E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শেরপুরের নাকুগাঁও স্থলবন্দরে ৩০ লাখ টাকার শুল্ক জালিয়াতি

২০১৪ এপ্রিল ২৬ ১৫:০৬:৩৬
শেরপুরের নাকুগাঁও স্থলবন্দরে ৩০ লাখ টাকার শুল্ক জালিয়াতি

শেরপুর প্রতিনিধি : শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার নাকুগাঁও শুল্ক ও স্থলবন্দরে ভারতীয় কয়লা আমদানির ১৬টি এলসি’র বিপরীতে প্রায় ৩০ লাখ টাকার শুল্ক জালিয়াতির ঘটনা ফাঁস হয়ে গেছে। ঘটনাটি ধামাপাচা দিতে বন্দরের সংশ্লিষ্ট সিএন্ডএফ এজেন্ট, আমদানী-রপ্তানীকারক ও কর্মকর্তারা দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন।

এদিকে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বেড়িয়ে আসতে শুরু করেছে গর্তের সাপ। বিগত কয়েক বছরের শুল্ক তল্লাসি চালালে এরকম বহু জালিয়াতির প্রমাণ মিলবে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন।

নাকুগাঁও স্থলবন্দর শুল্ক কর্মকর্তার কার্যালয় ও সংশ্লিষ্ট আমদানী-রপ্তানীকারক সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি এলসি অনুযায়ী নাকুগাঁও শুল্ক স্টেশনের শুল্ক ও সোনালী ব্যাংক নালিতাবাড়ী শাখায় ওইসব এলসির বিপরীতে সরকারের খাতে জমা হওয়া শুল্কের মধ্যে ব্যবধান ধরা পড়লে থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসে। গত ২০ এপ্রিল প্রথমে ৮টি শুল্ক জালিয়াতির তথ্য নিশ্চিত হলেও পরদিন ২১ এপ্রিল আরও ৮টি শুল্ক জালিয়াতির তথ্য মেলে এবং পর্যায়ক্রমে এরকম আরও তথ্য বেড়িয়ে আসতে শুরু করেছে। আর এ অবস্থায় নিজেদের শুল্ক জালিয়াতির আতঙ্কে রয়েছেন অন্ধ আত্মবিশ্বাসে সংশ্লিষ্ট সিএন্ডএফ এজেন্টের কর্মচারীর মাধ্যমে শুল্ক জমা দেওয়া অন্য ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টরা জানান, সিএন্ডএফ এজেন্ট ‘এসএ কর্পোরেশন’ এসব শুল্ক জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত।

বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, নিয়মানুযায়ী ১০০ টন কয়লা আমদানীর জন্য এলসি প্রতি এলসি প্রতি সর্বমোট শুল্ক দাঁড়ায় ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭২৫ টাকা। যার মধ্যে রয়েছে সিডি শতকরা ৫ ভাগ, ভ্যাট ১৫ ভাগ, এআইটি ৫ ভাগ, এটিভি ৪ ভাগ, আইটি ৯০ টাকা ও সিএন্ডএফ এজেন্ট ফি ২৭০ টাকা। বন্দরের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট সিএন্ডএফ (ক্লিয়ারিং এন্ড ফরওয়ার্ডিং) এজেন্ট এর মাধ্যমে শুল্ক জমাদান সাপেক্ষে পণ্য আমদানি করতে হয়। পণ্য আমদানি করতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা সরকারের ঘরে টাকা পরিশোধের নিমিত্তে সিএন্ডএফ এজেন্ট এসএ কর্পোরেশনের কর্মচারী শামসুর রহমান লিটনের কাছে টাকা জমা দেন। কিন্তু ব্যবসায়ীরা টাকা জমা দিলেও শুল্ক স্টেশনের কতিপয় কর্মচারীর সঙ্গে যোগসাজশে সোনালী ব্যাংক নালিতাবাড়ী শাখার সীল-স্বাক্ষর জাল করে এসএ কর্পোরেশনের কর্মচারী লিটন একের পর এক ব্যাংকের ভুয়া চালানপত্র তৈরি করে তা শুল্ক স্টেশনে জমা দিয়েছে। এ ধরনের ১৬ টি এলসির বিপরীতে ২৯ লাখ ৮৭ হাজার ৬শ টাকার শুল্ক জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। সম্প্রতি এ তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে শামসুর রহমান লিটন আত্মাহুতির চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে সপরিবারে আত্মগোপন করে। পরে ঘটনাটি ধামচাপা দিতে বন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে দৌড়ঝাপ শুরু হয়। এরই অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই এসএ কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বেশকিছু টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

