E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

নওগাঁর মান্দায় কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে অনিয়মের অভিযোগ

২০২৩ মে ৩১ ১৭:৩৩:৪৬
নওগাঁর মান্দায় কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে অনিয়মের অভিযোগ

নওগাঁ প্রতিনিধি : নওগাঁর মান্দা উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নে অতি দরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসূচির (ইজিপিপি) ২য় পর্যায়ের কাজে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এলাকার অতি দরিদ্র ও মৌসুমী বেকার অদক্ষ শ্রমিকদের দিয়ে এই কাজ করানোর নিয়ম থাকলেও তালিকা তৈরীতে স্বজনপ্রীতি করা হয়েছে। আবার এসব শ্রমিক দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করানো হয়েছে। তালিকায় যাদের নাম দেওয়া হয়েছে তাদের বেশিরভাগই অনুপস্থিত থাকলেও সকল শ্রমিককে উপস্থিত দেখিয়ে ভাতা উত্তোলনে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসে (পিআইও) তালিকা জমা দেওয়া হয়েছে। 

স্থানীয় ইউপি সদস্য, চেয়ারম্যান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার যোগসাজসে প্রকাশ্য এ অনিয়ম হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা। এতে সরকারের কর্মসৃজনের উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ায় প্রকৃত শ্রমিকরা বঞ্চিত হচ্ছেন। অনিয়ম ক্ষতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, কর্মহীন মৌসুমে স্বল্প মেয়াদী কর্মসংস্থ্যানের মাধ্যমে কর্মক্ষম দুস্থ পরিবারগুলোকে সুরক্ষা দিতে অতি দরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসূচি (ইজিপিপি) প্রকল্প।

সরকারের অন্যতম বৃহৎ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর এই কর্মসূচি দারিদ্রতা নিরসন ও দূর্যোগ ঝুঁকিহ্রাসে সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ/মেরামত/সংস্কার/মজা পুকুর, রাস্তা, ড্রেন, বাজার পরিষ্কার/ঘরের ভিত্তি উচুকরণ ইত্যাদি কর্ম সম্পাদনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ২টি পর্বে কর্মহীনদের ৪০ দিন করে সর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। নিয়মানুযায়ী সরকারের অন্য কোন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির অধীনে সুবিধাপ্রাপ্ত উপকারভোগীগণকে এ কর্মসূচির অন্তর্ভূক্ত করা যাবে না।

মান্দা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে অতি দরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসূচির (ইজিপিপি) ২য় পর্যায়ের কাজ গত ১০ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে। আগামী ৪ জুন পর্যন্ত মোট ৩৬ দিন কাজ চলবে। প্রতি সপ্তাহে শনিবার থেকে বুধবার পর্যন্ত পাঁচদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত কাজ করার কথা শ্রমিকদের। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে যদি শ্রমিকরা ৭টা থেকে কাজ শুরু করেন সেক্ষেত্রে দুপুর ২টা পর্যন্ত কাজ করার নিয়ম রয়েছে। যেখানে বিছপুর ইউনিয়নে ৫টি প্রকল্পের মাধ্যমে বিষ্ণুপুর শহিদুলের বাড়ি থেকে মফিজের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারে ২৫ জন, দুর্গাপুর স্কুল থেকে কাজীপাড়া পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারে ২৫ জন, দাসপাড়া মমতাজের বাড়ি থেকে গিয়াসের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারে ২৫ জন, চকরামপুর থেকে কয়লাবাড়ি পর্যন্ত বেড়িবাঁধ সংস্কারে ৩০ জন, ফতেহপুর ফুটবল মাঠ থেকে ওয়াবদাহ বাঁধ পর্যন্ত বেড়িবাঁধ সংস্কারে ২৫ জনসহ মোট ১৩০ জন শ্রমিক কাজ করার কথা। দৈনিক হাজিরা বাবদ এসব শ্রমিকরা ৪০০ টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ে (বিকাশ/নগদ) পারিশ্রমিক হিসেবে পাবেন।

