E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বগুড়ায় প্রধান ডাকঘরে ডাকাতি ও খুনের ঘটনার মূল আসামী গ্রেফতার

২০২৩ মে ০৫ ১৬:১৫:২৯
বগুড়ায় প্রধান ডাকঘরে ডাকাতি ও খুনের ঘটনার মূল আসামী গ্রেফতার

এটিএম রাশেদুল ইসলাম, বগুড়া : বগুড়ায় প্রধান ডাকঘরে অফিস সহায়ক প্রশান্ত কুমার আচার্য খুন এবং চাঞ্চল্যকর ডাকাতি ঘটনার মূল আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বুধবার দিনব্যাপী অভিযান চালিয়ে নওগাঁর সাপাহারের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঘটনায় সরাসরি জড়িত একমাত্র আসামী মোঃ শফিকুল ইসলাম (৪০) নওগাঁ জেলার পশ্চিম করমডাঙ্গার সাপাহার এলাকার মৃত আব্দুস সালাম ও কেতামন-এর সন্তান। গ্রেফতারের সময় আসামীর হেফাজত হতে বিভিন্ন আলামত উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত আলামতগুলোর মধ্যে ডাকাতির জন্য কেনা ইলেকট্রিক কাটার মেশিনের কভার বক্সের কিউআর কোডের সূত্রেই পুলিশ আসামীকে শনাক্ত করে।

গত ২৪ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বগুড়া প্রধান ডাকঘরে রাত আনুমানিক তিনটায় পাহাড়ারত অফিস সহায়ক প্রশান্ত কুমার আচার্য (৪৩) কে হত্যা ও ডাকঘরের ভল্ট কেটে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। হত্যা ও ডাকাতির বিষয়ে বগুড়া সদর থানায় মামলা দায়ের হলে সদর থানা পুলিশের তদন্তের পাশাপাশি বগুড়া জেলা পুলিশ সুপারের নির্দেশে বগুড়া ডিবির একটি টিম তাৎক্ষণিক ছায়া তদন্তে নামে। বগুড়া ডিবি এবং সদর থানার একটি যৌথ টিম নিখুঁত গোয়েন্দা তথ্য ও ডিজিটাল ফুট প্রিন্টের ভিত্তিতে বুধবার (৩ মে ২০২৩) নওগাঁ জেলার সাপাহার হতে বগুড়া'র প্রধান ডাকঘরে চাঞ্চল্যকর ডাকাতি ও ডাকঘরে পাহারারত অফিস সহায়ক প্রশান্ত কুমার আচার্য্যকে খুনের ঘটনায় সরাসরি জড়িত একমাত্র আসামীকে গ্রেফতার করে ঘটনার মূল রহস্য উদ্ঘাটন করা হয়।
বৃহস্পতিবার (০৪ মে ২০২৩) নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী।

পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত আসামী জানায় দীর্ঘদিন যাবৎ তিনি দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, দোকনপাটে চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি করে আসছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় আনুমানিক গত ১২মার্চ ২০২৩ তারিখে শার্ট বানানোর জন্য লাল রংয়ের ফেজার মোটরসাইকেল যোগে নওগাঁ হতে বগুড়া আসে। প্রধান ডাকঘরের সামনে মোটরসাইকেল পার্কিং করে রাখার সময় সে দেখতে পায় লোকজন প্রধান ডাকঘর থেকে টাকা তুলে বের হচ্ছে, তখন ডাকঘরের ভল্ট কেটে টাকা লুন্ঠনের পরিকল্পনা তার মাথায় আসে। তারপর সে ডাকঘরের ভিতরে যায় এবং ভোল্ট রুম ও সিসি ক্যামেরার অবস্থানসহ সামগ্রিক বিষয় রেকি করে প্রাথমিক ধারণা নিয়ে নেয়। এরপর গত ১৫ মার্চ ২০২৩ তারিখে পুনরায় বগুড়ায় এসে নিউমার্কেট এলাকা হতে হ্যান্ড গ্লাভস, সাতমাথা ফুটপাত থেকে ট্রাউজার, গেঞ্জি, থানার পেছনের বাবু মেশিনারিজ হার্ডওয়্যারের দোকান থেকে গ্রিল/ভোল্ট কাটার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং ভাংড়িপট্টির একটি দোকান থেকে এসএস পাইপের একটি খন্ড ক্রয় করে। উক্ত যন্ত্রপাতি কেনার সময় তার কাছে টাকা কম থাকায় ক্রয়কৃত মালামাল দোকানে প্যাকেট করে রেখে সে তিনমাথা ইসলামি ব্যাংক বুথ থেকে ১৫,০০০/-(পনেরো হাজার) টাকা উত্তোলন করে নিয়ে এসে তার ক্রয়কৃত মালামাল নিয়ে নওগাঁ জেলার সাপাহারে নিজ গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। এরপর তার পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে সে ২০ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে রাত আনুমানিক দশটার সময় বগুড়ায় আসে।

সারারাত ঘোরাফেরা করে ২১ এপ্রিল ২০২৩ তারিখ রাত্রী ২/৩ টার দিকে উত্তর-পূর্ব কোনার চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে ডাকঘরের ওয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করে ডাকঘরের মসজিদ ও গ্যারেজের পিছনে এক কোণায় অপেক্ষা করতে থাকে। পরে সকাল আনুমান ৬/৭ টার দিকে ডাকঘরের গার্ড প্রস্রাব করতে গেলে সেই সুযোগে যন্ত্রপাতির ব্যাগসহ চুপিসারে কেঁচিগেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে দোতলায় গিয়ে ছাদের গেটের কোনায় সিঁড়িঘরে লুকিয়ে থাকে। সেখানে বসে কয়েকটি লাল ব্যানসন সিগারেট খায়। এরপর দুপুর আনুমানিক একটার দিকে সুযোগ বুঝে নিচে নামার চেষ্টা করে। কিন্তু কর্তব্যরত গার্ড ডাকঘরের ভিতরে থাকায় নিচে নামতে না পেরে পুনরায় উপরে উঠে লুকিয়ে থাকে। পরবর্তি সময়ে কর্তব্যরত গার্ড ডাকঘরের মসজিদের অজু খানায় হাতমুখ ধুতে গেলে সেই সুযোগে দুপুর আনুমানিক সোয়া একটার দিকে ভোল্ট রুমের দিকে যায় এবং জানালার গ্রিল ভেঙ্গে ভোল্ট রুমে প্রবেশ করে। এরপর ভোল্ট রুমের সিসি ক্যামেরার লাইন কেটে দেয় এবং ভোল্ট কাটে। কিন্তু টাকার বাক্স দূরে থাকায় টাকা নিতে পারে না। পরে সবকিছু ওখানে রেখে সন্ধ্যা ৬/৭ টার দিকে মূলগেট টপকে বাইরে বের হয়ে তার নওগাঁর ভাড়া বাসায় চলে যায়। একদিন নওগাঁর ভাড়া বাসায় অবস্থান করে রাতে মোটরসাইকেল নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যায়।

বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী জানান, আসামী ঈদের দিন নামাজ পড়ে বাড়িতেই অবস্থান করে। ঈদের পরের দিন বিকালে সে মোটরসাইকেল নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে নওগাঁর ভাড়া বাসায় আসে, সেখানে মোটরসাইকেল গ্যারেজে রেখে বাস যোগে রাত্রী নয়টা হতে সাড়ে নয়টার দিকে বগুড়ার চারমাথায় নেমে সিএনজি নিয়ে সাতমাথা আসে। তারপর সে রাত্রী আনুমানিক দুটা পর্যন্ত ডাকঘরের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতে থাকে। রাত্রী দুইটার দিকে চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে ওয়াল টপকে ডাকঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। কিন্তু ঐদিন কেঁচিগেট লাগানো থাকায় ডাকঘরের বারান্দার গ্রিলের দুইটি পাতি রেঞ্জ দিয়ে ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে। সেখানে কর্তব্যরত গার্ড জেগে থাকায় সে কার্টর্ুুুন ও বস্তার আড়ালে ঘন্টাখানিক অপেক্ষা করে। একসময় সতর্কতার সাথে সিসি ক্যামেরা ঘুরিয়ে দিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়এবং সুযোগ বুঝে ভল্ট রুমে চলে যায়। ভল্ট রুমের টাকার বাক্স কাছে নিয়ে আসার কিছু না থাকায় সে অন্য ২/৩ টা রুমের তালা কেটে ভেতর থেকে একটি লম্বা রড নিয়ে আসে। রুমের তালা কাটার শব্দে কর্তব্যরত গার্ড জেগে যায়।

পরবর্তীতে গার্ডের সাথে ধস্তাধস্তির সময় সে কাছে থাকা এসএস পাইপ দিয়ে গার্ডের মাথায় আঘাত করে এবং গার্ডের এক হাত বেঁধে শ্বাসরোধ করে গার্ডকে হত্যা করে। সে পুনরায় ভল্ট রুমে গিয়ে রড দিয়ে ভল্ট রুমের র‌্যাক কাছে নিয়ে এসে র‌্যাকে রক্ষিত ১০০(একশত) টাকার ৭০(সত্তর) টি বান্ডিল ও ৫০ (পঞ্চাশ) টাকার ২০ (বিশ) টি বান্ডিল যাতে সর্বমোট ৮,০০,০০০/-(আট লক্ষ) টাকা ব্যাগে নিয়ে সকাল আনুমানিক সাতটায় মৃত গার্ডের পকেটে থাকা কেঁচিগেটের চাবি নিয়ে ভিতরের গেট এবং মূল গেটের তালা খুলে বের হয়ে বাহির থেকে মূল গেট তালা দিয়ে দেয়। তারপর সে বাস যোগে নওগাঁ চলে যায়। নওগাঁ সদরে অবস্থিত জলিল মার্কেটের মার্কেন্টাইল ব্যাংকে তার এ্যাকাউন্টে ২,০০,০০০/-(দুই লক্ষ) টাকা এবং ডাচ্বাংলা ব্যাংকে তার একাউন্টে ৩,৭৬,০০০/-(তিন লক্ষ ছিয়াত্তর হাজার) টাকা জমা রাখে। তারপর সে গ্রামের বাড়ি সাপাহারে চলে যায়।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত আসামী মোঃ শফিকুল ইসলাম (৪০) পুলিশকে জানায়, সে একজন পেশাদার চোর, ডাকাত এবং ছিনতাইকারী। সে আরো জানায়, সে ইতিপূর্বে ২০১৯ সালে ডিএমপি বনানী থানা এলাকায় জনতা ব্যাংকের ভল্ট কেটে টাকা লুন্ঠন করার সময় আটক হয়। তাছাড়া সে বাংলাদেশের বিভিন্ন থানা এলাকায় দোকানঘরে চুরি, বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি, ছিনতাইসহ পার্শ্ববর্তীদেশ ভারতেও ডাকাতি ও ছিনতাই কার্যক্রম চালিয়ে কারাভোগ করেছে বলে স্বীকার করেছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার শফিকুল ইসলাম ডাকাতির কথা স্বীকার করেছে। বৃহস্পতিবার (০৪ মে ২০২৩) সন্ধ্যায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণের জন্য গ্রেপ্তারকৃত আসামিকে বগুড়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। বিচারক তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ১৬৪ ধারায় রেকর্ড করেছেন।

(এটিআর/এসপি/মে ০৫, ২০২৩)

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test