E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কর্ণফুলীর চরপাথরঘাটায় অনুমোদনহীন পানি ব্যবসা তুঙ্গে!

২০২৩ মে ১৪ ১৬:৪০:৩২
কর্ণফুলীর চরপাথরঘাটায় অনুমোদনহীন পানি ব্যবসা তুঙ্গে!

জে. জাহেদ, চট্টগ্রাাম : চট্টগ্রাম কর্ণফুলীর উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নে পানির জন্য চলছে হাহাকার। অপরিকল্পিত নগরায়ন, মিল কারখানা ও নানা ফ্যাক্টরী হওয়ার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির রিজার্ভ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। ভূপৃষ্ঠের পানির উৎস দখল, দূষণ কিংবা হারিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে, সব কিছুর যেন একটা এপিট-ওপিট রয়েছে। ঠিক তেমনি এ সুযোগকে কাছে লাগিয়ে চরপাথরঘাটায় কিছু অসাধু ব্যবসায়িরা করছেন জমজমাট পানির ব্যবসা। যা অধিকাংশই অনুমোদনহীন। স্থানীয় প্রশাসনের নীরবতায় এসব পানি ব্যবসায়ীরা দেদারছে পানি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।

সরেজমিনে ঘুরে এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চরপাথরঘাটার তিন নম্বর ওয়ার্ডে চৌধুরী বাড়িতে অবৈধভাবে পানির ব্যবসা করতে একাধিক গভীর নলকূপ বা ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। এমনকি এক বাড়িতে ৪টি ডিপ টিউবওয়েলও বসানো হয়েছে। এতে ৪ ইঞ্চি পাইপের ডিপ টিউবওয়েল ৭০০/৮০০ ফুট গভীরে গেছে। এসব টিউবওয়েল বসাতে লাখ লাখ টাকা খরচ হয়েছে তা সত্য। কিন্তু করছেন ব্যবসা।

স্থান ভেদে কখনো কখনো তা প্রায় ১০০০ ফুট গভীরতায়ও যেতে হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে এখন অধিক গভীরতার প্রয়োজন হয়। এ কারণে পরিবেশ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ যত কম ভূগভীরস্থ পানি ব্যবহার করা যায়। আমরা সচেনতার অভাবে এর ব্যবহার কমানো তো দূরে থাক, পাল্লা দিয়ে পানি ব্যবসা শুরু করে দিয়েছি। এসব পানি ব্যবসায়িরা টাকার বিনিময়ে চরপাথরঘাটার বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি পানির লাইন দিয়েছেন। কয়েক কিলোমিটার জুড়ে পাইপ আর পাইপ। মাথাপিছু বাড়ি হিসেবে মাসিক হারে ৭০০/৮০০ টাকা আদায় করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

শুধু পরিবার হিসেবে নয়, চরপাথরঘাটা থেকে পানি তোলে পাচার হচ্ছে চরলক্ষ্যা, শিকলবাহায়ও। এমনকি চরপাথরঘাটার বিভিন্ন বরফকল ও জাহাজে পানি বিক্রি করছেন টন হিসেবে ২০০/৪০০ টাকা। ফলে, এ ব্যবসায় এখন অনেকেই লাখপতি। পানি ব্যবসায় জড়িত বলে সন্দিগ্ধ যাদের নাম সামনে এসেছে। তাঁরা হলেন-চরপাথরঘাটার মো. সাগর ও মইনুল আলম। এতে যুক্ত রয়েছে এস আলমের নামও। অথচ গত বছরে চট্টগ্রাম নগরীতে সব ডিপটিউবওয়েল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওয়াসা। কারণ এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে চলে যাচ্ছে। একটি ডিপ টিউবওয়েল থেকে শত শত বাড়ি পানি বিক্রি করায় পরিবেশেও প্রভাব ফেলেছে।

পানির অপর নাম জীবন। পানিটা হতে হবে বিশুব্ধ। কিন্তু পানি বিক্রেতারা বিএসটিআইয়ের (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন) পরীক্ষা ছাড়াই ঘরে ঘরে পানি বিলাচ্ছেন। এতে প্রতারণার ফাঁদে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। আর রমরমা পানি ব্যবসা করে চলেছে তাদের লাখ লাখ টাকা আয়। কেন কর্ণফুলীতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে যাচ্ছে? এটা কী মানবসৃষ্ট, না অন্য কোন কারণ? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে পাঁচটি ইউনিয়নের অধিকাংশ সাধারণ মানুষেরা কিছু তথ্য দিয়েছেন।

তাঁরা জানায়, পরিবেশ অধিদপ্তরের আইন ও সরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ার বিধি নিষেধকে বৃদ্ধাঙ্গুগুলি দেখিয়ে যেখানে সেখানে কর্ণফুলীতে শিল্প কারখানা গড়ে তোলা হচ্ছে। ফলে, কর্ণফুলী উপজেলার জুলধায় কিছুটা পানি ভালো। বড়উঠানে নলকূপ বসায় আর ওঠায়। শিকলবাহায় পানির দূর্দশা, চরলক্ষ্যায় দুই এলাকায় পানি থাকলে, নয়টি এলাকায় হাহাকার, চরপাথরঘাটায় টাকায় মিলছে পানি।

এলাকার লোকজন বলছেন, ‘জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিস ও সরকারি উদ্যোগে কর্ণফুলীতে আরও গভীর নলকূপ বসানোর পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে মজা পুকুরগুলো পুনঃখননসহ নতুন করে স্বাস্থ্যসম্মত রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং প্লান্ট নির্মাণ করা জরুরি। দরকার ‘ক্লোরাইড এন্ড আয়রন রিমুভাল প্ল্যান্ট’ও।

চরপাথরঘাটার মোহাম্মদ মিয়া বলেন, ‘কি করব আমরা। আমাদের তো পানির ব্যবস্থা নেই। নিরুপায় হয়ে পানি কিনে খাচ্ছি। নাগরিক সেবা তো পাচ্ছি না। অথচ ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ চাইলে আমাদের পানির ব্যবস্থা করতে পারেন। কিন্তু যাদের দেখার দায়িত্ব তাঁরা দেখছে না। ফলে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।’

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নাজিম উদ্দিন রাসেল বলেন, ‘ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির স্তর নিচে নেমে গিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য ক্ষুণ্ন হয়। প্রত্যক্ষভাবে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় তা হলো, পানির স্তর ক্রমাগত নেমে যাওয়ার ফলে পানি তোলার ব্যয় বেড়ে যায় এবং পানির প্রাপ্যতা কমে যায়, এমনকি অতিরিক্ত পানি উত্তোলন করা হলে ভূমিধসের ঝুঁকিও বাড়ে।’

চট্টগ্রামের পরিবেশবিদ ড. মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, ‘গভীর নলকূপ থেকে পানি উত্তোলন বন্ধ হলে তা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ইতিবাচক হবে। কিন্তু এসব বন্ধ করছে না কেন বুঝতেছি না।’

এনভায়রনমেন্টাল সাইন্স ডিজেস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মহিনুজ্জামান জানান, ‘ভূগর্ভ থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভে পানি শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। এই শূন্যতা দীর্ঘায়িত হলে ভূগর্ভে সমুদ্রের লোনা পানি ঢুকে যেতে পারে। ফলে সুপেয় পানির দীর্ঘ মেয়াদী অভাব হতে পারে। যা জীবন যাত্রায় অশনি সংকেত বলা যায়।’

(জেজে/এসপি/মে ১৪, ২০২৩)

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test