E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

২০২২ সালে সিলেট বিভাগে ১০৪ খুন

২০২৩ জানুয়ারি ১০ ১৮:২৮:৩৩
২০২২ সালে সিলেট বিভাগে ১০৪ খুন

আবুল কাশেম রুমন, সিলেট : গত বছর ২০২২ সালে সিলেট বিভাগ জুড়ে ছিলো সবচেয়ে দুঃখময় ঘটনা। প্রতিদিন সংবাদপত্রের চোখ দিলে দেখা গেছে কোথাও না কোথাও খুনের খরব উঠেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সিলেট বিভাগে গেল বছর ১০৪টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। জমিজমার বিরোধকে কেন্দ্র করে খুনোখুনির পাশাপাশি তুচ্ছ ঘটনা নিয়েও প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। মাত্র এক শতক জমি নিয়ে বিবাদে খুন হয়েছেন এক শিক্ষক। সংঘটিত খুনের মধ্যে সিলেট জেলায় সর্বোচ্চ ৫১ জন খুন হন। এর মধ্যে সীমান্তে হত্যাও আছে। সুনামগঞ্জ জেলায় ২৬ জন, হবিগঞ্জ জেলায় ১৮ জন ও  মৌলভীবাজার জেলায় ৯ জন খুন হয়েছেন।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, গেল বছরের প্রথম দিনেই কোম্পানীগঞ্জের কালাইরাগ সীমান্তে খাসিয়াদের গুলিতে লুকেশ রায় (৩৬) নিহত হন। ফেঞ্চুগঞ্জে ৪ জানুয়ারি খুন হন নাহিদ মিয়া নামের কিশোর। বড়লেখায় ৫ জানুয়ারি খুন হন হেলাল উদ্দিন (৫৫)। হবিগঞ্জের লোকড়ায় গানের অনুষ্ঠানে ১০ জানুয়ারি খুন হন বিআরটিসির বাস চালক আফজাল চৌধুরী (৩৮)। এরপর দিন গোয়াইনঘাটে খুন হন আলমাছ মিয়া। বিয়ানীবাজারে কুশিয়ারা নদীতে ২০ জানুয়ারি খুন হন আব্দুল হাসিব। জৈন্তাপুর উপজেলার উত্তর মহাইল গ্রামে ২৩ জানুয়ারি হতভাগ্য মা আয়নব বিবিকে (৬০) তার গর্ভের পুত্র আবুল হাসনাত হত্যা করে। দক্ষিণ সুরমা উপজেলার জালালপুরের হাসামপুরে ২৫ জানুয়ারি শিল্পী বেগম (২৬) নামের গৃহবধূ খুন হন। আজমিরীগঞ্জে ২৯ জানুয়ারি খুন হন লুৎফুর রহমান (৫৫)। সুনামগঞ্জ পৌরসভার পুরাতন স্ট্যান্ডে ৩০ জানুয়ারি সাইফুল ইসলাম নয়নকে (২২) হত্যা করা হয়। পরদিন কানাইঘাটে ফরিদ আহমদ (৩০) ও সুনামগঞ্জের মোল্লাপাড়ায় আমির হোসেন (৫৫) খুন হন।

ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে নবীগঞ্জের রসুলগঞ্জ বাজারে রাজনা বেগম (১৮) নামের গৃহবধূর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। দোয়ারাবাজারে মহিলাদের ঝগড়া থামাতে গিয়ে ৭ ফেব্রুয়ারি গোলেস্তা বেগম (৭৫) নিহত হন। সিলেট শহরতলীর শাহপরাণের নিপোবন এলাকায় পাষন্ড মায়ের হাতে শিশু কন্যা সাবিহা আক্তার খুন হন। জগন্নাথপুরে ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রবাসীর স্ত্রী শাহনাজ পারভিন জোৎস্মার গলাকাটা ৬ টুকরো লাশ উদ্ধার করা হয়। একই দিন ছাতকের চান্দরটিলা থেকে নিজান খানের (৩০) লাশ উদ্ধার করা হয়। পরদিন গোলাপগঞ্জে তারিক আহমদ (২৬) ও দক্ষিণ সুরমার কুচাইয়ে শাহাবুদ্দিন আহমদ সাবলুকে (৪৫) পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ওই দিন গোলাপগঞ্জে মুখে বিষ ঢেলে গৃহবধূ রোমানা আক্তার রিনিকে (৩০) হত্যা করা হয়। শান্তিগঞ্জের শত্রুমর্দন গ্রামে পুলিশের নির্যাতনে উজির মিয়া মারা যান। বিয়ানীবাজারের তাজপুরে মাদকাসক্ত পুত্র তার পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজকে (৭৫) হত্যা করে। সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার তেঘরিয়ায় ৬ মার্চ রিপা বেগম (৩০) খুন হন। জৈন্তাপুরে হাওর থেকে ৭ মার্চ দু’টি লাশ উদ্ধার করা হয়।

