E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শনিবার দক্ষিণাঞ্চলের সম্ভাবনার নতুন সূর্য উঠবে 

২০২২ জুন ২৩ ১৭:৩৮:৩৩
শনিবার দক্ষিণাঞ্চলের সম্ভাবনার নতুন সূর্য উঠবে 

অঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : ‘সবকিছু স্বপ্নের মতো, নিজের চোখে দেখার পরেও বিশ্বাস হয়না চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পরেই বরিশালসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কোটি মানুষের সম্ভাবনার স্বপ্ন পূরণ হয়ে সতুন সূর্য উঠবে শনিবার।

দেশ-বিদেশী একটি মহলের গভীর ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী পদক্ষেপের কারণে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু ২৫ জুন সকালে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর ২৬ জুন থেকে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। অথচ প্রমত্তা পদ্মা নদীর জন্য অনেকেই বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলে আসতে চাইত না। ২৫ জুনের পর সেই দুঃখ আর থাকবে না। এই একটি সেতুর অভাবে অনেক অবহেলিত আর পিছিয়ে পড়া জনপদ ছিল বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের ২১ জেলা। সেই অবহেলা আর থাকছে না। পুরো বাংলাদেশ যুক্ত হচ্ছে এক সুতোয়। তাই আমরা এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছি ২৫ জুনের। যেদিন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসীর ভাগ্যাকাশে নতুন সূর্য উদয় হবে। কথাগুলো বলছিলেন, স্বাধীনতার মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে, আওয়ামী লীগের দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র অভিভাবকখ্যাত মন্ত্রী আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি।

তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার সরকারের এবং বাংলাদেশের আস্থা, অর্থনৈতিক, কারিগরি, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও সাহসের প্রতীক। বাংলাদেশ স্বাধীন করার মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধু শিখিয়েছেন বাংলাদেশ ও বীর বাঙালি চাইলে সব কিছু করতে পারে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসিকতায় নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মান তারই বড় প্রমাণ রেখেছে নতুন করে বিশ্ববাসীর কাছে।

পর্যটন শিল্পে অপার সম্ভাবনা

কী নেই পদ্মার দক্ষিণ পারে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিস্থল থেকে শুরু করে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা, সমুদ্রবন্দর পায়রা, বাংলার বাঘ শেরেবাংলার জন্মভূমি এবং অপার সৌন্দর্যের বিস্তর্ণ উপকূল। প্রচুর সম্ভাবনা আর ইতিহাস ঐতিহ্যে ভরপুর অসংখ্য স্থাপনা বুকে ধারণ করলেও কেবল প্রমত্তা পদ্মার কারণে সবকিছুই ছিলো নক্ষত্র সমান দূরত্বে। পদ্মার বিশাল নদী পাড়ির ঝক্কি এড়াতে অনেকেই আসতে চাইতেন না দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায়। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও যুগের পর যুগ পিছিয়ে থাকার সেই কষ্ট দূর হচ্ছে কাল ২৫ জুন। উদ্বোধন হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এ সেতুকে ঘিরে তাই এখন শিল্পবাণিজ্য আর পর্যটনখাতে নয়াবিপ্লবের স্বপ্ন দেখছেন বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলের মানুষ। পুরোদমে চলছে সম্ভাবনার নতুন ভুবনে প্রবেশের প্রস্তুতি।

সূত্রমতে, ঢাকা থেকে সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের দূরত্ব প্রায় পাঁচশ’ কিলোমিটার। সেক্ষেত্রে মাত্র ২৬৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থান সাগরকন্যা কুয়াকাটার। এতো কাছে থেকেও কুয়াকাটা পর্যটকদের মনোযোগ কাড়তে পারেনি শুধুমাত্র পদ্মা নদীর কারণে।

কুয়াকাটা ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্টের (কুটুম) চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন বিপ্লব বলেন, রাজধানী তথা সারাদেশ থেকে পদ্মা আমাদের আলাদা করে রেখেছিল। এই নদীর কারণে কুয়াকাটায় বিনিয়োগে অত্যন্ত ধীরগতি ছিলো। আমাদের সেই আক্ষেপের দিন ফুরোচ্ছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টার মধ্যে ঢাকা থেকে কুয়াকাটায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। পর্যটকদের ভিড়ে সরগরম হয়ে উঠবে কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকত। তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে বিপুল বিনিয়োগের আশা নিয়ে দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং শিল্প গ্রুপগুলো এখানে আসতে শুরু করেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুয়াকাটার পাশাপাশি পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় স্থাপিত পায়রা সমুদ্র বন্দর নিয়েও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন দক্ষিণাঞ্চবাসী। বর্তমানে অপারেশনাল কার্যক্রমে থাকা পায়রাবন্দরে নিয়মিত ভিড়ছে সমুদ্রগামী জাহাজ। মোটা অঙ্কের রাজস্বও আয় করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বরিশাল বিভাগীয় উন্নয়ন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের সাবেক পরিচালক মোঃ আতিকুর রহমান আতিক বলেন, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় পায়রাবন্দরের দূরত্ব অর্ধেক। সাগরপাড় থেকে পণ্য পৌঁছাতেও কম সময় লাগবে। সেই বিবেচনায় পদ্মা সেতুর কারণে পায়রাবন্দরের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে। একইসাথে পদ্মা সেতুর কারণে মোংলা থেকেও খুব কম সময়ে আমদানি পণ্য ঢাকায় পৌঁছ যাবে। সেকারণে মোংলা বন্দরেরও গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে। সবকিছু মিলিয়ে পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিকে আকাশ সমান উচ্চতায় এগিয়ে নিয়ে যাবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

