E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ

প্রশিক্ষনার্থী ঝাড়ুদার, আয়া ও অফিস সহকারির ৩ মেয়ে!

২০২২ জুন ০১ ১৬:৪৭:১১
প্রশিক্ষনার্থী ঝাড়ুদার, আয়া ও অফিস সহকারির ৩ মেয়ে!

প্রহলাদ মন্ডল সৈকত, রাজারহাট : কুড়িগ্রামের রাজারহাটে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উদ্যোক্তা তৈরির নামে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। অনিয়ম আর দুর্নীতি ও সঠিক ভাবে প্রশিক্ষণ না দিয়ে বছরের পর বছর প্রশিক্ষণের নাম ব্যবহার হলেও কাজে লাগছে প্রশিক্ষণার্থীদের। আর এতে করে প্রতিটি প্রশিক্ষণের বিপরীতে লাখ-লাখ টাকা গচ্ছা যাচ্ছে সরকারের। 

অনুসন্ধানে দেখা যায়, কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলা পরিষদের বাইরে একটি পাঁচতলা ভবনের তৃতীয় তলায় সাইনবোর্ড বিহীন রাজারহাট উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের কার্যালয়। অনেকে জানে না এ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অফিসটি। ভিতরে প্রবেশ করলে মনে হবে না এখানে নারী উদ্যোক্তা তৈরির প্রুশিক্ষণ কেন্দ্র। যে যার মতই খোশ গল্পে মেতে সময় পার করছে প্রশিক্ষক-প্রশিক্ষণার্থীরা। চলতি ২০২১-২২অর্থ বছরের বিউটি ফিকেশন এবং ফ্যাশন ডিজাইন কোর্সের ১৪ ও ১৫ তম ব্যাচ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বছরে ৪টি কোর্স অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি কোর্সের মেয়াদ তিন মাস। প্রতি কোর্সে সকাল ১০টা হতে দুপুর ১টা এবং বিকেল ২টা থেকে ৫টা পযর্ন্ত প্রশিক্ষণে ২টি ব্যাচে ১০০ জন নারী উদ্যোক্তা অংশ নেন। তিন মাসের কোর্সে সরকারি ছুটিসহ অন্যান্য বন্ধের কারণে প্রশিক্ষণ হয় মোট ৬০/৬৫ দিন।

প্রতিদিনের ভাতা হিসেবে ২শত টাকা হারে প্রশিক্ষণার্থীরা ১২হাজার টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু প্রশিক্ষণ শেষে সেই টাকা এক হাজার থেকে দু’হাজার টাকা কর্তন করে বাকি টাকা প্রশিক্ষণার্থীদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়। এছাড়াও প্রশিক্ষনের উপকরণের জন্য প্রতি ব্যাচে ৬ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও কোন উপকরণ নেই। প্রশিক্ষণার্থীদের নিকট হতে চাঁদা তুলে উপকরণ ক্রয় করা হয়। বিধি অনুযায়ী ৮ম শ্রেণীর পাশের ১৬ হতে ৪২বছরের অবহেলিত-বঞ্চিত নারীরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে। কিন্তু সরকারি বিধি তোয়াক্কা না করেই অফিস সহকারী রেয়াচত আলী তার নিজের ৩মেয়ে এবং অফিসের পরিচ্ছন্ন কর্মী ফাতেমা বেগমসহ পছন্দের নারীদের নাম অন্তর্ভক্ত করে থাকেন। প্রশিক্ষণে অনুপস্থিত থেকেও প্রশিক্ষণের ভাতা নিচ্ছে তারা।

এছাড়াও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা জয়ন্তী রাণী রাজারহাট ও কুড়িগ্রাম সদরের দায়িত্বে থাকায় এ অফিসে মাসে দু-একবার এসে অফিস করেন। দীর্ঘদিন লোক চক্ষুর আড়ালে এভাবেই প্রতি ব্যাচে সরকারের বরাদ্দকৃত টাকা থেকে ২/৪লাখ টাকা আত্মসাৎ করছে অফিসের সিন্ডিকেট চক্রটি। প্রশিক্ষণার্থী মিনারা বেগম বলেন, এখানে প্রশিক্ষণ নিতে আসছি। নিজে কিছু করার জন্য। কিন্তু প্রশিক্ষণ নিয়ে কোন লাভ হচ্ছে না। এখানে কোন উপকরণ নেই। এসে গল্প গুজব করে সময় পার করতে হয়।

