E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

স্থানীয় পর্যটক বেশি, দূরের পর্যটক কম, হতাশ রিসোর্ট মালিকরা 

২০২৩ এপ্রিল ২৮ ১৭:০৫:৩৮
স্থানীয় পর্যটক বেশি, দূরের পর্যটক কম, হতাশ রিসোর্ট মালিকরা 

মোঃ আব্দুল কাইয়ুম, মৌলভীবাজার : এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি হাকালুকি, কাওয়াদিঘি, হাইলহাওরসহ ছোট-বড় মিলিয়ে তিনটি বৃহৎ হাওর, উঁচুউঁচু টিলা, আঁকাবাঁকা পাহাড়ী মেঠোপথ, ৯২টি চা বাগান নিয়ে গড়ে উঠা ঐতিহ্যবাহী চা শিল্প, প্রাচীণকাল থেকে সবুজ বন কেন্দ্রিক গড়ে উঠা আধিবাসী সম্প্রদায়ে বিচিত্র সংস্কৃতি আর সমৃদ্ধ বনাঞ্চল আর নৈসর্গিক সৌন্দর্য ঘিরেই তৈরি হয়েছে মৌলভীবাজার জেলার পর্যটন শিল্প। দেশ-বিদেশের ভ্রমণ পিপাষুদের কাছে এর সুনাম, ইতহাস, ঐতিহ্য আর পরিচিতি এখন বিশ্বময়। পুরো বছরই এসব দেখতে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ছৃুটে আসেন। তবে জেলার পর্যটন স্পট গুলোতে সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসেন ঈদের ছুটি ও শীতকালে। এবারের ঈদুল ফিতরের টানা ছুটিতেও ব্যাপক পর্যটক এসেছেন। অবশ্য ঈদের আগে থেকে পর্যটক আসার সম্ভানা তৈরি হলে জেলার পর্যটন স্পটগুলোও পর্যটক বরণে প্রস্তুত হতে থাকে। জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ১২৫০ হেক্টর আয়তনের জীববৈচিত্র ও বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণী সমৃদ্ধ অরণ্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, ভারত সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ, নয়নাভিরাম মাধবপুর লেক, রোমাঞ্চে ভরা হামহাম জলপ্রপাত, শ্রীমঙ্গলের মহান স্বাধীনতার স্মৃতি বিজরিত বদ্ধভুমি, কালাপুর ইউনিয়নের বাইক্কাবিল ও বড়লেখা উপজেলার মাধবকু- জলপ্রপাতের অপার সৌন্দর্য একপলক দেখতে ছুটে আসেন পর্যটকরা। এর বাহিরে জেলার প্রতিটি চাবাগানের মনোরম সৌন্দর্য দেখতে দেশের বিভিন প্রান্ত থেকে প্রচুর পরিমাণ পর্যটক আগমন ঘটে। এবারের ঈদে সবচেয়ে বেশি পর্যটক এসেছেন মৌলভীবাজারসহ আশপাশের জেলা থেকে। এসব স্পটে বিদেশী পর্যটকদের দেখা মেলেনি খুব একটা। খুব অল্প সংখ্যক বিদেশী পর্যটক এসেছেন বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র। বেশিরভাগই স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তরুণ-তরুণী। এর বাহিরে পরিবার নিয়েও অনেকে এসেছেন ঘুরতে। 

ঈদে রেকর্ড সংখ্যক পর্যটক এসেছেন কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। পর্যটক বেশি আসায় একদিকে যেমন সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ছে, অপরদিকে অনেক পর্যটকদের সচেতনতার অভাবে চিৎকার-চ্যাঁচামেচি বা উচ্চস্বরে কথা বলা এবং বনের ভিতরে খাদ্যদ্রব্যের উচ্ছিষ্ট অংশ যত্রতত্র ফেলে দেয়ায় তাঁর প্রভাবও পড়ছে বন্যপ্রাণী ও বনের পরিবেশের উপর।

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা থেকে পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছেন শাওন বসাক। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সহকারী প্রকৌশলী পদ মর্যাদার এই কর্মকর্তার সাথে লাউয়াছড়া উদ্যানে দেখা হয়। এসময় তিনি বলেন, ট্রেনে যাতায়াতের সময় সমৃদ্ধ এই বনের নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখতে পারলেও সরাসরি এই প্রথম দেখতে এসেছি। এখানে পৃথিবীর বিলুপ্ত অনেক উদ্ভিদ রয়েছে।

