E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সক্রিয় ভূমিদস্যু চক্র, বেহাত হচ্ছে সরকারি জমি

২০২৩ মে ০২ ১৮:২৭:৪৬
সক্রিয় ভূমিদস্যু চক্র, বেহাত হচ্ছে সরকারি জমি

রাজন্য রুহানি, জামালপুর : জামালপুর সদর উপজেলার বাঁশচড়া ইউনিয়নের জিগাতলা মৌজার খাস খতিয়ানের জমি অবৈধভাবে বিক্রি ও হস্তান্তর করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি ভূমিদস্যু চক্র। ১শ টাকার স্ট্যাম্পের মাধ্যমে খাস জমি কিনে নিয়ে সেই জমি আবার অবৈধভাবে অন্যত্র বিক্রি বা হস্তান্তর করছে ওই চক্রটি।

সরকারের খাস জমি বিক্রি ও হস্তান্তর সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় ভূমি অফিস ও প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় খাস জমি কেনাবেচার পসরা সাজিয়ে বসেছে।

জামালপুর সদর উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, বাঁশচড়া ইউনিয়নের জিগাতলা মৌজায় খাস জমি রয়েছে প্রায় ৪৬ একর। এর মধ্যে প্রায় ২৫ একর জমি ভূমিহীন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে দীর্ঘমেয়াদী বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। বাকি খাস জমি স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের দখলে রয়েছে। এসব খাস জমি কেনাবেচাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে স্থানীয় ওই ভূমিদস্যু চক্রটি।

ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কর্মকর্তা, ইউপি চেয়ারম্যান, স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার ও প্রভাবশালী অসাধু ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা ও যোগসাজশে চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে খাস জমি বিক্রি ও হস্তান্তর করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। খাস জমি কেনাবেচার মূলহোতাদের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন কোন প্রকার আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় দিনদিন ভূমিদস্যু চক্রটি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

সরেজমিন অনুসন্ধান করে জানা গেছে, বাঁশচড়া ইউনিয়নের জিগাতলা মৌজার খাস জমি কেনাবেচার মূলহোতা হচ্ছেন জিগাতলা টেঙ্গর গ্রামের মৃত উমর আলী আকন্দের ছেলে মো. নুরুল ইসলাম আকন্দ। ভূমিদস্যু চক্রের অন্য সদস্যরা হলেন হরিপুর গ্রামের শাহজাহান আলী আকন্দ, জিগাতলা টেঙ্গর গ্রামের সাহেব আলী সরকার, আব্দুল গফুর, বিজিবি থেকে চাকরিচ্যুত মোক্তার হোসেন নামের এক ব্যক্তি এবং স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার খোশ মাহমুদ।

এই ভূমিদস্যু চক্রের সাথে বাঁশচড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল এবং ইউনিয়ন ভূমি অফিসার মো. সুরুজ্জামানের রয়েছে বিশেষ সখ্য ও ঘনিষ্ঠতা। খাস জমি বিক্রি ও হস্তান্তরের অভিযোগ পাওয়া গেলে তাদেরকে মোটা অঙ্কের উৎকোচ দিয়ে সব কিছু ম্যানেজড করে ফেলে ভূমিদস্যুরা।