এছাড়া প্রোডাক্ট ক্রয়ের জন্য তারা ১'শ টাকা করে নিয়েছে। প্রশিক্ষণার্থী আরিফা আক্তার বলেন, আমাদের কোন কিছু শেখানো হচ্ছে না। বিউটি ফিকেশনের প্রশিক্ষণ নিলেও এখানে কোন প্রোডাক্ট নেই। আমাদের নিজেদের প্রোডাক্ট নিয়ে এসে একটু একটু শিখছি। প্রায় দু’মাস হলো প্রশিক্ষণে সেখানে আমরা শুধু ভ্রু, চুল আর ফেসিয়াল শিখাইছে। কিন্তু পার্লারের ম্যানলি কিছু আমরা শিখতে পারি নাই। প্রশিক্ষণার্থী লাবনী বলেন, আমরা ব্যাচে ২৫ জন আছি। আমরা দু’মাস ধরে নিয়মিত উপস্থিত থেকে ক্লাস করছি ২১জন। অথচ স্বাক্ষর হচ্ছে ২৫জনের। কোথায় কিভাবে স্বাক্ষর গুলো হচ্ছে আমরা জানি না। প্রতিদিন ক্লাসে ২১জনের স্বাক্ষর করি আমরা আর পরের দিন ক্লাসে এসে দেখি ২৫জনের স্বাক্ষর।

প্রশিক্ষক ফাহমিদা হক প্রশিক্ষণার্থীর উপস্থিতির বিষয়ে কোন সদুত্তোর দিতে না পারলেও তাদের নিকট থেকে জন প্রতি ১০০ টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, প্রোডাক্ট কেনার জন্য টাকা তুলে জয়ন্তী রাণী ম্যাডামকে দেয়া হয়েছে।

পরিচ্ছন্নকর্মী ফাতেমা বেগম বলেন, আমাকে অফিস থেকে মাসে এক হাজার টাকা বেতন দেয়। আমার নাম প্রতিটি ব্যাচেই অন্তর্ভুক্ত করে দেয়। সেখান থেকে কিছু টাকা দেয়। এছাড়া আর কোন টাকা পাই না।

এ বিষয়ে অফিস সহকারি রেয়াচত আলী প্রথমে নিজের মেয়েদের কথা অস্বীকার করেন। পরে প্রশিক্ষক এবং প্রশিক্ষণার্থীদের চাপে তার তিন মেয়েকে নিয়মিত প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার কথা স্বীকার করেন। তাদের হয়ে নিজেই হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দেয়ার কথা স্বীকারও করেন তিনি।

এছাড়াও তিনি আরো বলেন, চলতি ২০২১-২২অর্থ বছরে মোট প্রশিক্ষণার্থী ২শ জন। তাদের উপকরণে ক্রয়ের জন্য ৯০হাজার টাকা এবং ভাতা হিসেবে ২৪লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে।

সিনিয়র প্রশিক্ষক রেজিয়া খাতুন বলেন, আমার অফিস কাজ করার কথা থাকলেও লোকবল কম থাকায় আমাকে ফিল্ডে কাজ করানো হয়। ভিজিডি, নারী নির্যাতন, বাল্যবিয়ে, মামলা-কোর্ট এগুলো আমাকে দেখতে হয়। যদিও আমার এগুলো কাজ নয়। কর্মকর্তাদের নির্দেশে আমাকে ফিল্ডে যেতে হয়। এজন্য আমার কোন টিএডিএ দেয়া হয় না।
বুধবার(১লা জুন) সকালে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা জয়ন্তী রাণীকে অফিসে উপস্থিত পাওয়া যায়নি। তাকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

প্রকল্পের সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূরে তাসনিম বলেন, অনিয়মের তথ্য আপনার মাধ্যমে জানতে পেলাম। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

(পিএস/এসপি/জুন ০১, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test