ওই উদ্যানের টিকিট কাউন্টার থেকে ঈদ পরবর্তী এক সাপ্তাহের প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ঈদের দিন লাউয়াছড়া দেখতে আসেন সাড়ে তিন হাজার পর্যটক। এতে একদিনেই রাজস্ব আয় হয় ১ লাখ ৬৮ হাজার ১ শত ৩৩ টাকা। পরের দিন রোববার এসেছেন ২ হাজার ৪শত ৭৬ জন পর্যটক। রাজস্ব আদায় হয় ১ লাখ ২০হাজার ৩শত ৭১টাকা। তৃতীয় দিন সোমবার ২৪ এপ্রিল এসেছেন ২ হাজার ১শত ২০ জন পর্যটক, রাজস্ব আয় হয় ১ লাখ ৭ হাজার ৫৯ টাকা। ২৫ এপ্রিল রাজস্ব আয় হয় ৯৩ হাজার ৭শত টাকা। ২৬ এপ্রিল এসছেন ১ হাজার ৮শত ১৯ জন পর্যটক, রাজস্ব আয় হয় ৮০ হাজার ৬শত ৬ টাকা ও সর্বশেষ ২৭ এপ্রিল এসেছেন ১ হাজার ৪শত ৮ জন পর্যটক, রাজস্ব আয় হয় ৬৫ হাজার ৭শত ২৯ টাকা। সব মিলিয়ে ঈদ পরবর্তী ৬ দিনে এই বন ঘুরে গেছেন রেকর্ড সংখ্যক পর্যটক। যা থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয়েছে সর্বমোট ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৫শত ৯৮ টাকা। এদিকে ঈদের ছুটি শেষ হলেও কাটেনি আমেজ। জেলার পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে এখনো আসছেন পর্যটকরা।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের লাউয়াছড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম জানান, লাউয়াছড়ার ইতিহাসে এই ঈদে সবচেয়ে বেশি পর্যটক এসেছেন। পর্যটক বেশি হওয়ায় বনের পরিবেশের উপর প্রভাব পড়ছে বলেও স্বীকার করেন তিনি। তিনি বলেন, পর্যটক সংখা বেশি হলেও তা নিয়ন্ত্রণে কোন বাধ্যবাধকতা না থাকায় আমাদের কিছু করার নেই।

শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালাপুর ইউনিয়নে অবস্থিত প্রকৃতির আরেক লীলাভুমি বাইক্কা বিলেও বেড়েছে পর্যটকের সংখ্যা। সেখানকার বড়গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিন্নত আলী জানান, শীত চলে যাওয়ায় নেই অথিতি পাখি, তবুও এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ঈদের পর কয়েকহাজার পর্যটক এসেছেন।

পর্যটকের ঢল নেমেছে জেলার সীমান্তবর্তী বড়লেখা উপজেলার মাধবকু- জলপ্রপাতেও। বনবিভাগের বড়লেখা রেঞ্জ কর্মকর্তা শেখর রঞ্জণ দাস বলেন, এবার মাধবকু- জলপ্রপাত দেখতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে রেকর্ড পরিমাণ পর্যটক এসেছেন। যা অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি। তবে বিদেশী পর্যটকের দেখা খুব একটা মিলেনি।

এ দিকে ২০২০-২১ অর্থ বছরে প্রাণঘাতী করোনার কারনে স্থবির হয়ে পড়া জেলার পর্যটন শিল্পের উপর দিয়ে যে পরিমাণ ঝড় বয়ে গেছে, তার প্রভাব এখনো বিদ্যমান বলে দাবী সংশ্লিষ্টদের। এখাতের বেশিরভাগ বেসরকারী পর্যায়ের উদ্যেক্তাদের কারণে এ শিল্প দিনদিন বিকশিত হলেও এখনো পুরোদমে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি প্রবাসী অধ্যুসিত পর্যটন জেলা মৌলভীবাজারের সম্ভানাময় এই শিল্প। তবুও আগামীর দিনগুলোতে যদি বড় ধরনের কোন দুর্যোগ না আসে তাহলে সম্ভব হবে ঘুরে দাঁড়ানো এমন প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।

জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম বলেন, পর্যটন শিল্প থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয়, তাই আমি সবাইকে নিয়ে বসে মৌলভীবাজারের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে দ্রুত উদ্যেগ নেবো। বিশেষ করে এই জেলার পর্যটন শিল্পকে ডিজিটালাইজেশন করা হবে। যাতে দূরের পর্যটকরা এখানকার সবগুলো পর্যটন স্পটের ভাড়া, যাতায়াত, সেবার মানসহ সব তথ্য ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সহজে পায়।

পর্যটন সেবা সংস্থার সভাপতি সেলিম আহমেদ জানান, শ্রীসঙ্গল-কমলগঞ্জে পাঁচ তারকা মানের হোটেলসহ ছোট বড় মিলিয়ে সর্বমোট ৭০টি রিসোর্ট রয়েছে। ঈদকে সামনে পর্যটক আগমনের প্রত্যাশায় এই খাতের ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসাকে নতুন করে ঢেলে সাজালেও প্রত্যাশানুযায়ী পর্যটক না আসায় লোকসানের মুখে ব্যবসায়ীরা। তিনি বলেন, স্থানীয় ও আশপাশের জেলা থেকে পর্যটক আগমন বেশি হলেও ঢাকাসহ বাহিরের জেলা থেকে খুব একটা আসেননি পর্যটকরা। এর কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, পর্যটন খাতের নতুনত্ব না থাকা, একই জিনিস বারবার ঘুরে দেখা পছন্দ করেন না পর্যটকরা। এছাড়া বৈশ্বিক মন্দা ও অতিরিক্ত গরমও এর কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

লাউয়াছড়া ইকো টুরিস্ট গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সাধারণ সম্পাদক মো. আহাদ মিয়া বলেন, এখানে ঘুরতে আসা শহরের মানুষগুলোর বেশিরভাগেরই পছন্দ ছন,বাঁশ ও মাটির তৈরি পাহাড়-পল্লিতে প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে উঠা ইকো কটেজগুলো। তবে পর্যটন শিল্পের কাঙ্খিত উন্নয়ন না হওয়ায় দূরের পর্যটক দিন দিন কমছে।

(একে/এসপি/এপ্রিল ২৮, ২০২৩)

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test