সম্প্রতি জিগাতলা টেঙ্গর গ্রামের বাসিন্দা ভূমিদস্যু চক্রের অন্যতম সদস্য মো. নুরুল ইসলাম আকন্দ বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিম ও তাঁর স্ত্রী ফিরোজা বেগমের নামে বন্দোবস্তকৃত বিআরএস ৮১৯ নং দাগের ৬৬ শতাংশ জমি ১০০ টাকার তিনটি স্ট্যাম্পের মাধ্যমে পাঁচ লাখ ৫০ হাজার টাকায় জনৈক হায়দার আলীর কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন। পরে সেই জমি দখল করে খন্ড খন্ড প্লট বানিয়ে অন্যত্র বিক্রি ও হস্তান্তর করা শুরু করেন মো. নুরুল ইসলাম আকন্দ। ইতোমধ্যে ওই জমি থেকে পাঁচ শতাংশের একটি প্লট পাঁচ লাখ টাকায় হরিপুর গ্রামের জনৈক মোফাজ্জল হোসেন নামে এক ব্যক্তির কাছে পজিশন হস্তান্তর করেন। উল্লেখ থাকে যে, ওই জমিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিমের একটি চৌচালা টিনের ঘর ও একটি সাফমার্চবল পানির পাম্প এবং প্রায় পাঁচ লাখ টাকার বিভিন্ন জাতের মূল্যবান গাছ রয়েছে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিম অসুস্থ থাকায় তাঁর নিযুক্ত একজন আমমোক্তার বাদী হয়ে অতিরিক্তি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪/১৪৫ ধারায় জমি পুনরুদ্ধারের জন্য একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ১০৯/২২। আমমোক্তার গ্রহীতার আবেদনের প্রেক্ষিতে ওই জমিতে আদালত জামালপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে রিসিভার নিযুক্ত করেন। তদুপরি মো. নুরুল ইসলাম আকন্দ প্রভাব খাটিয়ে রিসিভারকেই বেদখল করে রাখেন। সদর থানার পুলিশ তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে পারে নি। উপরন্তু পুলিশ ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসারের প্রতিবেদন দাখিলের পর চূড়ান্ত শুনানি শেষে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ‘অত্র আদালতে মামলা পরিচালনার কোন যৌক্তিকতা নেই’ উল্লেখ করে মামলাটি খারিজ করে দেন। এই আদেশের ফলে প্রকারান্তরে অবৈধ দখলদার হিসাবে মো. নুরুল ইসলাম আকন্দই খাস জমির তথাকথিত মালিক বনে গেছেন।

সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. বরকতউল্লাহ’র সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘কবুলিয়তের শর্ত ভঙ্গ হওয়ায় বিজ্ঞ অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যেহেতু দখলকৃত জমি খাস জমি সে কারণে ওই জমিতে সরকারের দখল নিশ্চিত করার আদশ দিয়েছেন।’

জানা গেছে, সহকারী কমিশনার (ভূমি) আদালতের আদেশ মোতাবেক বাঁশচড়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসারকে ওই জমি থেকে অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করে সরকারের দখল নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। আদালতের আদেশ এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর নির্দেশ হাতে পাওয়ার পরও দুই মাসের অধিক সময় অতিবাহিত হলেও বাঁশচড়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসার কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন নি। উপরন্তু ইউনিয়ন ভূমি অফিসারের সহায়তায় মোফাজ্জল হোসেন ওই জমি মো. নুরুল ইসলাম আকন্দর কাছ থেকে কিনে নিয়ে বহাল তবিয়তেই বসবাস করে আসছেন।

কিসের মালিকানার ভিত্তিতে খাস জমি বেদখল করে আছেন জানতে চাইলে মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘আমি দুই লাখ টাকা বায়না দিয়ে মো. নুরুল ইসলাম আকন্দর কাছ থেকে এই জমি কিনছি।’

জনৈক হায়দার আলী এই জমি ১০০ টাকার তিনটি স্ট্যাম্পের মাধ্যমে পাঁচ লাখ ৫০ হাজার টাকায় মো. নুরুল ইসলাম আকন্দর কাছে বিআরএস ৮১৯ নং দাগের ৬৬ শতাংশ জমির পজিশন হস্তান্তর করেছেন। হায়দার আলী কিভাবে এই জমি প্রাপ্ত হলেন তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘লিজের মালিক আব্দুল হালিম ও ফিরোজা বেগম ১৫০ টাকার স্ট্যাম্পের মাধ্যমে জনৈক জিন্নত আলী তোতা এবং আমার কাছে এই জমির মালিকানা হস্তান্তর করেছেন।’

