E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

নওগাঁয় বিআরটিএ অফিসে ব্যাপক অনিয়ম দুর্ণীতির অভিযোগ 

২০২২ ডিসেম্বর ০২ ১৭:৩৬:০৮
নওগাঁয় বিআরটিএ অফিসে ব্যাপক অনিয়ম দুর্ণীতির অভিযোগ 

নওগাঁ প্রতিনিধি : নওগাঁয় সেবা গ্রহীতাদের ভোগান্তীতে ফেলে দালালদের মাধ্যমে কোটি টাকা অবৈধ আয়ের অভিযোগ উঠেছে বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক (এডি) মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ ও মোটরযান পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) ফয়সাল হাসানের বিরুদ্ধে। ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে শুরু করে মোটরযান নিবন্ধন সর্বক্ষেত্রে নির্ধারিত দালাল ছাড়া কোন কাজই করেন না তারা। খোদ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সংলগ্ন অফিসটিতে এসব অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছেন তারা। এতে চরম ভোগান্তী পোহাতে হচ্ছে সেবা প্রত্যাশীদের। দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুদকসহ সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সচেতনরা।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৬ সালের ২৩ আগস্ট বিআরটিএ নওগাঁ সার্কেল অফিসে মোটরান পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত ছিলেন মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ। সে সময়ে অফিসটি দুর্নিতী ও প্রকাশ্য ঘুষ গ্রহণের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর তিনি অন্য জেলায় বদলী হোন। এরপর অফিসটিতে দুর্নীতি ও প্রকাশ্য ঘুষ লেনদেন অনেকটাই কমে এসেছিল। সেই সাথে দাপুটে দালালদের দৌরাত্মও কমে যায়। এরই মধ্যে ২০২০ সালের ৮ এপ্রিল মোটরযান পরিদর্শক হিসেবে অফিসটিতে যোগদান করেন ফয়সাল হাসান। তিনি যোগদানের পরই সেখানে আবারো শুরু হয় প্রকাশ্য ঘুষ লেনদেন।

বিষয়টি নিয়ে দুদক থেকে ওই কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা হলেও এতে পরিবর্তন আসেনি। এবছর ২৮ এপ্রিল নওগাঁ বিআরটিএ’তে সহকারী পরিচালক (এডি) হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে আবারো যোগদান করেন প্রাক্তন মোটরযান পরিদর্শক মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ। নতুন এডি যোগদানের সপ্তাহ না পেরোতেই অফিসটিতে অনিয়ম ও দুর্নীতির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যহারে বাড়তে থাকে। অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করে উৎকোচ আদায়ের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া হয় আরো কয়েক হাজার টাকা বেশি। দালাল ছাড়া পরীক্ষা দিয়ে উর্ত্তীর্ণ হলেও তাদেরকে অকৃতকার্য দেখিয়ে দিনের পর দিন হয়রানি করা হয়। পেশাদার ও অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের প্রতিটা আবেদনে কমপক্ষে ৪ হাজার টাকা এবং মোটরসাইকেল নিবন্ধনের প্রতিটা ফাইলে কমপক্ষে ২ হাজার টাকা উৎকোচ না পেলে ফাইলটি ছুঁয়েও দেখেন না এডি ও ইন্সপেক্টর। এভাবে সেবা গ্রহীতাদের ভোগান্তীতে ফেলে দালালদের মাধ্যমে কোটি টাকা অবৈধ আয় করছেন তারা।

সম্প্রতি শহরের থানার মোড় এলাকায় অবস্থিত কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (টিটিসি) গিয়ে দেখা যায়, লার্নার ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা শুরু হওয়ার ১ ঘন্টা আগেই সেখানে দলবদ্ধভাবে অবস্থান নেয় ১৫ থেকে ২০ জন দালাল। সাধারণ পরীক্ষার্র্থীদের নানা কলাকৌশলে জিম্মি করে হাতিয়ে নেয় সরকার নির্ধারিত ফি বহির্ভূত ৫ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা। এর চেয়ে আরো বেশি টাকা আদায় করা হয় মাদকাসক্ত, অযোগ্য ও অশিক্ষিত পরীক্ষার্থীদের থেকে। বিআরটি’র এসব অনিয়মে অসংখ্য দালাল সম্পৃক্ত থাকলেও এডি ও ইন্সপেক্টরের নির্ধারিত দালাল একজন। যার নাম আব্দুল কুদ্দুস। অন্য সব দালালদের থেকে টাকা সংগ্রহ করে প্রকাশ্য ইন্সপেক্টরের হাতে ঘুষের টাকা তুলে দেন এই দালাল। প্রকৃত অর্থে আব্দুল কুদ্দুস একজন দালাল হলেও দীর্ঘ বছর যাবত এডি ও ইন্সপেক্টরের সাথে অবৈধ সখ্যতা থাকায় তিনিও এখন নিজেকে বিআরটি’র কর্মকর্তা হিসেবেই পরিচয় দেন। পরীক্ষার্থীরাও বিষয়টিকে সহজেই বিশ^াস করেন। কারণ পেশাদার ও অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় পাশের ফলাফল দেয়ার সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয় তাকেই।

