E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আটোয়ারির বারো আউলিয়ায় প্রাণের মেলা

২০২৩ মে ১১ ১৬:৫৯:১২
আটোয়ারির বারো আউলিয়ায় প্রাণের মেলা

রহিম আব্দুর রহিম, পঞ্চগড় : পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারি উপজেলার মীর্জাপুর। এখানেই স্থাপিত মীর্জাপুর শাহী মসজিদ। বহু বছর আগে সেই ১৬৭৯খ্রিস্টাব্দের কথা। মোগল সম্রাট শাহ আলমের রাজত্ব কালে কারুকার্যময় এই মসজিদটি নির্মিত। যে মসজিদ ঘিরে আবহমানকাল ধরে ঐতিহ্যবাহী বার আউলিয়া মাজার শরীফের ওরশ মোবারক হয়ে আসছে। প্রায় আটচল্লিশ একর আবাদী জমি'র আনাচে কানাচে  আগত মানুষের বাঁধভাঙা স্রোত যেনো অসাম্প্রদায়িকতার মহামিলনে পরিনত হয়েছে।দীর্ঘ কয়েক বছর পর অনুষ্ঠিত ওরশ শরীফে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, রংপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা নারী, পুরুষ, বয়ঃবৃদ্ধ মানুষের আগমন যেনো সকল ধর্ম মতের উর্ধ্বে থেকে এক ঐতিহাসিক মানবধর্মের জন্ম দিয়েছে। দিনমান শেষে রাতে মাজার সংলগ্ন জায়গায়, আধ্যাত্মিক বাউল আসর বসে সন্ধায়। যেখানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খিস্টার্ন বা ধনী দরিদ্র, ছোট বড়, ঢুলিমালি, মুটে মজুরের ভেদাভেদ থাকে না; চলে মানুষের বন্দনা, বেজে উঠে আত্মার পূর্ণতার সুর।    

ওরশকে কেন্দ্র বসা কেনাবেচার হাঁটে উঠে এসেছে পল্লীবালার চূড়ি-মালা, তালপাতার হাতপাখা, কাঠের তৈয়ারি লাঙ্গল জোয়াল, রকামাররা- নিয়ে এসেছেন কাস্তে-কোঁদাল। কোমারদের পশরায় স্থান পেয়েছে হাড়ি-পাতিল।রঘরেরতালা, পুঁতিরমালাও পাওয়া যাচ্ছে এই মাজার মেলায়। শীতলপাটি, বাঁশের লাঠি, বেতের ঢালা কি নেই এই মেলায়? প্রচন্ড রোদ, অসহনীয় তাপমাত্রার প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে শিশুরা তার মায়ের সাথে, বোন তার ভাইয়ের সাথে, নাতী তার দাদার সাথে, কিশোররা এসেছে দল বেঁধে। সে কি মহামিলন। জুরি-মুড়ি, গজা-খাজা, জিলাপি'র দোকানে ক্রেতাদের ভীড়, শিশুদের হাতে পুতুল, মূখে ভো ভো জিল বাঁশি। সর্বস্তরের ক্রেতাদের অর্থনৈতিক লেনদেনে ব্যবসায়ীরা ফুরফুরে মেজাজে।

পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারি'র এই ঐতিহাসিক বারো আউলিয়ার মাজারের জনশ্রুত ইতিকথা ভারী মজার। সে কোন কালে বা কোন আমলের এই মজার কাহিনী, তার কোন সঠিক তথ্যাদি না থাকলেও আজ থেকে প্রায় চারশত বছর আগে এই মাজারে উদ্ভব ঘটে। তবে নতুনভাবে মাজারের আবিষ্কার প্রায় শত বছর পূর্বের। ওরশ শরীফের সৃষ্টি আজ থেকে ২৫বছর আগের। পঞ্চগড়ের জনৈক জেলা প্রশাসক তাঁর অধীনস্ত প্রশাসনিক থানা আটোয়ারি পরিদর্শনে যাবার পথে মির্জাপুর নামকস্থানে তাঁর বহনকারী সরকারি পরিবহনটির স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও যখন তাঁর গাড়ি স্টার্স্ট নিচ্ছিল না, তখন তিনি পায়ে হেঁটে বারো আউলিয়ার মাজারে গিয়ে কিছু টাকা ও তবারক মানত হিসেবে দেন। এরপরই তাঁর গাড়ি স্টার্স্ট নেয়। তিনি আশ্চার্য হোন! তাঁর মনে ধ্যানে বিশ্বাস স্থাপন হয়, এখানে কোন আল্লাহ তালার প্রিয় আশেকজন রয়েছেন।

খুঁজতে থাকেন সেই ইতিহাস। পেয়েও যান, তিনি জানতে পারেন কোন 'এক সময় মধ্যপ্রাচ্য হতে ১২ জন আউলিয়া যাঁরা বিভিন্ন সময়ে এই অঞ্চলে আসেন এদের মধ্যে, হেমায়েত আলী শাহ (রঃ), নিয়ামত উল্লাহ শাহ (রঃ), কেরামত আলী শাহ (রঃ), আজহার আলী শাহ (রঃ), হাকিম আলী শাহ (রঃ), মনছুর আলী শাহ (রঃ) মমিনুল শাহ (রঃ), শেখ গরীবুল্লাহ (রঃ),আমজাদ আলী মোল্লা (রঃ), ফরিজ উদ্দিন আখতার (রঃ), শাহ মোক্তার আলী (রঃ), শাহ অলিউল্লাহ (রঃ)রা বিভিন্ন সময়ে ইসলাম প্রচারের জন্য অত্রাঞ্চলে আগমন করেন। ওই সময়েই তাঁরা এই এলাকায় স্থাপন করেন বসতি। এঁরা মারা যাবার পর এখানেই তাঁদের সমাহিত করা হয়। পর্যায়ক্রমে ১২ জন আউলিয়াকে সমাহিত করায় তাঁদের কবরস্থান ঘিরে এই স্থানের নাম হয় বার 'আউলিয়া মাজার শরীফ।'

পরবর্তীতে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ও পঞ্চগড় জেলা পরিষদের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘বার আউলিয়া মাজারটির সংস্কার ও দৃষ্টি নন্দন করা হয়। বর্তমানে মাজার প্রাঙ্গণে পঞ্চগড় জেলা পরিষদের অনুদানে নির্মিত হয়েছে মিনি ডাকবাংলো। মাজার ঘিরে অনেক আগেই এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মাদরাসা ও এতিমখানা।প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান দু'টির সার্বিক ব্যয়ভার বহন করা হয় মাজারের নিজস্ব সম্পত্তি, ফসলি জমির উৎপাদিত ফসলের আয় থেকে।

প্রতিবছর বৈশাখ মাসের শেষ বৃহস্পতিবার এখানে ওরশ মোবারক অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মহামারী কোভিডের কারণে গত কয়েক বছর ওরশ হয় নি। এবছর ওরশে র উদ্বোধন করেছেন, মাজার কমিটির সভাপতি ও পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম, অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশসুপার (প্রশাসন ও ফিনান্স) এস এম শফিকুল ইসলাম, আটোয়ারি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মো. তৌহিদুল ইসলাম, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুশফিল আলম হালিম, আটোয়ারি থানার অফিসার ইনচার্জ সোহেল রানা ও আটোয়ারি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক প্রমূখ।

(এআর/এসপি/মে ১১, ২০২৩)

পাঠকের মতামত:

২৩ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test