গত ২৪ মে সরেজমিন প্রকল্প এলাকাগুলোতে গেলে নানা অনিয়মের চিত্র চোখে পড়ে। সেখানে দেখা যায়, ৫টি প্রকল্পের মধ্যে যাদের নাম কর্মসৃজনের তালিকায় দেয়া হয়েছে এদের মধ্যে বেশিরভাগই এ তালিকায় যুক্ত হবার যোগ্য নন। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বিভিন্ন কর্মসূচির অধীনে সুবিধাপ্রাপ্ত উপকারভোগীদের এ কর্মসূচির অন্তর্ভূক্ত করতে অভিনব কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। তাঁদের পরিবারের অন্য সদস্যদের নাম তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করে কর্মসৃজনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে ওইসব সুবিধাভোগীদের। দৈনিক ১৩০ জন শ্রমিক কাজ করার কথা থাকলেও স্বশরীরে উপস্থিত থেকে এখানে কাজ করছেন ৩০ শতাংশেরও কম শ্রমিক। আবার যারা কাজে আসছেন তাদেরকে পাঠানো হচ্ছে স্থানীয় ইউপি সদস্যদের ব্যক্তিগত কাজে। অনেকে কাজে আসছেন বদলী শ্রমিক হয়ে।

কমপক্ষে দুপুর ২টা পর্যন্ত কাজ করার কথা থাকলেও দুপুর সাড়ে ১২টার আগেই প্রকল্প এলাকা থেকে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন এসব শ্রমিকরা। মাঠ পর্যায়ে এসব তদারকিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যদের থাকার কথা থাকলেও তারা মাঠে আসছেন না। কাজে অংশ না নেয়া অনুপস্থিত শ্রমিকদের নিয়মিত উপস্থিত দেখাচ্ছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্প এলাকায় সাইনবোর্ড টানানোর নিয়ম থাকলেও তা দেয়া হয়নি।

এদিন দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে নহলাকালুপাড়া গ্রামে গিয়ে ১৩ জন শ্রমিককে পাওয়া যায়। সবেমাত্র মাটি কাটার কোঁদাল ও ভাড় গুছিয়ে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এসব শ্রমিকরা। সেখানে মকবুল, জুয়েল, আতাউর, উজ¦লসহ বেশ কয়েকজনের সাথে কথা হলে তারা বলেন, আমরা কে কোন প্রকল্পে আছি সঠিক জানিনা। কিছুদিন আগে মেম্বারের ব্যক্তিগত পুকুর সংস্কারে ৩দিন কাজ করেছি। এখানে কোন শ্রমিক সর্দার নেই। প্রতিদিন সকাল ৭টা দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কাজ করা হয়। মেম্বার সকালে এসে হাজিরা খাতায় ১৮ জনের স্বাক্ষর নিয়ে গেছেন।

পারসিমলা গ্রামের বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান, সাইদুর রহমান, ও জানবাক্স বলেন, এই গ্রামে ইউপি সদস্য হান্নান এর ব্যক্তিগত পুকুরের আশেপাশে কর্মসূচি প্রকল্প নেই। প্রকল্প এলাকা এখান থেকে অনেক দূরে। গত ১৩, ১৪ এবং ১৫ মে ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রকল্প এলাকা থেকে ১৩ জন শ্রমিক এনে ব্যক্তিগত পুকুর সংস্কার করেছেন তিনি। পরে প্রতিবাদ করলে স্থানীয়দের তোপের মুখে ওইসব শ্রমিকদের অন্যত্রে সড়িয়ে নেন তিনি। দুপুর সাড়ে ১২টার পর কর্মসূচির কোন শ্রমিককেই ইউনিয়নে কাজ করতে দেখা যায় না।

ফতেহপুর গ্রামের বাসিন্দা শামসুল আলম, আব্দুল হান্নান ও আজিজুল হক বলেন, আমাদের ইউনিয়নে কর্মসৃজনের কাজ পাওয়ার মতো যোগ্য অনেক অদক্ষ মৌসুমী বেকার শ্রমিক ছিলো। অথচ তাদের কারোর নামই তালিকায় দেওয়া হয়নি। চেয়ারম্যান মেম্বারদের কাছের লোকদের নাম দেওয়া হয়েছে। তারা কেউই কাজে আসেন না। কাজ দেখেশুনে করে নেওয়ার জন্য প্রকল্প এলাকায় শ্রমিক সর্দার থাকার কথা। অথচ কোন শ্রমিক সর্দার কাজে আসেন না। অনুপস্থিতদের নিয়মিত উপস্থিত দেখান মেম্বাররা। প্রকাশ্য এ অনিয়ম ক্ষতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।

