E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মানবতার খেসারত দিচ্ছেন ভৈরবের গাইনী চিকিৎসক মিশুতি রাণী ঘোষ

২০২২ অক্টোবর ১৭ ১৫:০৯:২১
মানবতার খেসারত দিচ্ছেন ভৈরবের গাইনী চিকিৎসক মিশুতি রাণী ঘোষ

সোহেল সাশ্রু, কিশোরগঞ্জ : বাঙালি উদার ও আবেগপ্রবণ জাতি। পরের উপকার করলে সে ধন্য হয়। এতদিন এটাই জেনে এসেছি। দেখেও এসেছি। কিন্তু এখন বাস্তবে দেখছি এর উল্টো চিত্র। মানবতা দেখাতে গিয়ে এখন খেসারত দিতে হচ্ছে মিশুতি রাণী নামে ভৈরবের এক মানবিক গাইনী চিকিৎসককে। তার অপরাধ, ভৈরব আনোয়ারা জেনারেল হাসপাতালে চাকুরি না করেও অনকলে ওই হাসপাতালে এসে মো. কামাল মিয়া নামে এক দরিদ্র রিকশা চালকের অসুস্থ স্ত্রী শিল্পী বেগমের চিকিৎসা করা। রোগী দরিদ্র হওয়ায় ডা. মিশুতি রাণী ঘোষ বিনামূল্যে ঔষধ দিয়েছেন। অল্প টাকায় ব্যবস্থা করে দিয়েছেন হাসপাতালের সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষার। চিকিৎসা করেছেন পরম যত্ন সহকারে তারই ফলস্বরূপ চিকিৎসার ৪ মাস পর মিথ্যা অভিযোগ এনে ডা. মিশুতি রাণী ঘোষসহ আনোয়ারা জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ভৈরব থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা শিল্পী বেগমের (২২) স্বামী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার পিরিজকান্দি গ্রামের রিকশাচালক মো. কামাল মিয়া। তিনি তার অভিযোগ লিপিতে উল্লেখ করেন, তার অসুস্থ স্ত্রীর আল্ট্রাসনোগ্রাম করে পেটের টিউমারকে জমজ বাচ্চা বলে ডিএনসি করেছে অনকলে আসা ডা. মিশুতি রাণী ঘোষসহ আনোয়ারা জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এ ব্যাপারে ডা. মিশুতি রাণী ঘোষ বলেন, শিল্পী বেগমের চিকিৎসা করতে অনকলে এসে তাকে বিনামূল্যে ঔষধ দিয়েছি। হাসপাতালের সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নির্ধারিত মূল্য থেকে বেশ কিছু টাকা ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। অতি যত্নসহকারে তার চিকিৎসা করেছি। এটাই ছিলো আমার অপরাধ। এজন্যই আমাকে এর খেসারত দিতে হচ্ছে আজ। চিকিৎসার ৪ মাস পর অপপ্রচার চালিয়ে মিথ্যা অভিযোগ এনে ভৈরব থানায় আমার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দাখিল করেছে রোগীর স্বামী।

তিনি আরও বলেন, গত ২১ এপ্রিল পেট ব্যথার কারণে শিল্পী বেগমকে আনোয়ারা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসেন তার স্বজনরা। পরদিন ২২ এপ্রিল তাকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। পেট ব্যথার কারণ জানতে প্রথমে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আজিজুল হক রোগীর আলট্রাসনোগ্রাম করেন। আল্ট্রাসনোগ্রামের রিপোর্টে রোগীর ‘মোলার প্রেগন্যান্সি’ ধরা পড়ে।

তিনি বলেন, ডাক্তারী ভাষায় মোলার প্রেগন্যান্সি হলো এক ধরণের অস্বাভাবিক গর্ভধারণ। যেখানে গর্ভফুলের টিস্যুগুলোর অস্বাভাবিক এবং অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি ঘটে। মোলার প্রেগন্যান্সির নিস্ক্রীয় ডিম্বাণুর ক্ষেত্রে ভ্রুণ গঠিত হওয়ার পরিবর্তে অস্বাভাবিক সিস্ট বা টিউমারে পরিণত হয়। যা দেখতে আঙ্গুরের থোকার মত হয়। এ ধরনের রোগীকে অনেকদিন ডাক্তারের পর্যবেক্ষণে থাকতে হয়। রোগীকে সবদিক দিয়ে সতর্ক থাকতে হয়। এই রোগ হলে একবার ডিএনসি করার পরও আবার টিউমারের সৃষ্টি হতে পারে। যার কারণে ডাক্তারের কাছে নিয়মিত আসতে হয়।