শুল্ক স্টেশনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ স্টেশনে একজন সিপাহি, একজন সাব-ইন্সপেক্টর ও একজন ইন্সপেক্টর (এলসিও- ল্যান্ড কাস্টম্স অফিসার) থাকার কথা থাকলেও গত কয়েক বছরে এ অফিসে দায়িত্বরত ইন্সপেক্টর কখনই নিয়মিত অফিস করেননি। সাব-ইন্সপেক্টরগণও রয়েছেন অনিয়মিত। পরিবর্তে তারা প্রক্সি হিসেবে শাহাজাদা ও সরাফত আলী নামে দুই ব্যক্তিকে নিজেদের ব্যবস্থাপনায় অফিসে নিয়োগ দিয়ে তাদের মাধ্যমে যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনা করে আসছিলেন। এভাবে এলসি’র কাজও তাদের দিয়ে করানো হয়। অভিযোগ রয়েছে, মাঝেমধ্যে অফিসে এসে নিজের ভাগের বখরা (ঘুষের টাকা) তারা নিয়ে শেরপুর শহরে অবস্থান করেছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, শেরপুর ডিভিশনের কাস্টম্স সুপার ও সহকারী কমিশনার সবসময় এ শুল্ক স্টেশনে খোঁজ-খবর নেওয়ার কথা থাকলেও তারা নিয়মিত খোঁজ-খবর নেননি। উপরন্তু নিয়মিত মাসোহারার বিনিময়ে অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছেন। নাকুগাঁও স্থল বন্দরে আমদানী-রপ্তানীকারকদের সাতে শুল্ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজসে এলসির অতিরিক্ত পন্য আমদানী করে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার ঘটনা ওপেন সিক্রেট।

এদিকে বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে শুল্ক স্টেশন সংশ্লিষ্ট ও ব্যবসায়ীদের মাঝে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। দু’একজন ছাড়া বর্তমানে কেউই মিডিয়ার সামনে মুখ খুলছেন না। বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন শেরপুর কর অঞ্চলের বর্তমান রাজস্ব কর্মকর্তা মেহরাব আলী ও সহকারী কর কমিশনার পূরবী সাহা। তাদের আগের সময়কালীন থেকে অদ্যাবধি দায়িত্বরতরা কেন শুল্ক স্টেশনটিতে নিয়মিত খোঁজ-খবর নেননি কিংবা অফিস করেননি এ প্রশ্নেরও কোন সদুত্তর মিলছে না। আর এসব নানা কারণে সিএন্ডএফ এজেন্ট এসএ কর্পোরেশনের কর্মচারী শামছুর রহমান লিটন ও শুল্ক স্টেশনের প্রক্সি কর্মচারী সরাফত আলী নয়, এ শুল্ক স্টেশনের কর্মকর্তারা এসব কর্মকান্ডের সঙ্গে কোন না কোন ভাবে জড়িত বলে দাবী করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। শরিফ এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী আব্দুস সালাম বলেন, আমি চলতি বছর কয়লা আমদানির মওসুমে একটি এলসি করে যথারীতি সরকারী শুল্কের টাকা পরিশোধ করেছি। কিন্তু এখন শুনতে পাচ্ছি আমার টাকা জমা পড়েনি। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক চালানটি জাল ধরা পড়েছে।

নাকুগাঁও আমদানী রফতানীকারক সমিতির সাবেক সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান মুকুল জানান, এটার সঙ্গে মূলত কাস্টমসৃ কর্তৃপক্ষের কাজে অবহেলা চরমভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আসলে ইন্সপেক্টর থাকেনই না, উনি লোক দিয়ে কাজ চালান। ব্যবসায়ীরা সিএন্ডএফ এজেন্টের কাছে শুল্কের টাকা জমা দিলেও ওই এজেন্টের কর্মচারী ও শুল্ক স্টেশনের কতিপয় কর্মচারী যোগসাজশে এ কাজটি করেছে। এখানে কোনভাবেই ব্যবসায়ীরা জড়িত নন। এটার একটা সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে বন্দর ও ব্যসায়ীদের সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে হবে। এজন্য দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

সোনালী ব্যাংক নালিতাবাড়ী শাখার ব্যবস্থাপক দীলিপ পাল বলেন, নাকুগাঁও কাস্টমস অফিস থেকে আমাদের কাছে কয়েকটা চালান তারা সন্দেহবশত: ভুল হতে পারে বা জাল হতে পারে- এ ধরণের একটা ইনফরমেশন জানানো হয়েছে। তারা সেগুলো নিয়ে আসবে বলেছে। এখনও নিয়ে আসে নাই, আসলে সত্যতা যাচাই করা হবে।

শেরপুরের রাজস্ব কর্মকর্তা মেহরাব আলী বিষয়টি সম্পর্কে তদন্ত চলছে উল্লেখ করে তদন্তাধীন বিষয়ে মুখ খুলতে চাননি। সহকারী কর কমিশনার পূরবী সাহা উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত কোনপ্রকার কথা বলতে রাজি হননি।

(এইচবি/এটি/এপ্রিল ২৬, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test