প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) ৯ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য এস এম হান্নান বলেন, কর্মসূচির ৬ জন শ্রমিক এনে দুইদিন আমার ব্যক্তিগত পুকুর সংস্কার করিয়েছি। তার বিনিময়ে প্রকল্প এলাকার কাছাকাছি একটা রাস্তায় নিজের ব্যক্তি উদ্যোগ্যে ট্রাক্টর ভাড়া করে ২২ গাড়ি মাটি দেয়েছি। জনস্বার্থে সমন্বয়ের মাধ্যমেই কাজটি করা হয়েছে। এখানে কোন অনিয়ম হয়নি বলেও দাবী করেন তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম গোলাম আজম বলেন, কর্মসৃজনের তালিকায় কিছু সমস্যা হয়ে আছে। বিতর্কিত নাম বাদ দিয়ে তালিকা সংশোধন করতে চেয়েছিলাম। উপজেলা প্রশাসন সেই সুযোগ আমাকে দেয়নি। পূর্বের তালিকাই বহাল রেখেছে। তাই তালিকা তৈরীতে নতুন করে স্বজনপ্রীতির সুযোগ নেই। ইউপি সদস্য হান্নানের ব্যক্তিগত পুকুর সংস্কারে কর্মসৃজনের শ্রমিক ব্যবহার করার বিষয়টি সঠিক।

প্রকল্প এলাকায় শ্রমিক না থাকার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, নাম মাত্র ৫টি এলাকা উল্লেখ করে প্রকল্প দেখিয়েছি। এটা দেখিয়ে প্রকল্প অনুমোদন নিয়ে ওইসব শ্রমিকদের কয়েক ভাগে বিভক্ত করে বিভিন্ন গ্রামে কাজ করানো হচ্ছে। সেখানে প্রতিদিন কতজন শ্রমিক আসছেন সেটা দেখভালের দায়িত্বে ইউপি সদস্যরা আছেন। বর্তমানে প্রতিদিন কমপক্ষে ৯০ জন শ্রমিককে উপস্থিত দেখানো হচ্ছে। ১০০ জনও উপস্থিত হচ্ছে। যারা আসছেন না তাদেরকে অনুপস্থিত দেখিয়ে ভাতা উত্তোলনের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। ৩০ শতাংশের কম শ্রমিক কাজে আসার অভিযোগটি সঠিক নয়।

মান্দা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, শ্রমিকরা নির্ধারিত সময় পর্যন্ত কাজ করার পরই বাড়ি ফিরতে পারবেন। দুপুর ২টার আগে কেউ ইচ্ছেকৃতভাবে কোন শ্রমিক বাড়ি ফিরে গেলে তাঁদের কোন টাকা দেয়া হবে না। বিষ্ণুপুর ইউনিয়নে ইউপি সদস্যের ব্যক্তিগত কাজে কর্মসৃজনের শ্রমিক ব্যবহারের সত্যতা পেয়েছি। ওইদিন যারা সেখানে কাজ করেছেন তাঁদের অনুপস্থিত দেখানো হবে। কর্মসৃজনের কোন অনিয়মে তিনি জড়িত নন বলেও দাবী করেন তিনি।

নওগাঁ জেলা ত্রান ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আশিকুর রহমান বলেন, ব্যক্তিগত কাজে কর্মসৃজনের শ্রমিক ব্যবহার এবং অনুপস্থিতদের উপস্থিত দেখিয়ে তালিকা তৈরী সম্পূর্ণ অবৈধ। এখানে অনুপস্থিত থেকেও কোন শ্রমিক মজুরী পেয়েছে কি না সেটি ক্ষতিয়ে দেখা হবে। সত্যতা পেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরারবর সুপারিশ করা হবে।

(বিএস/এসপি/মে ৩১, ২০২৩)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test