ডা. মিশুতি রাণী ঘোষ আরও বলেন, আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট দেখে রোগীর ডিএনসি করার জন্য তাকে অনকলে ডেকে আনেন আনোয়ারা জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তিনি হাসপাতালে গিয়ে রোগীকে ডিএনসি করার আগে আবারও একবার আলট্রাসনোগ্রাম করেন। তখনও ‘মোলার প্রেগন্যান্সি’র একই রিপোর্ট আসে। রোগী ভর্তি হওয়ার পরদিন চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল তিনি ডিএনসি করেন। রোগীকে ডিএনসি করার আগে রোগীর স্বামী ও মায়ের কাছে সবকিছু জানালে তারা তাকে ডিএনসি করার অনুমতি দেন। এ সময় রোগীর স্বজনদের জানানো হয়, যদি রোগীর সমস্যা হয় তাহলে পরবর্তীতে জরায়ু অপারেশন করে কেটে ফেলে দিতে হতে পারে। কিন্তু তখন শুধু ডিএনসি করা হয়। ডিএনসি করার পর বায়োপসি করার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নমুনা পাঠালে সেখানকার রির্পোটেও রোগীর মোলার প্রেগন্যান্সিই আসে। রোগীকে ৩ দিন হাসপাতালে রাখা হয়। ডিএনসি করার পর রোগী সুস্থই ছিল। তিনদিন পর রোগীকে ছাড়পত্র দিয়ে হাসপাতাল থেকে বিদায় দেওয়া হয়। তখন রোগীর স্বামী কামাল মিয়াকে বলা হয়েছিলো রোগীকে চেক ডিএনসি করানোতে ১৫ দিন পর আবার হাসপাতালে নিয়ে আসার জন্য।

কিন্তু রোগীর স্বামী চিকিৎসকের কথা অমান্য করে এক মাস পর গত ২৬ মে রোগী শিল্পী বেগমকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। আনার পর দেখা যায়, রোগীর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তখন তাকে রক্ত দেওয়া হয় এবং পরবর্তী চিকিৎসার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই অবস্থায় রোগীকে জরায়ু অপারেশন করার কথা বললে রোগীর স্বামী কামাল মিয়া রাজি হননি। তখন তিনি ও রোগীর মা হাসপাতালের কাগজপত্রে স্বাক্ষর দিয়ে নিজেদের জিম্মায় হাসপাতাল থেকে রোগীকে স্বেচ্ছায় বাড়ি নিয়ে যান।

তিনি এই বিষয়ে আর কোন কিছু জানেন না বলে দাবি করে বলেন, রোগীকে যে সময় যেসব চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন তা আমরা রোগীর স্বজনদের জানিয়ে তাদের সম্মতি নিয়েই করেছি। তাদের স্বাক্ষরিত সকল দালিলিক প্রমাণ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ ৪ মাস পর হঠাৎ জানতে পারি রোগীর স্বামী কামাল মিয়া আমার নামসহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নামে থানায় একটি অভিযোগ দাখিল করেছেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে জানতে পারি, আমি নাকি ভুল আল্ট্রাসনোগ্রাম করে ভুল চিকিৎসা করেছি, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এছাড়া ওই রোগীকে আনোয়ারা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর পর এক জায়গায় চিকিৎসা না করিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে ঘুরানোর ফলে রোগীর অবস্থা কিছুটা অবনতি হয়ে থাকতে পারে।

ডা. মিশুতি রাণী ঘোষ আরও বলেন, যদি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রোগী আনোয়ারা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে থাকতেন, তাহলে এমন নাও হতে পারতো। কিন্তু এখন আমাদের ওপর সব দোষ চাপানো হচ্ছে। যা সঠিক নয় দাবী করে তিনি বলেন, আমাদের ওপর আরও যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সঠিক নয়। একজন চিকিৎসক কোন সময়ই চিকিৎসার জন্য কত টাকা লাগতে পারে তা কখনও আগে থেকে বলতে পারেন না। জানা যায়, অভিযোগ লিপিতে বলা হয়েছে, আমি নাকি বলেছি চিকিৎসা করতে ৫০ হাজার টাকা লাগবে। যা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। বরং চিকিৎসা নিতে আসা শিল্পী বেগমের স্বামীর অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না থাকায় ঔষধ কোম্পানি থেকে আমাকে যেসব ফ্রি স্যাম্পল দিয়েছিল, ওই ঔষধ থেকে রোগীকে বিনামূল্যে ঔষধ দিয়েছি। এছাড়া হাসপাতালে সকল ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষায়ও ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছি।

অভিযোগপত্র ও সকল হাসপাতালের পরীক্ষা নিরীক্ষার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, গত ২১ এপ্রিল প্রথমে আনোয়ারা জেনারেল হাসপাতালে আলট্রাসনোগ্রাম করানোর পর গত ২২ এপ্রিল হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ২৩ এপ্রিল ডিএনসি করানো হয় রোগীর। এর এক মাস পর গত ২৬ মে আবার আনোয়ারা জেনারেল হাসপাতালে গেলে ওইখান থেকে চিকিৎসা না করিয়ে নিজেদের ইচ্ছায় বাড়ি ফিরে যায় রোগীসহ তার স্বজনরা। এর ৮ দিন পর ভৈরবের মেঘনা জেনারেল হাসপাতালে ওই রোগীকে নিয়ে গিয়ে অধ্যাপক ডা. লাইলা নূরকে দেখান। মেঘনা জেনারেল হাসপাতালে অধ্যাপক ডা. লাইলা নূরের তত্ত্বাবধানে ২১ দিন চিকিৎসা নেন। এছাড়া সাড়ে তিন মাস পর আবার বাজিতপুর জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়। এর মধ্যেই নরসিংদী সদর হাসপাতালেও চিকিৎসা করানো হয়েছে বলে রোগীর স্বামী কামাল মিয়া জানিয়েছেন।