দোয়ারাবাজারের আমবাড়ি গ্রামে ১৫ মার্চ রিনা বেগম (৩৫) নিহত হন। শায়েস্তাগঞ্জের পূর্ব বাগুনীপাড়ায় ২১ মার্চ ঘুমন্ত অবস্থায় রিনা বেগম (৩৫) নামের গৃহবধূকে হত্যা করা হয়। কানাইঘাটে ২৫ মার্চ সাহেদ আহমদ (৩২) নিহত হন। হবিগঞ্জ সদরে ৩০ মার্চ ভাতিজার হাতে চাচা তোরাব আলী (৬০) খুন হন।

জৈন্তাপুরে ৪ এপ্রিল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে মাওলানা সালেহ আহমদ (২৫) খুন। সুনামগঞ্জ সদরে ৭ এপ্রিল খুন হন আলমগীর ভূঁইয়া (৩৫)। বড়লেখায় ৮ এপ্রিল রুবেল আহমদকে (২৮) পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ওসমানী হাসপাতাল এলাকায় ৯ এপ্রিল নাজিম উদ্দিন (১৯) খুন হন। জাফলংয়ে ১৪ এপ্রিল মাওলানা কাওসার আহমেদকে হত্যা করা হয়। একই দিন গোয়াইনঘাটে মোক্তার মিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়। বিশ্বনাথে ১৬ এপ্রিল খুন হন আব্দুল বাছিত (২৮)। জগন্নাথপুরের পাটকুরা এলাকায় ১৬ এপ্রিল ছন্দা রানী সরকার খুন হন। ছাতকের পীরপুরে ১৭ এপ্রিল জুনেদ মিয়া (১৮) খুন হন। জগন্নাথপুরে ২৩ এপ্রিল মাছুম মিয়া (২৫) খুন হন। শহরতলীর মীরমহল্লায় ২৪ এপ্রিল খুন হন আরমান হোসেন (২৪)। নগরীর উপশহরে ২৬ এপ্রিল খুন হন ব্যবসায়ী সেলিম মিয়া।

কোম্পানীগঞ্জের চাতলপাড়ে ২৭ এপ্রিল হামিদা বেগম (৪০) খুন হন। দিরাই’র লাউরানজি সেতুর পার্শ্ব থেকে ৫ মে ইকবাল হোসেনের (৩৬) ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। একই দিন দক্ষিণ সুরমার জালালপুরে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। কোম্পানীগঞ্জে ১৩ মে শাহ আলম (৩০) খুন হন।

জামালগঞ্জের চানবাড়ি গ্রামে ১৩ মে সুলেখা বেগম নিহত হন। শহরতলীর মইয়ারচরে ৩০ মে নাজমিন আক্তার খুন হন। বিশ্বনাথের পীরের বাজারে ৩ জুন খুন হন আওয়ামী লীগ নেতা কেধসধষ মো. গিয়াস উদ্দিন (৬২)।

গোয়াইনঘাটে ২৫ জুন অরেশ নমঃশূদ্র (৬৬) খুন হন। গোলাপগঞ্জের এখলাছপুরে ২৮ জুন ইটের আঘাতে বৃদ্ধা হাওয়ারুন বেগম (৬৫) নিহত হন। ফেঞ্চুগঞ্জে ৩০ জুন নিহত হন নজরুল ইসলাম সেলিম (৪৮)।

