E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

৫১ বছরেও গণকবরগুলো চিহ্নিত করে নেওয়া হয়নি সংরক্ষণের উদ্যোগ

২০২২ ডিসেম্বর ০৩ ১৫:৪৬:১৩
৫১ বছরেও গণকবরগুলো চিহ্নিত করে নেওয়া হয়নি সংরক্ষণের উদ্যোগ

একে আজাদ ও মিঠুন গোস্বামী, রাজবাড়ী : ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের প্রেতাত্তারা এ দেশের নিরিহ মানুষের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালায়। চালায় গণহত্যা। নিরীহ, নির্দোষ মানুষগুলোকে ধরে ধরে গুলি করে অথবা ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। এসব মানুষের দেওয়া হয় গণকবর।

সারাদেশের মতো রাজবাড়ী জেলার একাধিক স্থানে ঘটেছিল এমন নারকীয় ঘটনা। রয়েছে অনেক গণকবর। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পরেও সেসব গণকবরগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

রাজবাড়ী শহরের লোকোশেড, কালুখালী রেলস্টেশন সংলগ্ন মালিয়াটের ৩ টি স্থানে, পাংশা উপজেলার মাগুড়াডাঙ্গি তিন চারা রেলব্রীজ, মাছপাড়া রেল স্টেশন এলাকা এবং বালিয়াকান্দি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের শালবরাট, রামদিয়া, নারায়ণপুর, ঠাকুরনওপাড়া এলাকায় মিলেছে গণকবরের সন্ধান।

এর মধ্যে রাজবাড়ী শহরের লোকোশেডে নামমাত্র একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। বাকিগুলো এখনও অরক্ষিত ও অযত্নে পড়ে আছে। কিছু স্থান বেদখল হয়ে গেছে।

পাংশা উপজেলার মাগুড়াডাঙ্গি গ্রামের তিন চারা রেল ব্রীজের কাছে রয়েছে একটি বড় গণকবর। যেখানে মানুষকে ট্রেনে করে এনে নামিয়ে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়েছিল।

নির্মম এসব হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী মাগুড়াডাঙ্গি গ্রামের বাসিন্দা মোঃ দেলবর আলী বলেন, সেদিন ছিল বৈশাখ মাসের ৫ তারিখ। আমি তখন তিল কাটছিলাম ব্রিজের দোপে।তখন বেলা ১১টা কি ১২টা হবে। একটি ট্রেন আসে থামে তিনচারা রেল ব্রিজের কাছে। আমরা ভয়েতে দৌড়ে দৌড়ে পালাই।বিহারী আর সাদা পোশাক পরে রাজাকাররা এক জনকে ট্রেন থেকে নামায়ে ব্রিজের উপর নিয়ে গলা কাটে লাথি দিয়ে দোপে ফেলা দেয়। এমন করে ২১ জনরে ট্রেন থেকে নামায়ে গলা কাটে হত্যা করে সবার মরদেহ ব্রিজের নিচে ফেলা দিয়ে যায়। ২১ জনের ভেতর থেকে ২ জন বেঁচে যায়। এক সপ্তাহ পরে ডোম মেথররা দুটি গর্ত করে লাশগুলো চাপা মাটি দেয়।

পাংশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী বলেন, পাংসার সকল বদ্ধভূমি গুলো চিহ্নিত করে একটি তালিকা পাঠানো হয়েছে।মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য এসব স্থানে স্মৃতিসৌধ অথবা সরকারি স্থাপনা নির্মাণ করা যেতে পারে।

রাজবাড়ীর কালুখালী রেল স্টেশন সংলগ্ন মালিয়াটের ৩ টি স্থানে মানুষকে হত্যা করে ফেলে রাখা হতো। এসব স্থান বেদখল হয়ে আছে। একটি স্থানে সিনেমা হল, আর একটি স্থানে আম বাগান করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে প্রত্যক্ষদর্শীরা। তবে অন্যটিতে ১০ ফুট লম্বা ও দুই ফুট উচ্চতার একটি দেয়াল করা হয়েছে। কিন্তু তা সম্পূর্ণ হয়নি। আশপাশ আবর্জনায় ভরা। জানা গেছে, জায়গাটি বেদখল হয়ে গিয়েছিল। ২০১৭ সালে গণকবরের জায়গাটি উদ্ধার করে এই দেয়ালটি করা হয়। কিন্তু এখনও তা অসম্পূর্ণ অবস্থায় আছে।

সেই সময়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী কালুখালীর মালিয়াটের বাসিন্দা রোকেয়া বেগম আক্ষেপ করে বলেন, তোমরা যেখানে বদ্ধভূমি করছো ওই স্থানই শুধু না। পাশের আম বাগান ও সিনেমা হলের নিচে মানুষের লাশ রয়েছে। বিহারি, রাজাকার আর মুজাহিদরা দুরের থেকে মানুষ নিয়ে এসে এসব স্থানে কোনোমত গর্ত করে লাশ মাটি চাপা দিয়ে চলে যেত। পরে প্রচন্ড গন্ধ হতো। এলাকায় থাকা যেতো না। এই তিন স্থানে একশোরও বেশি লাশ আছে। চরের থেকে গরু ছাগল নিয়ে এসে রাজাকারেরা এইখানে রান্না করে খেতো।