কামাল মিয়া আরো বলেন, তিনটি হাসপাতালের রিপোর্ট একই ‘মোলার প্রেগন্যান্সি’। তারাও বলেছেন, জরায়ু অপারেশন করে কেটে ফেলে দিতে হবে। কিন্তু আনোয়ারা জেনারেল হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. আজিজুল হক স্বপন বলেছেন, রোগীর পেটে ২টি বাচ্চা আছে। একটি নষ্ট হয়ে গেছে অন্যটি ভালো আছে। ডিএনসি করে নষ্ট বাচ্চা বের করতে হলে দুটো বাচ্চাই নষ্ট হয়ে যাবে। হাসপাতালের ছাড়পত্রে তারা লিখেছেন ৩ মাসের বাচ্চা। মেঘনা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. লায়লা নূর রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি রেখে আলট্রাসনোগ্রাম করে বলেছেন, রোগীর পেটে বাচ্চা নেই। তারপর রোগীর শরীরে রক্ত দিয়েছেন। প্রতি শুক্রবারে বাড়ি থেকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ২১ দিন চিকিৎসা করানো হয়। তারপর বলেছেন, রোগীর শরীরের রক্ত দুষিত হয়ে গেছে। ক্যান্সার দেখা দিয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলা হয়। আমাদের কাছে বেশী টাকা পয়সা না থাকায় এক সপ্তাহ পর বাজিতপুর জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে ১১ দিন রেখে চিকিৎসা করানোর পর মুটামুটি সুস্থ হয়ে যায়। এক মাস ভালো যাওয়ার পর আবার শরীর খারাপ হয়ে যায়।

এ ব্যাপারে আনোয়ারা জেনারেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আজিজুল হক বলেন, তিনি আল্ট্রাসনোগ্রাম করে মোলার প্রেগন্যান্সী রিপোর্ট দিয়েছেন। রোগীর পেটে দুইটি বাচ্চা আছে। এর মধ্যে একটি জীবিত অন্যটি মৃত, এমন কোন রিপোর্ট তিনি দেননি দাবী করে বলেন, তার দেওয়া আল্ট্রাসনোগ্রামের রিপোর্ট দেখলেই তা প্রমাণ হয়ে যাবে। একটি কুচক্রী মহলের প্ররোচনায় তাদের বিরুদ্ধে এমন মিথ্যা অভিযোগ করে ভৈরব থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন রোগীর স্বামী কামাল মিয়া। তিনি এ অভিযোগের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান এবং সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানান।

এ ব্যাপারে ভৈরব থানা ইন্সপেক্টর (অপারেশন) কায়সার আহমেদ জানান, কামাল মিয়া তার স্ত্রীর ঘটনা নিয়ে একটি অভিযোগ দিয়েছেন। এখনও তদন্ত চলছে। তদন্তশেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডাক্তার জানান, আমাদের ভৈরবের ব্যবসা-বাণিজ্য যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে এমনিতেই ঝিমিয়ে পড়েছে। তাছাড়া স্বাস্থ্যখাতে ভৈরবের মানুষ বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয় না। যারা এই খাতে বিনিয়োগ করেছেন, তারাও হাসপাতাল চালাতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন। অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্বাস্থ্যখাত অনেক উন্নত। ওই এলাকায় দেখা গেছে, এমআরআই, সিটি স্ক্যান, ডেন্টাল এক্স-রেসহ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে হাসপাতালগুলো গড়ে উঠেছে। যেখানে আমাদের ভৈরব শূণ্যের কোটায়। তবে আমাদের ভৈরবে চিকিৎসা ব্যবস্থার মান মফস্বল শহরের যে কোন এলাকার তুলনায় অনেক উন্নত। তারপরও আমরা পিছিয়ে আছি। আমাদের ভৈরবে এখন পর্যন্ত ভালো মানের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই বা আসেন না। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন, চাহিদা অনুযায়ী তাদের রোগী মিলে না। আমরা যারা হাসপাতালের মালিক আছি, তারা কোনো রকমে বেঁচে আছি। আমাদের দোষত্রুটি কমবেশি আছে। রোগীরা যখন আমাদের কাছে আসেন, তারাও অন্তিম সময়ে আসেন। তার পরও বলব, আমরা চেষ্টা করি রোগীকে সুস্থ করে বাড়ি ফিরিয়ে দিতে। আমি বিশ্বাস করি, এই পেশায় যারা আছেন, তারা এখনও ভালো মানুষ ও আন্তারিকতার সহিত রোগীর সেবা দিয়ে থাকেন।

(এসএস/এএস/অক্টোবর ১৭, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test