E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

ভৈরবে পুলিশের এসআই পরিচয়ে দানবীর সেজে গরীবের কোটি টাকা নিয়ে উধাও

২০২৩ ফেব্রুয়ারি ১১ ১৮:০৪:২৩
ভৈরবে পুলিশের এসআই পরিচয়ে দানবীর সেজে গরীবের কোটি টাকা নিয়ে উধাও

সোহেল সাশ্রু, কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জ ভৈরবে পুলিশের এসআই পরিচয়ে দাননবীর সেজে গরীবের কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছেন মোহাম্মদ মামুন (৪০) নামের এক ব্যক্তি। ঘটনাটি ঘটে ভৈরব পৌর শহরের কালিপুর গ্রামে। তার পরিচয় জানতে গেলে এলাকাবাসীর কেউ বলে পুলিশের এসআই, কেউ বলে সাংবাদিক, আবার কেউ কেউ কমিউনিটি পুলিশের সদস্য ও কেউ সরকারি কর্মকর্তা। তবে সত্যিকারের পরিচয় কেউ এখনো সনাক্ত করতে পারেনি। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কালিপুর গ্রামে গরীব অসহায় দুস্থদের অর্ধেক দামে চাল-ডাল দেওয়ার নামে কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছেন মামুন। ওই ব্যক্তি ১ হাজার ২০০ টাকায় এক বস্তা (৫০ কেজি) করে চাল দেবেন এবং ৬৫০ টাকায় তেল, ডাল, আলু, চিনি বাজারমূল্যের চেয়েও অর্ধেকের দামে বিক্রি করবেন বলে আনুমানিক ৫ হাজার মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন কয়েক কোটি টাকা। কম টাকায় পণ্য পাওয়ার আশায় টাকা দেয়া মানুষগুলো আজ অসহায় পাগলের মত হয়ে গেছে। কেউ করে হকারি, কেউ রিকশচালক, কেউ আচার বিক্রেতা আবার কেউ কেউ দিনমজুর। কেউ কেউ কিস্তিতে টাকা তুলেছেন চাউলের বস্তা নেয়ার জন্য। যারা টাকা দিয়েছেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ দিনে এনে দিনে খায়। গত একমাসে ভুক্তভোগীদের সবার কাছে থেকে নিজের ব্যবহৃত ভূয়া একাধিক ভিজিটিং কার্ড টুকেন হিসেবে ব্যবহার করে প্রায় কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়।

এলাকাবাসী জানান, কালিপুর উত্তর পাড়া ১২নং ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি নীল মিয়ার বাড়িতেই ভাড়ায় থাকেন মামুন। ভৈরব থানা পুলিশের সাথে তার ভাল সম্পর্কও রয়েছে। তার জনপ্রিয়তা প্রমান করতে পুলিশের ওপেন হাউজ ডের দিন তিনি অতিথি হয়েও প্রায় ১শ মানুষ নিয়ে হাজির হন থানায়। এই সম্পর্ক দেখেই সবাই ভাবতেন সে পুলিশের কাছের লোক। মাস খানেক আগে থেকেই এলাকার কিছু গরীব মানুষকে বিনামূল্যে চাল-ডাল দেন তিনি। করোনায় ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে কাউকে সাহায্য করতে পারেনি বলে সবাইকে জানায়। তাই বর্তমান নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারের কাছে থেকে সহায়তা এনে গ্রামের অসহায় গরীব দুস্থ্য মানুষদের অর্ধেক দামে চাউলের বস্তা, তেল, আলু, ডাল চিনি বিক্রির আশ্বাস দেন।

তিনি দানশীল হিসেবে নিজেকে সবার কাছে পরিচিতি করিয়ে নেন আগে থেকেই। এই সুযোগে তিনি দুটি প্যাকেজ ঘোষণা করেন। একটি প্যাকেজে ১ হাজার ২০০ টাকায় এক বস্তা চাল ও অন্য প্যাকেজে ৬৫০ টাকায় তেল, ডাল, চিনি ও আলু দিবেন। এই বিষয়টি মামুন এলাকায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা মন্ত্রণালয় থেকে তার কাছে অনুদান আসছে বলে বিভিন্নভাবে প্রচার করেন। গরীব মানুষকে তিনি ওই অনুদান থেকে সাহায্য করছেন। তার এই কাজে স্থানীয় কয়েকজন সহযোগী ছিলেন। তবে সহযোগীদেরকে তিনি ১২শ টাকায় চালের বস্তাও দিতেন।

অল্প মূল্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর প্রতিদিন শত শত মানুষ মামুনের বাড়িতে ভিড় করতে শুরু করেন। ভৈরব পৌর শহরের পলতাকান্দা, চণ্ডিবের, উপজেলার চানঁপুর, রাজনগর, আগানগর, গকুল নগরসহ আশে-পাশের গ্রামগুলো থেকে মানুষ এসে ভিড় করতো তার বাড়িতে। শুরুতে এলাকায় ও এলাকার বাইরের কিছু মানুষের কাছে ঘোষিত মূল্যে তাদের হাতে খাদ্যপণ্য তুলেও দেন। এই খবর আরও ছড়িয়ে পড়লে অধিক লাভের আশায় কেউ কেউ ১৫ থেকে ২০ বস্তা চালের টাকাও জমা দিয়ে যান। টাকাপ্রাপ্তির বিপরীতে পণ্য প্রদানের জন্য বিভিন্ন তারিখ ও সময় লিখে নিজের একাধিক ধরনের ভিজিটিং কার্ড বিতরণ করেন মামুন। তারিখ অনুযায়ী চাউলে বস্তা আনতে গেলে গত শুক্রবার ৩ ফেব্রুয়ারি ঘর তালাবদ্ধ করে পালিয়ে গেলে আর ফিরে আসেনি। এখনো তিনি পলাতক রয়েছেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কালিপুর এলাকায় যে বাসায় তিনি থাকতেন সেই বাসার দরজায় তালা ঝুলছে। এ সময় দেখা যায় বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন রতন নামের এক ব্যক্তি। তিনি ওই এলাকারই বাসিন্দা। তিনি বলেন মামুন ১২শ টাকায় চালের বস্তা দিবেন বলে তার কাছে থেকে ৬টি কার্ডের ৭ হাজার দুইশ টাকা নেন। তিনি আরো বলেন, শুনেছি তিনি চাউল আনতে গেছে। কেউ কেউ বলাবলি করছে পালিয়ে গেছে। ভাবছি যদি তিনি ফিরে আসে আমার চাউল না পাই তবে টাকাতো পাবো।