বানিয়াচংয়ে পহেলা জুলাই মামুন মিয়াকে (৩৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হবিগঞ্জের মাছুলিয়ায় ২ জুলাই কদর আলী (৪৮) নামের এক ব্যক্তির মাথাবিহীন লাশ উদ্ধার করা হয়। শান্তিগঞ্জের বীরগাঁওয়ে ৩ জুলাই খুন হন নাজিবুল ইসলাম (৪০)। মৌলভীবাজারে ৫ জুলাই হাত-পা বাঁধা অবস্থায় একটি লাশ উদ্ধার করা হয়। কানাইঘাটে ১৩ জুলাই নাজিম উদ্দিন খুন হন। গোয়াইনঘাটে ১৫ জুলাই হাসিনা বেগম (৫৫) খুন হন। মাধবপুরে ১৮ জুলাই নেভি আক্তার (৪০) খুন হন। জগন্নাথপুরে ১৯ জুলাই অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করা হয়। সুনামগঞ্জ আদালত চত্বরে ২১ জুলাই আসামিরা প্রকাশ্যে বাদী সুবল বিশ্বাসকে (৩৫) হত্যা করে। একই দিন কমলগঞ্জে খুন হন রতিরাম নায়েক (৪০)। এর দুদিন পর ২৩ জুলাই কমলগঞ্জে আদিবাসী শিক্ষক রঞ্জিত রাফায়েল মান্ডার (৩৭) ও গোলাপগঞ্জে মিসবাহ উদ্দিন (৫০) খুন হন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী গাজিকালুর টিলায় ২৫ জুলাই শাবির শিক্ষার্থী বুলবুল আহমদ খুন হন।

শান্তিগঞ্জের ঘোড়াডুম্বুরে ২৯ জুলাই মাসুমা বেগমকে (২০) হত্যা করা হয়। মধ্যনগরে ৩০ জুলাই রুজানি দাজেল (৪৫) নামের আরেক গৃহবধূকে হত্যা করা হয়।

চুনারুঘাটের সাতছড়ির গারোটিলায় ৫ আগস্ট সঞ্জিলা সাংমা (৬৫) খুন হন। কোম্পানীগঞ্জে ১১ আগস্ট জয়নাল আবেদীন (৬০) ও মুশাহিদ আলী (৬২) নামের দু’জনকে হত্যা করা হয়। পরদিন মাধবপুরে খুন হন সুমন মিয়া (৩২)। হবিগঞ্জ সদরে ১৭ আগস্ট শুকুর মিয়াকে (৪৫) হত্যা করা হয়। নগরীর বালুচরে ২৪ আগস্ট আফিয়া বেগমের (৩০) বিভৎস লাশ উদ্ধার করা হয়। শাল্লার প্রতাপপুরে ২০ আগস্ট কুশিয়ারা নদী থেকে অমর চান দাসের লাশ উদ্ধার করা হয়। সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের অদূরে ২৫ আগস্ট খুন হন এনজিও কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন (৫১)। কানাইঘাটে ৩১ আগস্ট নাজির আহমদ (১৮) নামের আরেক জনকে হত্যা করা হয়।

জকিগঞ্জে টানা ৫ দিন নিখোঁজ থাকার পরে ৯ সেপ্টেম্বর শিশু কন্যা শাম্মী আক্তারের (৭) বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই দিন রাজনগরে গৃহবধূ মিনা বেগম খুন হন। চুনারুঘাটে ১৬ সেপ্টেম্বর গৃহবধূ পলি আক্তারকে (৩০) জবাই করে হত্যা করা হয়। নিখোঁজের দুদিন পর ১৭ সেপ্টেম্বর নবীগঞ্জে বিবিয়ানা নদী থেকে উদ্ধার করা হয় লিটন মিয়ার (৪৮) ক্ষত-বিক্ষত লাশ । জগন্নাথপুরে ১৮ সেপ্টেম্বর আছিয়া বেগমকে (৫০) হত্যা করা হয়। রাজনগরে ২৩ সেপ্টেম্বও হেলাল মিয়া (৪০) ও কাজল মিয়া (২২) নামের সহোদর খুন হন। নগরীর সুবহানীঘাট এলাকায় ২৫ সেপ্টেম্বর তুষার মিয়া (২২) নামের এক হিজড়া খুন হন।