লিখিত পরীক্ষা চলাকালে যারা ঘুষ দিয়েছেন তাদেরকে ফাঁকা খাতা জমা দিয়ে শুধুমাত্র নাম ও রোল খাতায় লিখে আসতে বলেন খোদ মোটরযান পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) ফয়সাল হাসান নিজেই। এছাড়া পরীক্ষা কেন্দ্রে যারা মোটরসাইকেল নিয়ে এসেছেন তাদের থেকে জোরপূর্বক ৫০ টাকা এবং যারা মোটরসাইকেল আনেননি তাদের এক রাউন্ড মোটরসাইকেল চালাতে দেয়ার বিনিময়ে ১০০ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। পরীক্ষার্থীদের থেকে আদায়কৃত এই ১৫০ টাকা বিআরটিএ’র ফি বলে নিচ্ছেন সাদেকুর রহমান ও নাজমুল নামের দুই ব্যক্তি। এই দুজনের মাধ্যমে টাকাগুলো সংগ্রহের পর তা বিআরটিএ’র মেকানিক্যাল অ্যাসিসটেন্ট আশরাফুল ইসলাম বুঝে নিচ্ছেন।

গত ১৪ নবেম্বর নওগাঁ কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (টিটিসি) অপেশাদার মোটারসাইকেল ড্রাইভিং লাইসেন্স এর পরীক্ষা দিতে আসেন পরিতোষ কুমার। তার রোল নম্বর ছিলো ২০৭। লিখিত, ভাইভা ও প্রাকটিক্যালে উত্তীর্ণ হওয়ার পর খাতায় কি লিখেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২য় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছি। খাতায় কি প্রশ্ন ছিলো বলতে পারবো না। ভাইভা বোর্ডে স্যাররা সব শিখিয়ে দিয়েছেন। বিদ্যুৎ নামে এক দালালকে ৬ হাজার টাকা দিয়ে সব ধাপে পাশ করেছি। মেডিক্যাল সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে সবকিছুই ওই দালাল তৈরী করে দিয়েছে।

নওগাঁ সদর উপজেলার লোকমান আলী, আত্রাই উপজেলার পলাশ, পতœীতলা উপজেলার রফিকুল, মহাদেবপুর উপজেলার তৌহিদসহ টিটিসিতে আসা একাধিক পরীক্ষার্থীদের সাখে কথা হলে তারা বলেন, লার্নার ড্রাইভিং লাইসেন্স এর আবেদনের সময় প্রথম ধাপে দালালকে ১ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হয়েছে। এরপর পরীক্ষার আগে আরো ৬-৮ হাজার টাকা নিয়েছে। ঘুষ না দিলে দিনের পর দিন অফিস থেকে ঘুরানো হয়। পরীক্ষা দিলেও অফিসাররা পাশ করান না। তাই বাধ্য হয়েই ঘুষ দিয়ে পাশ করতে হয়েছে।

পরীক্ষার্থীদের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা নিচ্ছিলেন আব্দুল কুদ্দুস। ওই সময় তার পরিচয় এবং লাইসেন্স প্রতি খরচ সম্পর্কে জানতে চাইলে নিজেকে বিআরটিএ’র কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, হেড অফিস থেকে এখানকার প্রত্যেক লাইসেন্স আমি কনট্রাক্ট নিয়েছি। আমার মাধ্যমেই সব লাইসেন্স হয়। অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রতি ৯ হাজার টাকা এবং পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রতি ১২ হাজার টাকার প্যাকেজ রয়েছে। পরীক্ষা নিজে উপস্থিত থেকেই নিবেন এবং কিছু না পারলেও পাশ করে দিবেন বলে আশ্বস্ত করেন তিনি। সেবা প্রত্যাশীদের জিম্মি করে উৎকোচ আদায় এবং দালাল দিয়ে পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মোটরযান পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) ফয়সাল হাসান বলেন, কোন প্রকার অভিযোগ সংক্রান্ত বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলা নিষেধ। কুদ্দুস নামে অফিসে কোন স্টাফ নেই। তার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবী করেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে বিআরটিএ নওগাঁ সার্কেলের সহকারী পরিচালক (এডি) মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ এর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, অফিসে কোন প্রকার ঘুষ লেনদেন হয় না। দালালমুক্তভাবে কাজ করা হয়।

(বিএস/এসপি/ডিসেম্বর ০২, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test