বাসার মালিক যুবলীগ নেতা নীল মিয়া বলেন, এক বছরে আগে মামুন আমার কাছ থেকে জমি কিনেন। দুতলা বিল্ডিং নির্মাণ চলাকালন সেই জায়গা তিন মাসের মধ্যেই আমার কাছে পুণরায় বিক্রি করে দেয়। তিনি এখনো তার বাসার ভাড়াটিয়ে হিসেবে রয়েছেন। প্রায় দুই বছর ধরে ভৈরবে তার আসা যাওয়া। সাত মাস আগে উপজেলার চাঁনপুর গ্রামে বিয়ে করে মামুন। এলাকায় তিনি নিজেকে কখনো সাংবাদিক, কখনো কমিউনিটি পুলিশের সদস্য পরিচয় দিতেন। ৩ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সকালে কাজের মেয়ের কাছে চাবি দিয়ে চাল আনতে যাচ্ছেন বলে বের হন মামুন। এরপর আর ফেরেননি।

পলতাকান্দা এলাকার বাসিন্দা আচার বিক্রেতা নুরু মিয়া বলেন, মানুষের কাছে শুনেছি অর্ধেক দামে চাল-ডাল দিচ্ছেন কালিপুরের এক ব্যক্তি। গত ২৫ জানুয়ারি দুই বস্তা চাউলের জন্য ২৪শ টাকা দেয় কিন্তু এখনো চাউল পায়নি। লোকমুখে শুনছি তিনি নাকি পালিয়েছেন। এখন আমাদের কী হবে, কার কাছে বিচার চাইবো?

শুটকি বিক্রেতা মুক্তা রাণী দাস বলেন, রাস্তায় বসে শুটকি বিক্রি করি। বাজারে যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে সেজন্যই কম দামের চাউলের বস্তা পাবার আশায় কিস্তিতে টাকা তুলে চাউলের বস্তার টাকা দিয়েছিলাম। তিনি নাকি পালিয়ে গেছেন এখন আমি চাউল পাবো কই কিস্তি দেবো কিভাবে।

একই এলাকার গোলাপী, লোজী, মিনা, শারমিন, মঞ্জু, রিমা সবার মুখে একই কথা, অন্যদের দেখাদেখি মামুনের বাড়িতে গিয়েছিলাম। টাকাও দিয়েছি। কিন্তু এখন তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। নিজেদের টাকা ফিরে পাওয়া নিয়ে এখন শঙ্কায় আছি।

চণ্ডিবের এলাকার বকুল বেগম, রুবিনা বেগম, শরীফ মিয়া, নাজমা, হুসনা বেগম বলেন, মামুনকে তারা পুলিশের এসআই হিসেবে চেনেন। অর্ধেক দামে চাল-ডাল পাবে সেই আশায় টাকা জমা দেয় তারা। ভিজিটিং কার্ডে তারিখ অনুযায়ী ৫ ফেব্রুয়ারি চালের বস্তা দেওয়ার কথা ছিল। নির্ধারিত দিনে চাল আনতে গিয়ে জানতে পারেন এক সপ্তাহ আগেই মামুন নামের ওই ব্যক্তি এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন।

এ বিষয়ে স্থানীয় মেম্বার ইব্রাহীম মিয়া বলেন, মামুন ভৈরবের স্থায়ী বাসিন্দা নন। দুয়েক বছর যাবত এই এলাকায় বসবাস করছে। তার চাল বিতরণের বিষয়টি আমার সন্দেহ হলে আমি প্রতিবাদ করি। এলাকার কিছু মানুষ চাউল পেয়ে আমার সাথে বিরোধীতা করে। আমি বিষয়টি পৌর মেয়র ও ভৈরব থানা পুলিশকে অবগত করেছি। কিন্তু পুলিশ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

এ বিষয়ে ভৈরব পৌর মেয়র আলহাজ্ব মো. ইফতেখার হোসেন বেনু বলেন, গত ২৯ জানুয়ারি জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ রাসেল শেখ এক মতবিনিময় সভায় ভৈরবে আসেন। সেখানে মামুন দলবল নিয়ে থানা চত্বরে উপস্থিত হন। সভায় মামুনের বিষয়টি এসপির নজরে এনে প্রতারিত হওয়ার শঙ্কার কথা বলেছিলাম। আমি যথাসময়ে সতর্ক করেছি। কিন্তু কেউ সতর্ক হয়নি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে।

ভৈরব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মাকছুদুল আলম জানান, বিষয়টি আমি মৌখিকভাবে শুনেছি আমার কাছে যারা বলেছে তাদেরকে বলেছি যেন কোন প্রতারকের কাছে টাকা দেয়া না হয়। তবে এখন পর্যন্ত কারো কাছ থেকে কোন লিখিত অভিযোগ পাইনি। যদি কেউ লিখিত অভিযোগ করে তাহলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে তিনি জানান।

(এস/এসপি/ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৩)

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test