মো. নুরুল ইসলাম আকন্দ এই জমির মালিক কিনা জানতে চেয়ে কাগজপত্র দেখাতে বললে তা দেখাতে তিনি অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিমের জ্যেষ্ঠ কন্যা মোছা. আকলিমা বেগম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার বাবা-মা কেউই লিজকৃত জমির কবুলিয়তের শর্ত ভঙ্গ করেন নি। তাঁরা কারো কাছে এই জমি বিক্রি বা হস্তান্তর করেন নি। বরং এই জমি রক্ষণাবেক্ষণ ও আইনি সহায়তা প্রদানের জন্য জেলা প্রশাসকের অনুমতি সাপেক্ষে একজনকে শুধুমাত্র আমমোক্তার নিযুক্ত করা হয়েছে।

আকলিমা বেগম আরও বলেন, ‘লিজকৃত জমির কবুলিয়ত বাতিল না হওয়া পর্যন্ত এই জমির মালিক আমার বাবা-মা আব্দুল হালিম ও ফিরোজা বেগম। তাঁদর সন্তান হিসাবে আমরাই এই জমিতে উত্তরাধিকার সূত্রে ভোগদখল করার অধিকার রাখি।’

বাঁশচড়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসার মো. সুরুজ্জামান বলেন, ‘আদালত থেকে এই জমিতে সরকারের দখল নিশ্চিত করার আদেশ পেয়েছি।’

কি ব্যবস্থা নিয়েছেন জানতে চাইলে মো. সুরুজ্জামান কোন সদুত্তর দিতে পারেন নি।

খাস জমি কেনাবেচার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার খোশ মাহমুদ বলেন, ‘কেউতো আর রজিস্ট্রি দলিল করে খাস জমি হস্তান্তর করতে পারে না। মৌখিকভাবে দখল হস্তান্তর করা হয় এটা সত্য। ভূমি অফিস ব্যবস্থা না নিলে আমি কি করবো।’

খাস জমি ১০০ টাকার স্ট্যাম্পের মাধ্যম বিক্রি বা হস্তান্তর করা যায় কিনা জানতে চাইলে জামালপুর সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার লিটুস লরেন্স চিরান বলেন, ‘লিজ নেওয়া জমি কেউ বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারবেন না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কাছে কেউ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

সরকারের খাস জমি বিক্রি বা হস্তান্তরর করলে কি ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক শ্রাবস্তী রায় বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে শাস্তি দেওয়ার বিধান আছে।’

লিজগ্রহীতার কবুলিয়ত বাতিল করা ছাড়া তাকে কি জমির ভোগদখল থেকে বঞ্চিত করা যায় কিনা এই বিষয় জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘কবুলিয়ত যার জমি তার। লিজগ্রহীতা এবং তাদের উত্তরাধিকার ছাড়া অন্য কউ এই লিজের জমি ভোগদখল করতে পারবেন না। তারা এই জমি বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারবেন না। এটাই কবুলিয়তের অন্যতম শর্ত।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিমের জমিই নয় একই মৌজায় আরেক জন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মোতালেব মন্ডলের বন্দোবস্তকৃত জমিও বেদখল করে অন্যত্র হস্তান্তর করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, আব্দুল মোতালেব মন্ডলের বিআরএস ৯১৯ নং দাগের ৩০ শতাংশ জমি ছয় লাখ টাকায় হস্তান্তর করা হয়েছে ঘোড়াধাপ ইউনিয়নের ইদিলপুর গ্রামের জনৈক মো. হারুনের নিকট। ওই জমিতে টিনের ঘর তুলে বসাবাস করে আসছেন হারুন এবং তাঁর পরিবার। সরকারের খাস জমি দখল করার পর দখলদাররা বনে যান ভূমিহীন দিনমজুর। আব্দুল মোতালব মন্ডলের জমি থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য নথি প্রস্তত করা হলেও এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

জিগাতলা মৌজা ছাড়াও বাঁশচড়া ইউনিয়নের বৈঠামারি মৌজাতেও সরকারের কয়েক শত একর খাস জমি বেহাত হয়ে গেছে। এই ইউনিয়নে বন বিভাগেরও শত শত একর জমি রয়েছে।

(আরআর/এসপি/মে ০২, ২০২৩)

পাঠকের মতামত:

৩০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test