দর্শনীয় স্থান

বরিশাল বিভাগের আগৈলঝাড়ায় কবি বিজয় গুপ্তর মনসামঙ্গল কাব্যে উল্লেখিত মনসা মন্দির, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠিতে আটঘর-কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগানকে ঘিরে গড়ে উঠেছে পর্যটনকেন্দ্র জলের রাজ্য। বরগুনার তালতলীতে শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত এবং টেংরাগিরি বনাঞ্চল, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে জাহাজ মারা সৈকত, গলাচিপার কলাগাছিয়া সাগরপাড়, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার হরিণপালা এবং বরগুনার পাথরঘাটার হরিণঘাটা। ঝালকাঠির কাঠালিয়ায় নয়নাভিরাম ছৈলারচর। বরিশাল নগরীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শতবর্ষের পুরনো ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক বিবির পুকুর, ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু উদ্যান, চারণ কবি মুকুন্দ দাসের কালিবাড়ি, কড়াপুর মিয়াবাড়ি মসজিদ, অক্সফোর্ড মিশন চার্চ, কবি জীবনানন্দ দাশের বাড়ি, লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি, দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের বাড়ি, মেহেন্দীগঞ্জের উলানিয়া জমিদার বাড়ি, বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠী জমিদার বাড়ি ও পাদ্রিশিবপুর গীর্জা, গুটিয়া বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মাহিলাড়ার সরকার মঠ, শের-ই-বাংলা জাদুঘর, শংকর মঠ, মাধবপাশার জমিদার বাড়ি, মুঘল আমলের কমলাপুর মসজিদ ও আল্লাহর মসজিদ, লাল শাপলার স্বর্গরাজ্য সাতলার বিল।

বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশার দুর্গা সাগর। সাগরকন্যা কুয়াকাটার বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা ফাতরার চর, নয়ানাভিরাম সোনারচর, পানি জাদুঘর, চর বিজয়, লেবুর চর, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, লালদিয়া বন ও সমুদ্র সৈকত, শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত, বরগুনার ঐতিহাসিক বিবিচিনি শাহী মসজিদ, তালতলীর বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ একাডেমী, সোনাকাটা সৈকত। এছাড়া বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দ্বীপ ভোলা জেলার দর্শনীয়স্থান সমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-বিখ্যাত মনপুরা দ্বীপ, শাহবাজপুর গ্যাস ক্ষেত্র, চর কুকরী মুকরী, শিশু পার্ক, জ্যাকব টাওয়ার, তারুয়া সমুদ্র্র সৈকত, উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী, ঢালচর, তুলাতলী ইকোপার্ক ইত্যাদি।

বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস বলেন, ইতিহাস, ঐতিহ্য আর নিজস্ব সংস্কৃতিতে ভরপুর বিভাগের নাম বরিশাল। মনীষী, দার্শনিক, কবি-সাহিত্যিক ও দেশবরেণ্য রাজনীতিবিদরা জন্মগ্রহণ করেছেন এই জনপদে। এখানে ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে অদ্যবর্ধি গড়ে উঠেছে অগণিত ঐতিহাসিক আর দর্শনীয় স্থান। এছাড়াও এই বিভাগে রয়েছে একাধিক পর্যটনকেন্দ্র। যা দেখে ১৯৭৩ সালের ১ লা জানুয়ারি বরিশাল নগরীর তৎকালীন বেলেস্ পার্কে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু উদ্যান) দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি জনসভায় বলেছিলেন, বরিশালের পর্যটনকেন্দ্রগুলোকে বিদেশীদের আকৃষ্ট করতে আধুনিকমানের পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটে বঙ্গবন্ধু শাহাদাতবরণ করার পর বরিশালের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর আধুনিকতার স্বপ্নপূরণ থমকে যায়। বর্তমানে সামান্য সংখ্যক পর্যটক এসব দর্শনীয়স্থানে ঘুরতে আসে। এর পেছনেও অন্যতম কারণ ছিলো পদ্মা নদী।

(টিবি/এসপি/জুন ২৩, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test