কালো কালো উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ জাকির হোসেন বলেন, আমি সবে মাত্র এই উপজেলা দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে। কালুখালীতে বাধ্যভূমি আছে এমন একটি স্থানের কথা জান। আম বাগান ও সিনেমা হলের কথা জানা নেই। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

জেলার সবচেয়ে বড় গণকবরটি বালিয়াকান্দি উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের শালবরাটে। যেখানে চার শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।এছাড়াও রামদিয়া, নারায়ণপুর, ঠাকুরনওপাড়া এলাকায় চালানো হয়েছিল নিঃসংস হত্যাযজ্ঞ। তবে সে স্থানে স্মৃতিটুকু সংরক্ষণের জন্য এখনো নেয়া হয়নি কোন উদ্যোগ।

কথা হয় পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া মোঃ আকবর হোসেন পিন্টুর সঙ্গে। তিনি গণহত্যার ভয়াবহতার কথা স্মরণ করে বলেন,সে সময় স্থানীয় হিন্দুরা তাদের স্বর্ণালংকারের নিরাপত্তার জন্য রামদিয়া স্টেশন মাস্টারের কাছে রাখেন। সেই স্বর্ণালংকার স্টেশন মাস্টার আত্মসাৎ করলে এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। স্টেশন মাস্টার বিহারী ও মুজাহিদদের সাথে আঁতাত করে ফরিদপুর থেকে বিশেষ একটি ট্রেনে সেনাবাহিনী নিয়ে আসে। ট্রেনটি রামদিয়া স্টেশনে পৌঁছানোর আগেই সেনা সদস্যরা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ব্লাঙ্ক ফায়ার করতে থাকে। এতে এলাকাবাসী বুঝতে পেরে যার যার মত পালাতে থাকে। সেনা সদস্যরা স্টেশনে নেমেই ঠাকুরনওপাড়ার হিন্দু পল্লীর ভিতর দিয়ে আসতে শুরু করে। সে সময় তারা সুরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও নিমাই সরকার নামের দুইজনকে গুলি করে। তারা সেখানেই মারা যায়। পরে মাঠের মধ্যে থেকে পাল মশাই কে গুলি করে হত্যা করে। এতে আমরা গ্রামবাসী আতঙ্কিত হয়ে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তার উপর শতাধিক লোক দাঁড়িয়ে আল্লাহু আকবার করতে থাকি। সেনাবাহিনীরা আমাদের কাছে এসে ১৮ বছরের নিচের সবাইকে তাড়িয়ে দেয়। ফলে আমি বেচে যায়। পরে পাশের পুকুরের মধ্যে ১৯ জনকে দাঁড় করিয়ে বিরাশ ফায়ার করে হত্যা করে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোখলেছুর রহমান গণহত্যার ভয়াবহতার কথা স্মরণ করে বলেন, আমি যশোরে যুদ্ধ করছিলাম। তখন শুনতে পাই বালিয়াকান্দিতে সেনা ঢুকবে। আমি যশোর থেকে চলে আসি। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে একটি ট্রেন আসে। ট্রেনটি নাওপাড়া, শালবরাট, নারায়ণপুর এলাকায় থামে। এসব জায়গায় সেনারা নেমেই হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।

‘ব্রাশফায়ার করে মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করে। ওই সময় কেউ পালিয়ে যায়। কেউ পালাতে চেয়েও পারেনি। সেদিন এলাকার নিতাই চন্দ্র সরকার, সুরেন্দ্র নাথ সরকার, চন্ডী সাহা, চুনী সাহা, প্রমিলা রানী, কালীদাসী, চন্ডিদাসীসহ অনেক মানুষকে হত্যা করে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী। এই তিনটি জায়গায় কম করে হলেও এক হাজার মানুষকে হত্যা করে হানাদার বাহিনী।

বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আম্বিয়া সুলতানা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের যে কোনো বিষয় সংরক্ষণ করার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। বালিয়াকান্দির গণকবরগুলো চিহ্নিত করতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলব।

মৃত্যু পথযাত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক মন্ডল বলেন, ‘১৯৭১ সালে রাজাকার, বিহারি, পাকিস্তানি বাহিনী, মিলিশিয়ারা মিলে গ্রামে গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। তারা গুলি করে, কুপিয়ে মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

রাজবাড়ীর গণকবরগুলো অযত্নে পড়ে আছে। আজ পর্যন্তও কেউ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়নি। এসব গণকবর সংরক্ষণ করে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।

(একেএমজি/এসপি/ডিসেম্বর ০৩, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test