E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

লোহাগড়ায় সাম্প্রদায়িক হামলা

ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন হামলার শিকার সাহাপাড়ার বাসিন্দারা

২০২২ জুলাই ২৭ ১৭:৪৭:১৫
ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন হামলার শিকার সাহাপাড়ার বাসিন্দারা

রূপক মুখার্জি, লোহাগড়া : নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের সাহাপাড়ার পরিবেশ-পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। সেখানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভাঙচুর হওয়া মন্দির ও আগুনে পোড়া ঘর মেরামত করা হয়েছে। প্রাণ ফিরে পেয়েছে দিঘলিয়া বাজারটি। এলাকায় পুলিশ নিয়মিত টহল দিচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা সাহাপাড়া পরিদর্শনে যাচ্ছেন। নিজেদের স্বাভাবিক যোগাযোগ ও কর্মচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে সাহাপাড়ার নারী-পুরুষেরা,পাড়ার শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে শুরু করেছে।

ইসলাম ধর্মের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা:) কে কটূক্তি করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার একটি অভিযোগকে কেন্দ্র করে ১৫ জুলাই সন্ধ্যার পর দিঘলিয়া বাজার ও সাহাপাড়ার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর ও দোকানপাট ও মন্দিরে হামলা হয়। এ সময় ভাঙচুর করা হয় চারটি মন্দির, পাঁচটি দোকান, একটি বসতঘর এবং একটি বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। হামলার পর সেদিন সন্ধ্যায় আতঙ্কে বাড়ি ছাড়ে ওই পাড়ার বাসিন্দারা।

বুধবার (২৭ জুলাই) দুপুরে সাহাপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, পাড়ার নারী-পুরুষেরা স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরেছে। তারা একে অন্যের বাড়িতে যাচ্ছেন। খোঁজ-খবর নিচ্ছে পাড়া-প্রতিবেশীদের। আগুনে ক্ষতিগ্রস্থ দিপালী সাহার বাড়ির ঘরটি সরকারী ভাবে নতুন টিন দিয়ে মেরামত করা হয়েছে। মেরামত করা হয়েছে ভাঙচুর হওয়া আখড়াবাড়ি সার্বজনীন ও শ্বশান মন্দির। ঘটনার পর দিঘলিয়া বাজারের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। দু’তিন দিন পরে বন্ধ হওয়া দোকানপাট খুলতে শুরু করে। বর্তমানে বাজারটি প্রাণ ফিরে পেয়েছে। বাজারে আগত ক্রেতা-বিক্রেতারা আগের মতোই কেনা-বেচা করছে।

সাহাপাড়ার বাসিন্দা দিপালী সাহার (৬০) বাড়িতে দেয়ালঘেরা টিনের চালার দুটি বসতঘর। দিপালী সাহার ছেলে গোবিন্দ সাহা দিঘলিয়া বাজারের ফুটপাতে পান বিক্রেতা। হামলার দিন দরিদ্র ওই পরিবারের একটি ঘরের মালামাল ও টিনের চালা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ঘরটি নতুন টিন দিয়ে সরকারি অর্থায়নে মেরামত হয়েছে।

দিপালী সাহা বলেন, ‘ঘরটির চালা নতুন হয়েছে, কিন্তু ঘরের মালামাল তো সব পুড়ে গেছে সেদিন। তবে এখন ভয় লাগছে না। সব কিছু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে। মনে সাহস আসছে।

একই পাড়ার ডলি সাহা বলেন, ‘আমরা দান চাই না। ভালোভাবে থাকতে চাই। আগের মতো মিলেমিশে শান্তিতে থাকতে চাই। যা ঘটার ঘটেছে। এখন সবাই যেন ভালো থাকতে পারি, আগের মতো চলাফেরা করতে পারি, শুধু এটুকুই চাওয়া’।

তিনি আরও বলেন, ‘পাড়ার নারী-পুরুষ সবাই বাড়িতে ফিরেছে। প্রতিদিনই বড় বড় লোকজন এখানে আসছেন। পুলিশ ও প্রশাসন টহল দিচ্ছে। এখন সমস্যা মনে হচ্ছে না।

সাহাপাড়ার রাধাগোবিন্দ মন্দিরের সভাপতি শিবনাথ সাহা গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ দু’টি বাড়ি, চারটি মন্দির ও পাঁচটি দোকানের তালিকা প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন ও সরকারের তরফ থেকে ক্ষতিগ্রস্থদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। দিঘলিয়া বাজারটি আগের মতো প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আতঙ্ক কেটেছে সাহাপাড়ায়। পুলিশ দিনরাত টহল দিচ্ছে। পাশাপাশি লোহাগড়ার ইউএনও প্রতিদিনই এলাকায় আসছেন’।

এদিকে গত রবিবার (২৪ জুলাই) রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত ব্র্যাক সেন্টার ইনে এক সভায় শিবনাথ সাহার ছেলে হ্যামলেট সাহা ওই রাতের নির্মমতার কথা তুলে ধরেন। এ সময় তিনি হামলাকারীদের বিরুদ্ধে পাড়ার সব ঘরে ঘরে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন। হ্যামলেট বলেন, ‘আমরা যখন অশোক সাহাকে পুলিশের কাছে দিলাম, যখন তাকে নিয়ে পুলিশ চলে যাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে ৫০০-৬০০ জন, যাদের অনেককে চিনি, অনেককে চিনি না। এ পাড়ায় আমরা ১০৮ ঘর সাহা থাকি। তারা আমাদের পাড়ার ভেতরে প্রতিটি বাড়িতে ১০-১২ জন করে ঢুকে গেল। প্রতিটি বাড়ির দরজায় তারা কড়া নেড়ে বলেছে, “টাকা দে, না হলে ঘরবাড়ি ভেঙে দেব, পুড়িয়ে ফেলব, তোদের মেরে ফেলব।” যাদের কাছে টাকা ছিল, তারা টাকা দিতে পেরেছেন। তাদের ঘরবাড়ি ভাঙেনি। আর যে বাড়ির লোকজন আগে থেকে পালিয়ে গেছে, সেসব বাড়ি ভেঙেচুরে এবং একটি বাড়িতে তো আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।’

তবে এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন হ্যামলেটের বাবা সাহাপাড়ার রাধাগোবিন্দ মন্দিরের সভাপতি শিবনাথ সাহা। তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘বাড়িতে বাড়িতে যে চাঁদাবাজির কথা শোনা যাচ্ছে, তার কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। হামলা হয়নি আমার বাড়িতে। ঘটনার দিন বিকেলে ১৫০-২০০ বিক্ষুব্ধ মানুষ আমার বাড়িতে এসে অভিযুক্ত আকাশ সাহার বিচার দাবি করে। আমি বিচার দিতে চাইলে তারা তখন ফিরে যায়। তারা আমার সঙ্গে কোন প্রকার খারাপ ব্যবহার করেনি’।

এ ব্যাপারে লোহাগড়া উপজেলা পুজা উদযাপন পর্ষদের সভাপতি প্রবীর কুমার কুন্ডু মদন বলেন, ‘ ক্ষতিগ্রস্থ সাহাপাড়ার মানুষজন ভীতি কাটিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে। সরকারী উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ মন্দির ও বাড়ি মেরামত করা হয়েছে। তারা স্বাভাবিক চলাফেরা শুরু করেছে। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের আশ্বাসে ভয়ে পালিয়ে থাকা সাহাপাড়ার বাসিন্দারা স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করেছে।

(আরএম/এসপি/জুলাই ২৭, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test