তাহিরপুরে ১ অক্টোবর খুন হন রহমত আলী (৫৫)। কোম্পানীগঞ্জে এক শতক জমি নিয়ে ৩ অক্টোবর নিজাম উদ্দিন মাস্টার খুন হন। পরদিন ছাতকে পরকীয়ার জের ধরে খুন হন প্রবাসী খালেদ নুর (৩২)। চুনারুঘাটে ৬ অক্টোবর এখলাস মিয়ার (২৭) ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। গোয়াইনঘাটে ১৩ অক্টোবর বিলাল উদ্দিনকে (২০) হত্যা করা হয়। বিশ্বনাথে ২৬ অক্টোবর খুন হন সাইফুল ইসলাম (২৮)। শাল্লায় ৩১ অক্টোবর মেয়ের প্রেমের খেসারত দিতে গিয়ে খুন হন জাহাঙ্গীর হোসেন (৫০)।

লাখাইয়ে ৪ নভেম্বর ইসহাক মিয়া (৭০) খুন হন। ওই দিন মাধবপুরে আতিকুল ইসলাম মিশুকে (১৭) হত্যা করা হয়। পরদিন কানাইঘাটে খুন হন মাসুম আহমদ (২২)। এর পরদিন নগরীর আম্বরখানার বড়বাজার সড়কে বিএনপি নেতা আ.ফ.ম কামালকে (৪৪) কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

কুলাউড়ায় ৭ নভেম্বর জয়নাল মিয়াকে (৬০) হত্যা করা হয়। কানাইঘাটে ৯ নভেম্বর রাশিদা বেগমের (২২) গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৭ নভেম্বর বানিয়াচংয়ে শিশু আকরাম খানের (৯) হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করা হয়। নবীগঞ্জের চরগাঁওয়ে ১৮ নভেম্বর নিজের বসতঘরে খুন হন তহুরা বেগম (৫৫)। জকিগঞ্জে ২০ নভেম্বর খুন হন মনসুর আহমেদ (১৪) ও কানাইঘাটে ২৯ নভেম্বর মঈন উদ্দিনকে (৩০) কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

ছাতকের কামারখালে ২ ডিসেম্বর আলেকা বেগমকে (৪০) হত্যা করা হয়। জৈন্তাপুরে ৪ ডিসেম্বও মোক্তার হোসেনের (৩৮) রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। জাফলংয়ে ১২ ডিসেম্বর উদ্ধার করা হয় এক মহিলার রক্তাক্ত লাশ। আর দিরাইয়ে বাড়ীর সীমানাকে কেন্দ্র করে ২০ ডিসেম্বর বৃদ্ধা আয়েশা বেগমকে (৭০) তার প্রতিবেশীরা কুপিয়ে হত্যা করে।
খুনোখুনির বর্ষচিত্র সম্পর্কে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আল আমিন উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

জানতে চাইলে তিনি আমাদের প্রতিনিধিকে বলেন, সমাজ ও পরিবার জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আর্থিক পরিবর্তনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও এসেছে। মানুষের সাথে মানুষের দূরত্ব সৃষ্টি, ভোগবাদীতে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। আগে আমাদেও যৌথ পরিবার ছিল, আমরা তখন সুখে-শান্তিতেই ছিলাম। আধুনিক সময়ে এসে মানুষ এখন আপেক্ষিক যন্ত্রণায় ভুগছেন। শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসার ঘাটতি, দ্বন্দ্ব-সন্দেহ ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবেগ-অনুভূতি কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে মানুষ। প্রযুক্তিগত সুবিধার কারণে নানা অপরাধে জড়াচ্ছে মানুষ। বেড়েছে হানাহানি। পিতা-পুত্র, ভাই- বোনের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। এসবই হতাশার বহিঃপ্রকাশ।

(একেআর/এসপি/জানুয়ারি ১০, ২০২৩)

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test