিছু পোস্টার লাগাই। কিন্তু পরদিন সকালে গিয়ে দেখি আমাদের সব পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে।

চিকিৎসার জন্য কাজী ইরাদত আলী ভারতে অবস্থান করায় অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
ইরাদতের এসব একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগও করেছেন বড় ভাই কাজী কেরামত আলী। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ইরাদত আলী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদটি লিখে নেয়ার পর থেকে জেলায় দলীয় শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও রাজবাড়ী-২ আসনের এমপি জিল্লুল হাকিমের দিকনির্দেশনায় যাকে তাকে দলের পদ ও মনোনয়ন দেয়া, বিরোধিতাকারীদের শারীরিক নির্যাতন এবং দল থেকে বহিষ্কার করে তারা একক অবস্থান সৃষ্টি করেছেন।

সংবাদ সম্মেলনে কাজী কেরামত আলী বলেন, আমি ৪ বার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আগে আমার ছোট ভাই কাজী ইরাদত আলীকে লিখিতভাবে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব তুলে দেই। পরবর্তীতে তার কর্মকাণ্ড আমাকে কষ্ট দিয়েছে, ব্যথিত করেছে। আমি সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন দল পরিচালনায় সব কিছু শেয়ার করতাম। কাজ করতে গেলে ভালো-মন্দ আলোচনা করতাম। কিন্তু সে দায়িত্ব পাওয়ার পর দলের মধ্যে এবং নেতাকর্মীদের মধ্যে ডিভিশন তৈরি করেছে। সে জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিটি নেতাকর্মীদের থ্রেট করে এমপি’র সঙ্গে রাজনীতি করা যাবে না, সে আওয়ামী লীগকে ব্যক্তিগত দল বানাতে চলেছে। গোয়ালন্দ থানা কমিটি করা হয়েছে। নতুন এই কমিটিতে পূর্বের কমিটির প্রায় ৩৫ জনকে বাদ দেয়া হয়েছে। এরা বাদ পড়ার একটাই কারণ আমাকে তারা ভালোবাসে। এর নাম তো রাজনীতি না।

সৌজন্য: মানবজমিন।

(একে/এএস/মার্চ ৩১, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

১৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test